Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পশ্চিমে কোরআন অবমাননা এবং ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্মম হত্যাকা-

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

মানব সভ্যতার ইতিহাসে গত একশ বছর (১৯১৭-২০২২) সবচেয়ে ঘটনাবহুল। এ সময় সা¤্রাজ্যবাদী নির্মমতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিশ্বযুদ্ধের কাল পেরিয়ে এই নিষ্ঠুরতা এখন ফিলিস্তিনি আরব মুসলমানদের উপর ভর করে জায়নবাদের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা পুঁজিবাদের শয়তানি শক্তির ঔদ্ধত্বপূর্ণ আস্ফালন দেখাচ্ছে। সুইডেন, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডে পবিত্র কোরআন পোড়ানোর মধ্য দিয়ে মুসলমানদের প্রতি তাদের আক্রোশ ও প্রতিহিংসার জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়ে জায়নবাদ নিয়ন্ত্রিত মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতি এর জন্য সরাসরি দায়ী। অসংখ্য দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া ইসরাইলি নেতা নেতানিয়াহু কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থন নিয়ে আবারো ক্ষমতায় এসে ফিলিস্তিনের উপর মরণ কামড় বসাচ্ছে। ওদিকে সাধারণ ইসরাইলিরা আবারো নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। হাজার হাজার ইসরাইলি বিক্ষোভে রাজপথে নেমে নেমে এসেছে। ইসরাইলি সেনারা প্রতিদিনই ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। মানবাধিকারের ছবক ফেরি করা পশ্চিমারা এখানে নির্লজ্জভাবে নিরব।

আরব দিগি¦জয়ীদের ইউরোপ বিজয়ের প্রেক্ষাপটে খৃষ্টীয় একাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের শুরু পর্যন্ত সংঘটিত ক্রুসেডের চার দফা যুদ্ধে পশ্চিমা সম্মিলিত বাহিনী মুসলমানদের কাছে হার মানতে বাধ্য হওয়ার ৮০০ বছর পর ১৯১৯ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে ওসমানীয় খেলাফতের ভাঙ্গন ও ভাগবাটোয়ারার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা হয়, তার নেপথ্যে কাজ করেছে রাশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে থাকা ইহুদি ব্যাংকার ও জায়নবাদী কমিউনিটি লিডাররা। পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ইহুদি ও আমেরিকার সমর্থন নিয়ে যুদ্ধের ফলাফল নিশ্চিত করতে ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনের আরবদের ভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়। তৎকালীন বাস্তবতায় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোরের সেই ঘোষণা ছিল অবাস্তব। ফিলিস্তিন মুসলমান, খৃষ্টান ও ইহুদিদের জন্য ঐতিহাসিক পূণ্যভূমি বলে স্বীকৃত হলেও সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল শতকরা ১০ ভাগেরও কম। মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগেই রোমান এবং খৃস্টানদেন হাতে নিগ্রহ-নির্যাতন ও জাতিগত দমনাভিযানের শিকার হয়ে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। এমনকি ক্রুসেডের সময়ও অনেক ইহুদি মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেছিল বলে জানা যায়। আগের হাজার বছরের ইতিহাসে খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত স্পেনের আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় প্রথম ইহুদিরা ধর্মীয়-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ইতিহাসে সেই সময়টিকে ‘জুইশ গোল্ডেন এরা’ বলে অভিহিত হয়। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বে আরবে প্রথম, সুসভ্য, সুশৃঙ্খল ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইহুদি ও খৃষ্টানদের সব ধরনের স্বাধীনতাসহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের উপর জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দেয়া বা কোনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধের হুমকি ছাড়া কোনো সম্প্রদায়ের উপর অস্ত্র ধারণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলেই মুসলমান শাসকদের অধীনে ইহুদিদের একটি নতুন স্বর্ণযুগের ইতিহাস সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল। ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগেই মিশর ও ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদের এক্সোডাস বা গণহারে দেশত্যাগ সম্পন্ন হয়েছিল। এরপর দুই হাজার বছরের ইতিহাসে বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদের নীল নকশায় অবাস্তব প্রক্রিয়ায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি আরবদের জমি দখল করে প্রথম একটি ইহুদি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ইহুদি-খৃষ্টানদের নেতৃত্বাধীন নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা বিশ্বকে ক্রমেই চরম পুঁজিবাদী, যুদ্ধবাদী ও রক্তক্ষয়ী করে তুলেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোনোটিই মুসলমানদের কারণে হয়নি। ইউরোপে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের ফলাফল ও পরিসমাপ্তি ঘটলেও এসব যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ করা হয়েছিল অটোমান সা¤্রাজ্য তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ভাগাভাগি করে। প্রথম মহাযুদ্ধের মাঝপথেই (১৯১৬) সাইক্স-পাইকট এগ্রিমেন্টের মধ্য দিয়ে বৃটিশ, ফরাসী ও রাশিয়ান আঁতাত ও যুদ্ধ পরবর্তী তুরস্ক তথা ওসমানীয় খিলাফতের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব সংঘটিত হলে পক্ষ হিসেবে রাশিয়ার বিচ্যুতি ঘটে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর বৃটিশ জেনারেল এলেন বি’ নাকি বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশের সময় বলেছিলেন, আজ ক্রসেডের পরিসমাপ্তি হলো। একইভাবে ফরাসী এক জেনারেল সিরিয়ায় প্রবেশ করে গাজী সালাউদ্দিনের কবের পদাঘাত করে নাকি বলেছিলেন, সালাউদ্দিন, আমরা ফিরে এসেছি। এর মানে হচ্ছে, আটশ’ বছর আগে ক্রুসেডের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বেদনা তারা বংশানুক্রমিকভাবে বহন করে চলেছে।

ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে বালফোরের ঘোষণা সত্ত্বেও সার্বিক পরিস্থিতি ও ডেমোগ্রাফিক বাস্তবতায় তা সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসী বাহিনীর হলোকস্ট তথা ইহুদি গণহত্যা তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে যুদ্ধজয়ী বৃটিশ ও আমেরিকার মদতে উগ্র জায়নবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী হাঘানা বাহিনীকে উন্নত প্রশিক্ষণ, অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র এবং বিপুল অর্থ দিয়ে ফিলিস্তিনে তান্ডব চালিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুসলমান ও আরবরা তো নয়ই, এমনকি ধর্মপ্রাণ ইহুদিরাও এভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে পারেনি। ইসরাইলের ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আয়োজন বর্জন করে সারাবিশ্বের ২ শতাধিক ইহুদি, লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল তার সারকথা হচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত আরবদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি না হবে ততদিন ইহুদি রাষ্ট্রকে তারা মেনে নেবে না। হাজার হাজার উদারপন্থী, সমাজতন্ত্রী ও অর্থডক্স ইহুদি ধর্মাবলম্বী গণহত্যা ও বর্বরতার মাধ্যমে জায়নবাদী রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চলমান দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনকে মেনে নিচ্ছে না। প্রায় ৮ দশক পেরিয়ে এসেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। ৮০ বছর ধরেই তারা মুসলমান আরবদের জমি দখল করে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে। নিজস্ব আবাসভূমি ফিরে পেতে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে প্রতিদিনই আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে পশ্চিমা বিশ্ব যেন এই ইস্যুটিকে একটি দগদগে ক্ষতচিহ্ন হিসেবে জিইয়ে রাখতে চাইছে। ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের চোখে দেখে না। কট্টর জায়নবাদীরা যেভাবে দেখায় তারা সেভাবেই দেখে, সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখায়। ইহুদিরাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালায়। বিভিন্ন সময়ে ইসরাইলি নেতাদের মুখে এই সত্য বেরিয়ে এসেছে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জবানিতেও এই কথা প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিপুল খরচের বড় অংশই আসে ইহুদি কর্পোরেট ডোনারদের কাছ থেকে। পশ্চিমা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর সমর্থন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতেও পারে না। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক, আইপ্যাকের সমর্থনের বাইরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির শান্তি চুক্তি করেন, তখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে ওবামার বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছিল। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অগ্রাহ্য করে মার্কিন সিনেটে নেতানিয়াহুর বক্তব্য প্রদানের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি তথা ইসরাইলের অবস্থান কোথায়।

আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত চাতুর্য ও সময়ক্ষেপণের কৌশল পালন করে চলেছে। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে কিছুটা মতভিন্নতা থাকলেও একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত তাদের হাত যেন কোথাও বাঁধা পড়ে যায়। ইরানের সাথে পরমাণু সমঝোতা চুক্তির প্রশ্নে ওবামার বিপরীতমুখী অবস্থান নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওবামার নেয়া পদক্ষেপের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সাথে সাথে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহলের অঙ্গীকার থেকে সরে গিয়ে তড়িঘড়ি জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন সচেতনভাবে সাপলুডু খেলায় লিপ্ত হয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখন আরব-ইসরাইল সংকট সমাধানে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের অঙ্গীকারের কথা বলছেন। তবে ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ট্রাম্প আমলের আব্রাহাম চুক্তির আওতায় আরব দেশগুলোর সাথে নরমালাইজেশন প্রক্রিয়ার সাথেও মার্কিন কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। পশ্চিমাদের সর্বাত্মক সহায়তায় বিংশ শতকের শেষতক সারাবিশ্বের কাছে অজেয় শক্তি হিসেবে পরিগণিত ইসরাইল একবিংশ শতকে এসে ফিলিস্তিনি ও লেবাননের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে একাধিকবার পরাস্ত হওয়ার পর এটা আবারো প্রমাণিত হয়েছে, আরবরা নিজেদের ঈমানি শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরাইলের অস্তিত্ব ও পশ্চিমাদের খবরদারি চিরতরে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব। এহেন বাস্তবতা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে পড়ায় প্রমাদ গুনতে গুনতে ট্রাম্প প্রশাসন আরবদের কাছে ইরান জুজু জিইয়ে রাখতে ৬ জাতির পরমাণু সমঝোতা চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরবদের জন্য নানা ধরনের প্রলোভন ও হুমকি খাড়া করে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। আর তাতে আরবরা আত্মাহুতি দিতে শুরু করে। পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর প্রতি সমর্থন ও সহায়তা অব্যাহত রেখে একটি চূড়ান্ত বিজয়ের প্রত্যাশা এখন অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।

ভুরি ভুরি দুর্নীতির মামলা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ত্যাগের দেড় বছরের মাথায় যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু আবারো ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের উপর আগ্রাসন, হত্যাকান্ড ক্রমশ বেড়েই চলেছে। চরম মুসলিম বিদ্বেষী ডানপন্থী বেনগাভিরের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই নেতানিয়াহুর রক্তপিপাসা প্রকট আকার ধারণ করেছে। একদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন করে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আলোচনা এগিয়ে নেয়ার কথা বলছেন, অন্যদিকে নেতানিয়াহু ট্রাম্প আমলের আব্রাহাম একর্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আফ্রিকার কয়েকটি আরব দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগে নতুন নতুন সাফল্যের বার্তা দিচ্ছেন। আরব-ইসরাইল সংকট সমাধানের প্রশ্নে এ এক জটিল বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। আরব-ইসরাইল সংকটে বার বার আরবদের হেরে যাওয়ার জন্য তাদের অনৈক্য ও পারস্পরিক আস্থাহীনতার সংকট অনেকাংশে দায়ী। তারা নিজস্ব আঞ্চলিক বাস্তবতার দিকে না তাকিয়ে পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশন ও প্ররোচনায় ইসরাইলের বদলে ইরানকেই প্রতিপক্ষ ভেবে নানামুখী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি-তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। পশ্চিমা পরিকল্পনায় সম্মিলিত উদ্যোগে অটোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের দখলদারিত্ব ও ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও বায়তুল মোকাদ্দাসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ইরান ছাড়া কোনো আরব শাসক স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেননি। ইঙ্গ-মার্কিনিদের প্রত্যক্ষ মদত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পশ্চিমা পুতুল পাহলবি শাহের শাসনের বিরুদ্ধে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনি প্রথম ফিলিস্তিনের অধিকার ও মুক্তির স্বপক্ষে স্পষ্ট বার্তা প্রকাশ করেন। তিনিই প্রথম জুমাতুল বিদা বা রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। যত দিন যাচ্ছে এ বিষয়ে মুসলমানদের সমর্থন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ছে। পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায় পরাশক্তিগুলোও এ বিষয়ে সাড়া দিতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন ও মুসলমান ইস্যুগুলোর প্রতি রাশিয়ার সমর্থন ক্রমেই বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি সুইডেন, ডেনমার্কসহ ইউরোপের কয়েকটি শহরে পবিত্র কোরআন অবমাননার নিন্দা জানিয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর সংসদের প্রতি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমানা অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে রাশিয়া ও চীনের সমর্থন বিভিন্ন সময়ে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই যুদ্ধে ইরানের ড্রোনসহ সমরাস্ত্রগুলো রাশিয়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে এতদিনের গোপনীয়তা ছেড়ে ইসরাইলের নেতানিয়াহু এখন প্রকাশ্যে ইউক্রেনের ইহুদি নেতা জেলনস্কিকে আয়রন ডোমসহ সফিসটিকেটেড সমরাস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মানে হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধকে ইসরাইলের জায়নবাদীরা নিজেদের জন্য অস্তিত্বের সংকট হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ দেখা দিয়েছে তা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলকে শায়েস্তা করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ছাড়বে। ৮০ বছরের ধারাবাহিক দমনাভিযানেও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে তারা স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। এবার নতুন বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া, ইরান, চীন, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সম্মিলিত শক্তিতে জায়নবাদীদের রক্তাক্ত দাঁত ও হাত ভেঙ্গে দেয়ার চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হয়েছে, যা কাজে লাগাতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন