Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদানিকান্তে বিপর্যয়ের মুখে ভারতের অর্থনীতি

| প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

এক সপ্তাহ আগেও গৌতম আদানি ভারত ও এশিয়া মহাদেশের শীর্ষ ধনী এবং ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের ধনীদের তৃতীয় ছিলেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নেমেছেন ২২তম অবস্থানে। এ যেন সকালবেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলার মতো। শীর্ষ তালিকা থেকে দ্রুত গতিতে পতনের এমন নজির বিশ্বে আর নেই। আদানির পতনের মূল কারণ তার মালিকানাধীন শিল্প গোষ্ঠীর কারচুপি ও কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া। এটি ধরা পড়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চের এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গৌতম আদানি কারচুপির মাধ্যমে ধনী হয়েছেন এবং তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছেন। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর গৌতম আদানির সম্পদের পাহাড় ধসে পড়তে শুরু করে। মূলত গৌতম আদানির সম্পদের পরিমান বাড়তে থাকে ২০২০ সাল থেকে। করোনা মহামারির সময় বিশ্বের অন্য ধনীদের মতো তার সম্পদের পরিমাণও উল্কার গতিতে বৃদ্ধি পায়। ঐ বছর তার সম্পদমূল্য ছিল ৮৯০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে এসে দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে এসে তিনি ভারতের আরেক শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানীকে ছাড়িয়ে যান। এ সময় তার সম্পদমূল্য ছিল ৮ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার। তিন বছরের ব্যবধানে তার সম্পদ প্রায় দশ গুণ বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই তার নাটকীয় উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং পৃষ্ঠপোষকতা লাভ তাকে ভারতের শীর্ষ ধনীতে পরিণত করে।

নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন বলা হয়েছিল ব্যবসায়ীরা তাকে ব্যাপক অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এমনও কথা উঠে, মোদি ব্যবসায়ীদের কাঁধে ভর করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা যেমন পায়, তেমনি তিনিও তাদের কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ভারতের শিল্পপতিদের মধ্যে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে কেউ কেউ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলেন মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের গৌতম আদানি। বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির সাথে তার ঘনিষ্টতা সবচেয়ে বেশি বলে বলা হয়। এ কারণে সকল সুবিধা পেয়ে অত্যন্ত দ্রুত আদানি শীর্ষ ধনী হয়ে উঠেন। শুধু শীর্ষ ধনীই নন, ভারতের ক্ষমতাশালীদের একজনে পরিণত হন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, গৌতম আদানি ভারতের অন্যতম ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গৌতম আদানির ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তারা বলছেন, আমাদের দেশেও এ ধরনের প্রবণতা রয়েছে। সরকারের সাথে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্টতা ও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। সরকার যেমন তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তেমিন ব্যবসায়ীরাও সুবিধা পেয়ে সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, বর্তমান সংসদের এমপিদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী। রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের ঘনিষ্টতার বিষয়। এতে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। অর্থনীতির উন্নতী ও অগ্রগতির যে পরিসংখ্যান দেয়া হয় এবং যে বিভ্রান্তি থাকে, তাতে এই ব্যবসায়ী শ্রেণীর ভূমিকা রয়েছে। ফলে সরকারের দেয়া অর্থনীতির পরিসংখ্যানের সাথে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। সরকারের সাথে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ভালো থাকা দোষের কিছু নয়, তবে দোষের হয় তখনই যখন সরকার এবং ব্যবসায়ী শ্রেণী একাকার হয়ে পড়ে। তার অন্যতম নজির ভারতের গৌতম আদানি। অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া এবং অনৈতিক কারসাজির কারণে তার যেমন উত্থান ঘটেছে, একই কারণে ভারতের অর্থনীতিকেও মন্দাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ, গৌতম আদানি শিল্প গোষ্ঠীর সংস্থা আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে। গত শুক্রবার টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় জানায়, ঝাড়খ-ের গোড্ডায় নির্মিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ২০১৮ সালে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ব্যবহৃত কয়লার দাম পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। চুক্তিতে আদানি গ্রুপ কয়লার দাম অনেক বেশি উল্লেখ করেছে। এখন আদানি গ্রুপের পতনের ফলে চুক্তি সংশোধন করতে চাইছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কয়লার উল্লেখিত দাম (প্রতি মেট্রিক টন ৪০০ মার্কিন ডলার) অনেক বেশি। অথচ প্রতি মেট্রিক টন কয়লার ২৫০ ডলারের নিচে হওয়া উচিৎ। চুক্তি সংশোধনের জন্য এরই মধ্যে ভারতীয় কো¤পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের অন্যান্য শিল্প গোষ্ঠীর সঙ্গেও বাংলাদেশের ব্যবসায়িক চুক্তি রয়েছে। আদানি গ্রুপের পতনের কারণে এ রকম চুক্তির ক্ষেত্রে একধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

সরকার যদি গুটিকয় ব্যবসায়ীর পৃষ্ঠপোষক হয় এবং সেসব ব্যবসায়ী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। মোদি আদানি কিংবা মোদি-আম্বানির সংযোগ এবং তার শোচনীয় পরিনতি, সেটাই প্রমাণ করে। মোদির সাথে আদানির ঘনিষ্টতা নিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ করে আসছেন। আদানির উত্থান ও আম্বানির পেছনে মোদির পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে বলে বারবার বলছেন। মোদি সরকারকে ‘আদানি-আম্বানি’ সরকার বলেও অভিহিত করেন তিনি, যা একটি দেশের জন্য মোটেও সম্মানজনক নয়। আমাদের দেশেও সরকারের সাথে গুটিকয় ব্যবসায়ীর অনুরূপ সম্পর্কের কথা কথা শোনা যায়। বলা বাহুল্য, ভারতের নজির ও ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সতর্ক হওয়ার তাকিদ দেয়। অন্যদিকে, ভারতের মোদি বা বিজেপি সমর্থক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক, চুক্তি, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সাবধান হওয়া জরুরি। আজ আদানির কারণে বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারী বিপন্ন। ভারতের অর্থনীতির অবস্থাও অবনতিশীল, ঝুকিপূর্ণ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন