Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইন্টারনেটের শ্লথ গতি এবং ডিজিটালাইজেশনের কল্পকথা

| প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা পেশ করা হয়েছিল। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এ নিয়ে কৌতুহল দেখা গেলেও ডিজিটালাইজেশনের অঙ্গীকার পুরোটা বাস্তবায়ন এক দশকেও সম্ভব হয়নি। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ ও পর্যবেক্ষণে ইন্টারনেটের গতি ও ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানদন্ডে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার চালচিত্রই বেরিয়ে এসেছে। ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প প্রকাশ করা হলেও এর সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করতেই এক দশক পেরিয়ে যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে এসে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের ৫০ শতাংশ সড়ক-মহাসড়কে টোল আদায়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হলেও এখনো দেশের একটি সড়কেও এ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি। ডিজিটালাইজেশনের সেই রূপকল্প বাস্তবায়নে প্রত্যাশার অনেক দূরে অবস্থান করলেও এখন স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্পের কথা বলা হচ্ছে। প্রচারণা, প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকায় নতুন প্রজন্মের কাছে বিষয়টি হাস্যকর বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্বায়নের যুগে যে কেউ এখন ইন্টারনেটের গতিশীলতাসহ তুলনামূলক আঞ্চলিক-বৈশ্বিক ডেটা ও সুযোগ সবিধাসমুহ জানতে পারছে।

দক্ষিণ এশিয়া বা বিশ্বের আর কোথাও ডিজিটালাইজেশন নিয়ে এমন রাজনৈতিক প্রচারনা হতে দেখা যায়নি। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, সাবেমেরিন ক্যাবল ও ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি থেকে এন্ড্রোয়েড-স্মার্ট মোবাইলফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বের স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার বিস্তার ঘটে চলেছে। ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইন্টারনেটের গতি ও তার সুবিন্যস্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশন অনেকটা রাজনৈতিক প্রচার-প্রপাগান্ডার বিষয়ে পরিনত হলেও মোবাইল ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে তো বটেই, প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়েও অনেক পিছিয়ে থাকার বাস্তবতা সরকারের ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্য অর্জনকে নির্দেশ করেনা। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেছে। ২৯৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কথা প্রকাশ করার পর থেকে সরকার ও সরকারি দলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা ও বক্তব্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দে পরিনত হয়েছে। পলিটিক্যাল রেটরিক আর বাস্তব উন্নয়ন এক কথা নয়। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চারটি বিষয়কে ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা হচ্ছে- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গবর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা এবং এ ক্ষেত্রে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলার ন্যুনতম লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। এনালগ গতির অর্ধেক ডিজিটালের উপর ভর করে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ করা কতটা সম্ভব সেটা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এখন পরিবর্তিত বাস্তবতায় বিদ্যুতের ঘাটতি ও লোডশেডিং আমাদেরকে যেন আরো পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।


ইন্টারনেটের তুলনামূলক গতি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ওকলার সর্বশেষ প্রতিবেদনে মোবাইল ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৪১ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৬তম। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত নেপাল বা শ্রীলঙ্কা কিংবা আফ্রিকার সুদান, ইথিওপিয়া বা উগান্ডার চেয়েও পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হয়ে উঠতে যে ধরণের বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে, তা এখনো দৃশ্যমান নয়। দেশের মোবাইলফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো ফোরজি গতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তারা এখনো টুজি গতিও নিশ্চিত করতে পারেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’ চুক্তি অনুসারে ইন্টারনেটের গতি ও নিরবিচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ নিশ্চিত করার বদলে তাদের সব প্রয়াস যেন শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ইন্টারনেটের গতি এবং সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হলে ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় গোপণীয়তা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইজিডিআই বা জাতিসংঘের ই-গর্ভমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১১১তম স্থানে রয়েছে। ওর্য়াল্ড ইকোনমিক ফোরামের নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্সে(এনআরআই) বিশ্বের ১৩১ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। এ ক্ষেত্রে ভারত, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে। নেটওয়ার্কের গতি, অবকাঠামো ও সাইবার সিকিউরিটির মত ইস্যুগুলোতে বিটিআরসি বা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যাবহার ও ইন্ডিভিজুয়্যাল কানেক্টিভিটি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকলেও ইন্টারনেটের গতি এবং সরকারি-বেসরকারি সেবা খাতের সাথে সাধারণ মানুষের এক্সেস নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার বাস্তবতা অগ্রহণযোগ্য। বিশ্ব যখন গুগল সার্চিং ইঞ্জিন থেকে চ্যাট জিটিপি’র যুগে প্রবেশ করতে চলেছে, তখন আমাদের নাগরিক সমাজ শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে বিস্তর ভুল তথ্যের প্রতিবাদে রাজপথে নামতে বাধ্য হচ্ছে। সারাবিশ্বে যেখানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের মধ্য দিয়ে পণ্য ও সেবার মানবৃদ্ধি ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে আমরা এখনো শুধু রাজনৈতিক গলাবাজিতেই সময় ক্ষেপণ করে চলেছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন