Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পারিবারিক বন্ধন, অনুশাসন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

পরিবার হচ্ছে মানব সভ্যতার আদি সংগঠন। পরিবার থেকেই গড়ে উঠে সমাজ। সুন্দর ও সুস্থ সমাজের জন্য আদর্শ পরিবার অপরিহার্য। পারিবারিক বন্ধন আমাদের গর্ব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পারিবারিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুশিক্ষার যে শক্ত ভিত দাঁড় করিয়েছে তার উপরই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পরিবারের মঙ্গলের জন্য পুরোজীব নিবেদিত করেছিলেন আমাদের মা-বাবা, তাদের মা-বাবা এবং তার পূর্ববর্তী বংশধরও। সময়ের পরিক্রমায় এই বন্ধন আজ হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বায়ন ও নগরায়নের ফলে দিন দিন দুর্বল হচ্ছে স্থিতিশীল সমাজ গঠনের নিয়ামক এই পারিবারিক বন্ধন। ভেঙ্গে যাচ্ছে পরিবারের আদর্শ, মূল্যবোধ, আর স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন। বাংলাদেশে এক সময়ে পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের সদস্যদের পরস্পর স্নেহ-মমতার যে দৃঢ়তা ছিল, তা যেন আজ ম্রিয়মান। যার কারণে পারিবারিক মূল্যবোধ তথা ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। পারিবারিক বন্ধনের শীতলতা ব্যক্তিজীবনে অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে।

আমরা অনেক সময় বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর শাসনের বাইরে গিয়ে যে স্বাধীনতার কথা বলি, তা হচ্ছে সন্তানকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়া। পারিবারিক অনুশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন সন্তান নেশাগ্রস্ত কিংবা যে কোন খারাপ অভ্যাসে আসক্ত হয়ে বিপথগামী হয়। একজন মানব সন্তান পারিবারিক শিক্ষা ব্যতীত কখনো আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। মানবজাতির বিকাশ, সভ্যতার সৃষ্টি, সংস্কৃতিবোধের উন্মেষ সবকিছুর মূলে আমাদের পারিবারিক সুশিক্ষা আর দৃঢ় বন্ধন। যে জাতির পারিবারিক বন্ধন যত দৃঢ়, সে জাতি তত সুশৃঙ্খল ও উন্নত মানসিকতার।

পাশ্চাত্যের দেশে দেশে আজ পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে, অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে জঙ্গীবাদের মতো ভয়ানক রাস্তায় ধাবিত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, তাদের পারিবারিক বন্ধন নেই, যে যার মতো চলাফেরা বা জীবন অতিবাহিত করে। কেই কাউকে পরোয়া করে না। যৌথ পরিবারগুলোতে দেখা যায় দাদা-দাদী, চাচা-চাচী কিংবা মা-বাবার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে থাকার কারণে সন্তানের ভালো-মন্দ তদারকি করতে পারেন এবং সন্তানের মনেও কোন খারাপ বাসনা সহজে বাসা বাঁধতে পারে না। পারিবারিক বন্ধনের সাথে সাথে একজন ব্যক্তির সাথে সমাজের বন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক বন্ধন যতই দুর্বল হয়, সমাজে ততই বিশৃংখলা বা অশান্তি বাড়তে থাকে। ব্যক্তির সাথে সমাজের বন্ধন যত দৃঢ় থাকবে সামাজিক অনাচার তত কম হবে। সামাজিক বন্ধন যুগ যুগ ধরে আমাদেরকে সুন্দরের পথে প্রেরণা যুগিয়েছে এবং অসুন্দরের পথ থেকে নিরুৎসাহিত করেছে। সামাজিক এই বন্ধনের শিক্ষা কিন্তু পরিবার থেকেই পেয়ে থাকি। সামাজিক বৈষম্য, ব্যবিচার, মাদকাসক্তি, জঙ্গীবাদসহ সকল প্রকার অপরাধমূলক কর্মকা- থেকে মুক্তি পেতে হলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। বন্ধন দৃঢ় হলে জবাবদিহিতা চলে আসে। যেখানে জবাবদিহিতা থাকে সেখানে অপরাধ প্রবণতা কম থাকে। সামাজিক সম্পর্কহীন বা কম সম্পর্কযুক্ত মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ বা বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। তাই, নিজেকে ভালো রাখার তাগিদেই আমাদের উচিত পরিবার তথা সমাজ থেকে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না করা। সমকালীন সমাজ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্ক অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। একটা সময় ছিল শিশুরা যৌথ পারিবারিক পরিবেশে দাদা-দাদী, চাচা-চাচী ও চাচাত ভাই-বোনের মাঝে বড় হতো। এখন তা একেবারেই কমে গেছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অপব্যবহারের ফলে শিশুরাও এখন খেলছে মোবাইলসহ নানান রকম ডিভাইসের সাথে। পরিবারের ভেতরে একই ঘরে বসবাস করেও যেন সকলে আলাদা। যে যার মতো ব্যস্ত মোবাইলে। বর্তমান প্রজন্ম শিশুকাল থেকেই পরিচিত হয়ে উঠছে নানা ধরনের প্রযুক্তির সাথে এবং একসময় তারা তাতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ নানা ধরনের যন্ত্রের সহজলভ্যতা এবং অপব্যবহারের ফলে নতুন প্রজন্ম পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে তেমন মিশতে পছন্দ করে না। একঘেঁয়েমির এক রোবোটিক জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অথচ পারিবারিক বন্ধন আর শিক্ষা থেকেই সামাজিক বন্ধন, সহমর্মীতা, ন্যায়নিষ্ঠা, আদব-কায়দা, জবাবদিহিতার শিক্ষা পাওয়া যায়।

বর্তমানে বিভিন্ন কারণে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে ক্ষুদ্র পরিবার বা একক পরিবারে রূপান্তরিক হচ্ছে। ক্ষুদ্র বা একক পরিবারের সন্তানরা ক্ষুদ্র জগতের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে। পরিবার বিমুখিতা তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে এবং ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে চিরায়িত সামাজিক বন্ধনও। জীবন-জীবিকার তাগিদে তরুণ-তরুণীরা পরিবার তথা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। জীবনের দীর্ঘসময় বিদেশে থাকার কারণে পরিবারের সাথে তাদের দূরত্ব বাড়ছে। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হলেও পারিবারিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো থেকে যাচ্ছে তাদের অজানা। অথচ পারিবারিক বন্ধন আমাদের মাঝে স্থিতিশীলতার বোধ এবং আত্মিক প্রশান্তি আনয়ন করে। পারিবারিক সম্পর্ক মানুষকে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী দুঃখ-কষ্ট থেকে আশ্রয় দেয় এবং নতুন প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে কার্যকর সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দৃঢ় পারিবরিক সম্পর্ক ও অনুশাসন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক বিকাশ, সুখ এবং সাফল্যের পথ নির্দেশক। বর্তমান বিশ্ব সহিংসতা, ক্রোধ আর উদাসীনতায় পরিপূর্ণ। অপরদিকে, উন্মুক্ত সংস্কৃতির বদৌলতে আজ দেশি-বিদেশী বিভিন্ন চ্যানেল ও মিডিয়াতে নাটক বা সিনেমাগুলোতে পারিবারিক বন্ধন বা মূল্যবোধের বিষয়ের চাইতে পারিবারিক কলহের বিষয়গুলোই দেখানো হয় বেশি, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবার ও সমাজ তথা নতুন প্রজন্মের মন-মগজে। তাই আমাদের সকলের উচিত পারিবারিক শান্তি ও সম্প্রীতির মূল্যবোধকে ফিরিয়ে এনে নতুন প্রজন্মের সাথে পরিবার ও সমাজের বন্ধনকে আরো দৃঢ় ও মজবুত করা। একটি সুস্থ, আদর্শিক এবং নৈতিকবোধ সম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও অনুশাসনের বিকল্প নেই।


লেখক: প্রাবন্ধিক। সউদী প্রবাসী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন