Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাষা আল্লাহর দান : ভালো কথা তাঁর নির্দেশ

জাফর আহমাদ | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ভাষা পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সেরা দান। তাঁর প্রথম করুণা, ‘তিনি আমাদের মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন’ দ্বিতীয় করুণা, ‘তিনি মনের ভাব, নিজের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ব্যক্ত এবং ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণের জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’। ‘পরম দয়ালু (আল্লাহ) এ কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে কথা বা ভাষা শিখিয়েছেন।’ (সুরা রহমান: ১-৪)। মানুষের বাকশক্তি এমন একটি বিশেষ নিয়ামত, যা মানুষকে জীবজন্তু ও পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিকূল থেকে পৃথক করে রেখেছে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারা জীবন ভাষার ব্যবহারে পরিপূর্ণ। মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার ক্রন্দনরোল এ পৃথিবীতে তার যে আগমনী বার্তা ঘোষণা করে তা একধরনের ভাষারই নামান্তর। এ মানব শিশু তার কৈশোর, যৌবন ও কর্মময় জীবনের প্রতিটি স্তরে তার অভিব্যক্তি প্রকাশের বাহন হিসেবে ভাষার ব্যবহার করে।
মানুষ তার মতামত, চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি ভাষার সাহায্যে মৌখিক অথবা কাগজে-কলমে লিখিত আকারে প্রকাশ করে। এ সবই ‘আল্লামাহুল বায়ান’ তথা ভাষা শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া বিভিন্ন দেশ-জাতি ও ভূখ-ের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে থাকে। এটিও আল্লাহ তা’আলার শিক্ষারই অন্তর্ভুক্ত। যেমন: প্রথম মহামানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘এবং তিনি আদমকে সমস্ত বস্তু ও দ্রব্য সামগ্রীর নাম শিক্ষা দিলেন।’ (সুরা বাকারা: ৩১)। এখানে পৃথিবীর সকল ভাষাও অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বাংলা ভাষাও আল্লাহর সেরা দান।

আল্লাহ তা’আলা যে বাকশক্তি দান করেছেন, এটি শুধু বাকশক্তিই নয়, বরং এর পিছনে জ্ঞান ও বুদ্ধি, ধারণা ও অনুভূতি, বিবেক ও সংকল্প এবং অন্যান্য মানসিক শক্তি কার্যকর থাকে, যেগুলো ছাড়া মানুষের বাকশক্তি কাজ করতে পারে না। এ গুলোর জন্য শিক্ষা, বই-পুস্তক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষা, লেখা, বক্তৃতা বিতর্ক ও যুক্তি প্রমাণের মতো উপায়-উপকরণকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে। শুধুমাত্র জন্মগত লব্ধ জ্ঞানকেই যথেষ্ট মনে করা হয় না। ভাষা ব্যবহারের যথার্থতা থাকতে হবে। যে কথা বা ভাষা নিজের বা দেশের উপকারে আসে না, সেটি ভাষা হতে পারে না। উল্লেখিত আয়াতে মানুষ সৃষ্টি ও ভাষা শিক্ষাদান করার আগেই কুরআনের কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ক্রমানুসারে প্রথমেই মানুষ সৃষ্টি, দ্বিতীয়ত ভাষা জ্ঞান শিক্ষা, এর পর কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা আসতে পারে। কিন্তু এ ক্রমধারা বজায় না রেখে প্রথমেই কুরআনের কথা বলে এ ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, মানব সৃষ্টির আসল লক্ষ্যই হচ্ছে কুরআন শিক্ষা এবং কুরআন নির্দেশিত পথে চলা ও কুরআনের ভাষায় কথা বলা। যিনি মানুষ সৃষ্টি করলেন এবং তাকে কথা বলাও শিখালেন, অথচ তার কথা বলার ধরন কী হবে তা তিনি দেখাবেন না, তা কি হতে পারে? সৃষ্টি যার শিক্ষাও হবে তার। সৃষ্টি যেমন, শিক্ষাও হবে তেমন। সুতরাং যে সৃষ্টিকে ভাষা শেখানো হয়েছে তার জন্য কুরআনই হতে পারে শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম। মানুষ যদি আল-কুরআনকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু শেখে, তবে তাদের অবস্থা ঐ সৃষ্টিকূলের মতই হবে অথবা তাদের চেয়ে নিম্নতর হবে, যে সৃষ্টিকূলকে ভাষা জ্ঞান দেয়া হয়নি। সত্যিই তখন এ দুয়ের পার্থক্য নিরূপণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ নৈতিক জীবের যোগ্যতা ও মর্যাদা হারায়।

ভাষা বা কথা দুই প্রকার। এক, পবিত্র বা ভালো কথা। দুই, খারাপ কথা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তুমি কি দেখছো না আল্লাহ কালিমা তাইয়্যেবার উপমা দিয়েছেন কোন জিনিসের সাহায্যে? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো জাতের গাছ, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে। প্রতি মুহূর্তে নিজের রবের হুকুমে সে ফলদান করে। এ উপমা আল্লাহ তা’আলা এ জন্য দেন, যাতে লোকেরা এর সাহায্যে শিক্ষা লাভ করতে পারে। অন্যদিকে অসৎ বাক্যের উপমা হচ্ছে, একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই।’ (সুরা ইবরাহিম: ২৪-২৫)। পৃথিবীর সর্বোত্তম কথা হলো কালিমাতুত তাইয়্যেবা তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নাই।

যিনি কালিমা তাইয়্যেবার ভিত্তিতে নিজের জীবন ব্যবস্থাকে গড়ে তোলেন, তার কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, চিন্তাধারায় পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আচরণে মাধুর্য, ব্যবহারে নম্রতা, লেনদেনে সততা, ওয়াদা ও অঙ্গীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবনযাপনে সদাচার, চেহেরায় পবিত্রতার ভাব ফুটে উঠবে। মোট কথা, ব্যক্তির সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থা পূত-পবিত্র হবে, যার জীবনধারার কোথাও কোনো অসঙ্গতি থাকবে না। সর্বোপরি একজন মুমিন আল-কুরআন অনুযায়ী কথা বলবে এবং আল কুরআন অনুযায়ী কথা পরিত্যাগ করবে। আল-কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন চলার পথে কিছু জিনিসকে গ্রহণ করবে আবার কিছু জিনিসকে ত্যাগ করবে। একেই বলে মুত্তাকী। আর এই মুত্তাকীর জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অমূল্য উপহার হচ্ছে আল-কুরআন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আলিফ-লাম-মিম। (এই নাও) সেই কিতাব (আল-কুরআন) তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই, ইহা মুত্তাকী লোকদের পথ দেখাবে।’ (সুরা বাকারা-১-২)।

সুতরাং একজন মুমিনের এমন কথা বলা উচিত নয়, যা একটি মারাত্মক বোমার চেয়েও ক্ষতিকর। একটি বোমা নির্দিষ্ট কিছু লোকের জানমালের ক্ষতি করে থাকে। কিন্তু একটি খারাপ কথা সমাজ ভাঙ্গনের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের কথা সমাজকে বীভিষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখী করে। সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধের স্থান দখল করে নেয় হিংসা-হানাহানি, বিদ্বেষ আর অহংবোধ। আর এর ফলে মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়। সে কথাটি যদি সঠিক না হয়, কিংবা সেটি লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোকষ্টের কারণ হয়, তাহলে ব্যাপারটি আরো মারাত্মক। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘মানুষ খারাপ কথা বলে বেড়াক, তা আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না। তবে কারো জুলুম করা হলে তার কথা স্বতন্ত্র। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।’ (সুরা নিসা: ১৪৮)। হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত হারাম।’ (মুসলিম ও তিরমিযি)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নাই।’ (মুসনাদে আহমাদ)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম সে, যার ভাষা ও কর্ম থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ বুখারী)। রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘ভাষার ফসলই মানুষকে জাহান্নামে উপুড় করে নিক্ষেপ করবে।’ (তিরমিযি)।

কুরআনের বহু আয়াত ও হাদীসে মন্দ কথা উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে যারা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান রাখেন, মন্দ কথা থেকে বিরত থাকা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। কারণ, কালিমা তাইয়্যেবা পৃথিবীর সর্বোত্তম কথা। এ কালিমা যিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, তার চরিত্রে একদিকে ভালো কথা, ভালো চিন্তা ও আচরণ, অন্য দিকে মন্দ কথা, মন্দ চিন্তা বা আচরণ একই সাথে বিরাজ করতে পারে না।

মন্দ কথা হলো ‘কালিমাতুল খাবিসা’। মন্দ কথায় কোনো লাভ নেই। এতে কোনো উপকার নেই। আছে ক্ষতি আর ক্ষতি। এটি নিজের ব্যক্তিত্ব, সুনাম ও মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে। মন ও চরিত্রকে করে কুলষিত। ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়। যে মন্দ কথা বলে তাকে সকলেই ঘৃণা করে। নবী মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘হে মুহাম্মদ, আমার বান্দাদেরকে বলো, তারা যেন মুখ হতে সেসব কথাই বের করে, যা অতি উত্তম। আসলে শয়তানই মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃত কথা হলো, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’ (বনী ইসরাঈল: ৫৩)।

সুতরাং ভাষার মাসে আহবান, সঠিক ও সুন্দর কথা বলুন। মিথ্যা, অসৎ, খারাপ কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকুন। সুন্দর ও ভালো কথা ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। সুন্দর করে কথা বলা মানুষের শ্রেষ্ঠ একটি গুণ। আর এটি আল্লাহর দান। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে কথা বলা একটি দান।’


লেখক: প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন