Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পুলিশকে জনবান্ধব ও নিরপেক্ষ হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

গত শনিবার ছিল বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি। শান্তিপূর্ণ ওই কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের বাধাদান ও হামলার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতিককালে বিএনপির যে কোনো কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ শান্তি সমবেশের নামে পাল্টা কর্মসূচি দেয়। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই আর শান্তিপূর্ণ থাকে না। আওয়ামী লীগের তরফে ইতোপূর্বে বার বার বলা হয়েছে, বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কোনো কর্মসূচি দেয়া হবে না বা হচ্ছে না। অথচ বিএনপির কর্মসূচির বিপরীতে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করছে। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে উত্তেজনা, সংঘাত, হানাহানি দেখা দেয়া স্বাভাবিক। শনিবারও তাই দেখা গেছে। প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তত ১৫টি জেলায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নাটোরে বিএনপির পদযাত্রা মঞ্চ দখল করে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করেছে। সিরাজগঞ্জ দু’দলের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ভাংচুর হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষের সময় পুলিশ গুলি ছুঁড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। লালমনিরহাটে বিএনপির একটি কার্যালয় ও কিছু মোটর সাইকেল ভাংচুর করা হয়েছে। আর কয়েকটি জায়গায় পুলিশের বাধার কারণে বিএনপির কর্মসূচি পন্ড হয়ে গেছে। এসব ঘটনায় বিএনপির দুই শতাধিক কর্মী আহত ও অন্তত ৬৪ জন গ্রেফতার হয়েছে। যে কোনো রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি করার অধিকার রয়েছে। তাতে বাধা দেয়ার বা কর্মসূচি পন্ড করার কোনো অধিকার অন্য কোনো দলের বা পুলিশের নেই। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির প্রতিটা কর্মসূচি বাধা ও হামলার শিকার হচ্ছে। এরকম পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া ও হানাহানির জন্ম দেয়া কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না। গণতন্ত্রে এটা সম্পূর্ণ অচল।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, গত প্রায় দেড় দশক ধরে গণতন্ত্র চর্চা দেশেই কেবল নয়, বিদেশেও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আসছে। একটি গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের নামে হচ্ছে প্রহসন, যা গণতান্ত্রিক বিশ্ব মোটেই সমর্থন করছে না। এই সময়ে বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সরকার বা সরকারি দল যে আচরণ করেছে ও করছে, তা মোটেই গণতন্ত্রের সাথে যায় না। বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা- গ্রেফতারসহ অকথ্য নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মী এর মধ্যেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। পাশাপাশি মানবাধিকার লংঘন বিশেষত, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি অভিযোগ আছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল, উন্নয়ন, সহযোগী দেশ, এমন কি জাতিসংঘও এই দু’ব্যাপারে অর্থাৎ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে। কারো অজানা নেই, মানবাধিকার লংঘনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও তার কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পরবর্তীতে র‌্যাবের অবস্থানের কিছু উন্নতি হলেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি বরাবরই অবাধ রাজনৈতিক চর্চা, গণতন্ত্রে উত্তরণ, নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকারে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের অভিমত ও অবস্থান নানাভাবে জানান দেয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফেও একই রকম বলা হচ্ছে। জাতিসংঘের ৮ র‌্যাপোটিয়ারের দুটি বিবৃতির কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। গত ২২ ও ২৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধাদান, হামলা, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশের মারমুখী আচরণ ও ভূমিকা, গুলিতে ৪ জন মানুষের নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। ওইসব অভিযোগ ও ঘটনার তদন্ত করার ও বিচারের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ক’দিন আগে খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ৯ দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, ডেনর্মাক, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি মনিটর করবে বলে জানিয়েছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য তো সবারই জানা। তা নিয়ে অনেক কথা, অনেক আলোচনা হয়েছে। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর জ্যানেট রাইস বাংলাদেশে গুম, খুন, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অস্ট্রেলীয় সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে বিরোধী দল ও রাজনীতি দমন এবং মানবাধিকার, লংঘনের অভিযোগ দেশের জন্য মোটেই সম্মান বহন করে না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের মর্যাদাও বাড়ায় না। দলীয় বাহিনী নয়, পুলিশ বা পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা। তার সদস্যরা সরকারের দ্বারা নিয়োগকৃত ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। অথচ, এই সরকারের আমলে তারা সরকারি দলের অনুগত হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই ভূমিকা পালন করছে, যা অনভিপ্রেত ও অসমর্থনযোগ্য। পুলিশকে বলা হয়, জনগণের সেবক, সহযোগিতাকারী, নিরাপত্তা বিধানকারী ও বন্ধুভাবাপন্ন। তার এসব বৈশিষ্ট্য অনেকখানি ক্ষুণœ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তার স্থলে পুলিশ পরিণত হয়েছে ভীতি-আতংকের প্রতীকে। সরকারি দল ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তেমন সুসম্পর্ক নেই পুলিশের। বিএনপির সঙ্গে তার সম্পর্ক তো রীতিমত বৈরী ভাবাপন্ন। এটা হওয়ার কথা নয়। পুলিশের রাজনীতিনিরপেক্ষ থাকা দেশের জন্য এবং পুলিশের জন্যও কল্যাণকর। আশার কথা, বিএনপি ও পুলিশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নত ও স্বাভাবিক করার একটা প্রচেষ্টা হয়তো তলে তলে চলছে। এর প্রমাণ ডিএমপির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ। পুলিশের আমন্ত্রণ জানানো এবং বিএনপির দু’জনের একটি দলের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। এও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয় যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং তাদের সঙ্গে সহাস্যে কুশল বিনিময় ও করমর্দন করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এই প্রথম পুলিশের কোনো অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দেখা গেল। এ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা বরকতউল্লাহ বুলু বলেছেন, একটি বার্তা দিতেই সেখানে তাদের যাওয়া। বার্তাটি হলো, পুলিশ জনগণের প্রতিপক্ষ নয়, জনগণও পুলিশের প্রতিপক্ষ নয়। বলা বাহুল্য, জনগণের সেবক হিসেবে পুলিশের ভাবমর্যাদা যথেষ্ট অবনত হয়েছে। তা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপরই বর্তায়। আমাদের পরিবারে-সমাজে নানা ক্ষেত্রে বিরোধ আছে। রাজনীতিতেও আছে। এমন কি পশুর মধ্যেও বিরোধ-বৈরিতা আছে। এইসব বিভিন্ন রকম মতদ্বৈততা, বিরোধ ও ভিন্নতা স্বীকার করেই আমরা এক সঙ্গে থাকি, বসবাস করি। বৈচিত্র্যের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধ দ্বারা আমরা পরিচালিত হই। এই শিক্ষার আরো প্রসার ঘটাতে হবে। পারস্পারিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের নিরপেক্ষ ভূমিকা ও অবস্থানে অনেক কিছুরই অতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পুলিশকে নিয়ে দেশে-বিদেশে যত অভিযোগ, যত প্রশ্ন, তার অবসান ঘটুক, এটাই আমরা কামনা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন