পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া স্বাভাবিক। এ ঋণ দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প ও উন্নয়নমূলক কাজ করাই মূল লক্ষ্য। ঋণ গ্রহীতা দেশ সাধারণত প্রাপ্ত ঋণ দিয়ে নিজেদের মতো করেই উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করে। এক্ষেত্রে ঋণদাতা দেশ খুব একটা হস্তক্ষেপ করে না। ব্যতিক্রম শুধু ভারত। ভারতের কাছ থেকে আমাদের ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও দেশটি অনেকটা যেচে আমাদের ঋণ দিচ্ছে। বন্ধুত্বের খাতিরে আমরাও সেই ঋণ নিচ্ছি। এতে আমাদের লাভের পরিবর্তে ক্ষতির পরিমাণটাই বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে ঋণের সুদসহ ভারত তার ষোল আনাই উসুল করে নিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাস্তা-ঘাট, বন্দর ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ভারত যে ঋণ দিচ্ছে, তা তার স্বার্থেই করছে। ফলে ভারতের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ঋণ দেয়ার নামে ভারত তিন ধরনের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। প্রথমত, সে ১ শতাংশ সুদ পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শর্ত অনুযায়ী এ ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার পণ্য ভারত থেকে কিনতে হচ্ছে। এতে ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। তৃতীয়ত, বেশির ভাগ প্রকল্পই আঞ্চলিক যোগাযোগ সংক্রান্ত। অর্থাৎ এ যোগাযোগের মাধ্যমে স্বল্প সময় ও খরচে ভারতের এক রাজ্যের পণ্য আরেক রাজ্যে সহজে পৌঁছে দেয়ার সুবিধা পাবে। এতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকৃত লাভ বলতে কিছু নেই। যেসব প্রকল্প ও উন্নয়নমূলক কাজে ঋণ নেয়া হচ্ছে, তা অনেক সহজ শর্তে বিশ্বের অন্য দেশ ও দাতা সংস্থা থেকেই পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে কেবল ভারতকে সুবিধা দেয়ার জন্যই একের পর এক ঋণ নেয়া হচ্ছে।
ভারত বরাবরই বন্ধুত্বের নামে তার স্বার্থের পুরোটাই বাংলাদেশ থেকে আদায় করে নেয় এবং নিচ্ছে। বিনিময়ে বাংলাদেশকে কিছুই দেয় না। বিগত কয়েক বছরে তার দীর্ঘদিনের যত স্বার্থ অবাস্তবায়িত ছিল, তার প্রায় প্রত্যেকটি আদায় করে নিয়েছে। পাশাপাশি আরো স্বার্থ আদায় করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সে ট্রানজিটের নামে করিডোর আদায়, নামমাত্র শুল্কে বাংলাদেশের সড়ক ও বন্দর ব্যবহার করে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যোগাযোগ স্থাপন ও পণ্য পরিবহন এবং মানবিক কারণ দেখিয়ে বিনা শুল্কে খাদ্যপণ্য পরিবহন সুবিধা একতরফাভাবেই নিয়েছে। ভারতের সাথে যদি আমাদের প্রাপ্তির হিসাবটি বিচার করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এ পর্যন্ত ভারত আমাদের তো কোনো কিছু দেয়ইনি, এমনকি ন্যায্য দাবির একটিও পূরণ করেনি। ভারতের সাথে লেনদেনের সবচেয়ে বড় যে ইস্যু পানির ন্যায্য হিস্যা, তার কোনো কূলকিনারা আজ পর্যন্ত হয়নি। আমরা কেবল তার কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছি। দেবো-দিচ্ছির আশ্বাস দিয়ে সে আমাদের কাছ থেকে তার স্বার্থের সব আদায় করে নিচ্ছে। একটি আদায় করার পর আরেকটি দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই যে ঋণ দিচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে ভারত আমাদের অনেক সহায়তা করছে। আসলে এর পেছনে যে তার ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য রয়েছে, এটি আমাদের সরকারও স্পষ্ট করে কিছু বলছে না, ভারতের বলার তো কোনো কারণই নেই। ভারতের এই আচরণকে অনেকটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়াদের মতো। যারা আমাদের পুঁজি দিয়েই মুফতে ব্যবসা করে গিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভারত ইস্ট ইন্ডিয়ার এই নীতি আমাদের ওপর প্রয়োগ করছে। ঋণ দিচ্ছে, সুদ নিচ্ছে আবার প্রকল্পের যত মালসামানা বা পণ্যের শতকরা ৬৫ ভাগ তার কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ৭৫ শতাংশও তার কাছ থেকে কিনে নিতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ঋণ দিয়ে যেসব রাস্তা-ঘাট নির্মিত হবে, তার ওপর দিয়ে তারই পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করবে। অর্থাৎ ভারত গাছেরটাও খাচ্ছে, নিচেরটাও কুড়িয়ে নিচ্ছে। কিছুই বাকি রাখছে না। অথচ সরল অর্থে ঋণের হিসাব হওয়ার কথা ঋণদাতা তার প্রদেয় ঋণের সুদ পাবে, এর বেশি কিছু নয়। ঋণ আমরা কিভাবে ব্যবহার করব, তা আমাদের ব্যাপার। দেখা যাচ্ছে, ভারত সুদের বিনিময়ে ঋণ দিচ্ছে, আবার প্রকল্পের পণ্যও তার কাছ থেকে কেনার শর্ত দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এর ওপর সরবরাহকৃত পণ্যের মান যাচাইয়েরও কোনো সুযোগ নেই। সে ভালো বা মন্দ পণ্য দিলো কি না, তা চেক করার সুযোগ থাকছে না। এ ধরনের একতরফা ঋণসুবিধা পৃথিবীর কোনো আত্মমর্যাদাশীল দেশ নেয় কি না, আমাদের জানা নেই। অর্থনীতিবিদরা ভারতের এ ঋণকে বলছেন ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’। সুদ এখানে বিষয় নয়। কম সুদ দেখানো হয় ঋণগ্রহীতাকে আকৃষ্ট করার জন্য। অর্থাৎ ভারত আমাদের কম সুদে ঋণ দিয়ে তার সব শর্তের মধ্য দিয়ে বৃহৎ স্বার্থ উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের ঋণ একেবারে না নিলেই নয়, এ রকম পরিস্থিতি ছাড়া যত কম নেয়া যায়, ততই ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, ভারত যেখানে নিজেই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার অর্থই হচ্ছে, তার ব্যবসা চালানো এবং প্রভাব বিস্তার করা।
ভারত তার নিত্যনতুন কৌশল নিয়ে বাংলাদেশে তার স্বার্থ আদায় ও প্রভাব বিস্তারের এক ধরনের মিশন নিয়ে নেমেছে। ঋণ দেয়ার নামে ব্যবসা করাও তার এই মিশনের অংশ। অথচ বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা হয়ে থাকা পানির ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে সে কোনো টুঁ-শব্দ করছে না। বিভিন্ন ছুঁতো ও টালবাহানা করে এড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না। বাংলাদেশের পণ্য তার বাজারে ঢুকতে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে বসে থাকে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে তার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সরকারও বন্ধুত্বের কথা বলে তা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছে। এমনকি ভারত যেভাবে শর্ত দেয়, সেভাবেই মেনে নেয়। এটা বন্ধুত্বের নামে অনেকটা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া কিছু নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয় দিক থেকে সমান আচরণ কাম্য হলেও, ভারতের ক্ষেত্রে তা একতরফা হয়ে যাচ্ছে। ভারতও এ সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে। আমরা মনে করি, ভারত ঋণ দেয়ার নামে যে ব্যবসা করে চলেছে, তা আর বৃদ্ধি করা উচিত নয়। এ ধরনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেয়া সঠিক হবে না। বাংলাদেশকে সহজ শর্তে ও বিনা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া ঋণ দেয়ার মতো অনেক দেশ ও দাতা সংস্থা রয়েছে। ঋণ নিতে হলে তাদের কাছ থেকেই নেয়া উচিত। বিষয়টি উপলব্ধি করে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।