Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অতিথি পাখি ও পরিবেশ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৭ এএম

শীতকালে প্রতি বছর বহু পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে আসে। অত্যন্ত শীত প্রধান দেশ, যেমন সাইবেরিয়া কিংবা উত্তর বা মধ্য তিব্বত থেকে এই পাখিগুলো আমাদের এখানে শীতের তিন-চার মাস কাটিয়ে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়। এদের মধ্যে নানা প্রজাতির পাখি আছে। পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যও আছে তাদের। পরিযায়ী পাখিরা কয়েক হাজার কিলোমিটার উড়ে এদেশে আসে।
সাধারণভাবে পাখিগুলো হিমালয়ের উঁচু শৃঙ্গগুলোকে পাশ কাটিয়ে পর্বতশ্রেণির ফাঁক দিয়ে, বেশ কিছুটা নিচু দিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়ে এদেশে এসে পৌঁছায়। বেশিরভাগ প্রজাতির পাখি বিশ্রাম ও খাদ্যের জন্য কোনো কোনো বনাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ব্যতিক্রম কেবল মাত্র একটি প্রজাতির ক্ষেত্রে। এই ব্যতিক্রমী প্রজাতির পাখিগুলো হিমালয়ের উঁচু উঁচু শৃঙ্গের উপর দিয়ে একটানা কয়েক হাজার কিলোমিটার উড়ে আসে। এই প্রজাতির পাখির মাথায় দুটি চওড়া কালো দাগের স্পষ্ট পটি আছে। আর দেখতে অনেকটা আমাদের পরিচিত দেশি পাতিহাঁসের মতো। তবে বেশ কিছুটা বড় মাপের। এই পাখি রাজার মতো আয়েশি তো নয় মোটেই বরং অত্যন্ত কষ্ট-সহিষ্ণু ও পরিশ্রমী। কিন্তু এদের বিশেষ কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে বলেই এদের রাজসম্মান দিয়ে হংসরাজ নামকরণ করা যায়। অতীত বাংলা সাহিত্যে ‘হংস’ নামের যে পাখির কথা উল্লেখ আছে তার আকৃতি ও সৌন্দর্যের যে বিবরণ পাওয়া যায় তার সাথে এই পাখির বাস্তবে মিল আছে প্রচুর। তীব্র তুষারপাত আর ঠান্ডা এড়াতে এই পরিযায়ী পাখি উত্তর ও মধ্য তিব্বতের পাহাড়ি মালভূমি অঞ্চল থেকে আমাদের দেশে প্রতি বছর শীতের শুরুতেই চলে আসে । তিন-চার মাস পর যখন ওই পাহাড়ি মালভূমি অঞ্চলে বরফ গলতে থাকে তখন মালভূমির মাটিতে বা পাহাড়ের খাঁদে যেসব প্রাকৃতিক জলাশয় আছে তার আশেপাশে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। বাচ্চা জন্মের পর অল্প কয়েক মাসেই তারা ওড়ার যথেষ্ট সামর্থ্য পেয়ে যায়। আবার শীতে ওইসব পাহাড় অতিক্রম করে গরমের সন্ধানে দক্ষিণের দিকে উড়তে থাকে। এভাবেই চলে এই হংসরাজের জীবনচক্র।
অত উঁচুতে ওড়ার অনেক সমস্যা আছে। প্রথমত, বায়ুর ঘনত্ব অত্যন্ত কম, নিজেকে ডানার সাহায্যে ভাসিয়ে উড়তে থাকা দারুণ কষ্টকর। দ্বিতীয়ত, বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ অত্যন্ত কম, ফলে উড়তে থাকার পরিশ্রমের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সরবরাহ যথেষ্ট নয়। তৃতীয়ত, উষ্ণতা অত্যন্ত কম, শূন্য ডিগ্রি থেকে অনেক নিচে। ঐ উষ্ণতায় কাঁচা মাংস রাখলে জমে শক্ত পাথরের মতো হয়ে যায়, রক্ত জমে কঠিন হয়ে যায়, চতুর্থত, ঐ উচ্চতায় তীব্র বায়ু প্রবাহের বেগ। বায়ু প্রবাহের ঐ তীব্র বেগের অভিমুখ সব সময় এক থাকে না। এইসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই একটানা উড়ে প্রতি বছর একই উচ্চতা অতিক্রম করে একই পথে বংশানুক্রমে আসা যাওয়া করে হংসরাজরা। ওদের হৃৎপিন্ডের ও ফুসফুসের গঠনের এবং কার্যপদ্ধতিতে অনেকটা পার্থক্য আছে। ওদের হৃৎপিন্ডের গতি পরিবর্তনের ক্ষমতা অনেক বেশি। যখন মাটির কাছাকাছি থাকে তখন হৃৎপিন্ডের গতি অনেক কম থাকে, আর খুব উঁচু দিয়ে ওড়ার সময় হৃৎপিন্ডের ও ফুসফুসের সক্রিয়তা বেশি হয়ে যায়। ওই হংসরাজের ফুসফুসের আশেপাশে কিছু বায়ু ভরা যায় এমন ছোট ছোট থলি আছে। অনেক ওপরে ওড়ার সময়, সেখানে বায়ুর ঘনত্ব খুব কম, ফলে বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম থাকে। আবার এই উচ্চতার কম ঘনত্বের বায়ুতে নিজেকে ভাসিয়ে রাখার জন্য পাখিকে দ্রুত পাখা নাড়ার প্রয়োজন হয় আর তার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। তাই ঐ উচ্চতায় খুব জোরে জোরে প্রশ্বাস নিতে এবং নিশ্বাস ত্যাগ করতে হয়। প্রত্যেক প্রশ্বাসে যতটা বায়ু শরীরে প্রবেশ করে তার অর্ধেকের মতো বায়ু ওই ছোট ছোট থলিতে ভরে যায়। বাকি অর্ধেক ফুসফুসের রক্তের সংস্পর্শে আসে। ওই অংশের বায়ুতে থাকা অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যায়, আবার সেই রক্ত ফিরে আসার সময়ের মধ্যে ওইসব থলি থেকে বাকি অর্ধেক বায়ু ফুসফুসে চলে আসে। রক্ত ওই বায়ু থেকে অক্সিজেন নিয়ে আবার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যায়। প্রত্যেক প্রশ্বাস ও নিশ্বাসের সময়কালের মধ্যে আমাদের ও অন্য পশু-পাখির শরীরে রক্তের একবার বা তারও অনেক কম সঞ্চালন হলেও এই হংসরাজদের শরীরে দুবার সঞ্চালন হয়। এর ফলে প্রশ্বাসের সময় বায়ুর সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করা অক্সিজেনের সবটাই শরীরে শোষিত হয়, কোনো অপচয় হয় না। কিন্তু দ্রুত প্রশ্বাস-নিশ্বাসের সময় তার দ্বিগুণ দ্রুত বেগে হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসকে কাজ করতে হয়। অর্থাৎ হংসরাজের ডানা, হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসের কর্মক্ষমতা যে-কোনো অপর সম জাতীয় প্রাণীর থেকে কয়েকগুণ বেশি। আবার যত উঁচুতে উঠতে থাকে তত এই থলিগুলোতে বায়ুর পরিমাণ বেশি হতে থাকে ফলে শরীরের আয়তন বৃদ্ধি পায় আর ভেসে থাকার কিছুটা সহায়তা হয়।
হংসরাজের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এদের রক্তের হিমোগ্লোবিনের গঠন ও চরিত্র অন্য যে-কোনো লাল রক্তের প্রাণীদের থেকে পৃথক। এদের হিমোগ্লোবিনের ফুসফুস থেকে অক্সিজেন শোষণ ক্ষমতা ও শরীরের বিভিন্ন অংশের কলা ও কোষে তা পৌঁছে দেওয়ার দক্ষতা অনেক বেশি। চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো, ঐ উচ্চতায় ভেসে থাকা আর ওখানকার তীব্র বায়ু প্রবাহের মাঝে নিজের গতি নিয়ন্ত্রণে রেখে ঠিক অভিমুখ বজায় রেখে উড়তে থাকা, প্রচন্ড পরিশ্রমের কাজ। একটানা ওই পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়ার ফলে শরীরে যে তাপ উৎপন্ন হয় তার ফলেই ওই ২৫,০০০ ফুটের থেকেও বেশি উচ্চতায় প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও হংসরাজরা বেঁচে থাকতে পারে। নয়তো ওই উচ্চতায় উঠে দুই মিনিট বিশ্রাম নিতে গেলেই জমাট বাঁধা একখন্ড মাংসপিন্ডে পরিণত হয়ে যেত। তাই নিরবচ্ছিন্ন উড়ে চলাই ওদের অভ্যাস।
এ রকম অসাধারণ শারীরিক সক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ গঠন আর অভ্যাস আমাদের এই পরিযায়ী অতিথিদের অপর যে-কোনো প্রজাতির থেকে বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে। শীতের সময় এইসব হংসরাজের বাংলাদেশের এবং উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে বড় জলাশয়ে দেখা যায়। মানুষের লোভে অধিক শিকার আর পরিবেশ দূষণ ও উষ্ণায়ন দ্রুত এই প্রজাতির সংখ্যা হ্রাসের কারণ। মানুষকেই উদ্যোগ নিতে হবে এদের রক্ষা করার।
আমাদের দেশে প্রতি বছরই আমরা লক্ষ করে থাকি কিছু অসৎ প্রকৃতির লোক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজসে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে আগত এসব পাখি শিকার করে খোলা বাজারে বিক্রয় করে থাকে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে অন্যদিকে নিষ্পাপ এসব পাখি শিকার করে প্রচলিত আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেমন সরকারের কঠোর হওয়া প্রয়োজন অন্যদিকে সাধারণ মানুষদের মধ্যে সচেতনতাও সৃষ্টি করা আবশ্যক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় স্বর্ণপদক (১ম)পুরস্কার প্রাপ্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
function like(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "clike_"+cid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_like.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function dislike(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "cdislike_"+cid; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_dislike.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rlike(rid) { //alert(rid); var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rlike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_like.php?rid="+rid; //alert(url); xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rdislike(rid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rdislike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_dislike.php?rid="+rid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function nclike(nid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "nlike"; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com//api/insert_news_comment_like.php?nid="+nid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } $("#ar_news_content img").each(function() { var imageCaption = $(this).attr("alt"); if (imageCaption != '') { var imgWidth = $(this).width(); var imgHeight = $(this).height(); var position = $(this).position(); var positionTop = (position.top + imgHeight - 26) /*$("" + imageCaption + "").css({ "position": "absolute", "top": positionTop + "px", "left": "0", "width": imgWidth + "px" }).insertAfter(this); */ $("" + imageCaption + "").css({ "margin-bottom": "10px" }).insertAfter(this); } }); -->