Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসরাইলি আগ্রাসন ও নির্যাতন আর কতদিন ধরে চলবে?

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৫ এএম

ফিলিস্তিনিদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ইসরাইলের প্রতি বিশ্বের অন্তত ৯০টি দেশ একযোগে আহ্বান জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখ-ে ইসরাইলের দখলদারির বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় একটি প্রস্তাব পাস হয়। পরে গত ৬ জানুয়ারি প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিকসহ একাধিক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় ইসরাইল। জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতকে (আইসিজে) ইসরাইলি দখলদারির বিষয়ে একটি সুপারিশ প্রস্তাব দিতে গত ১৬ জানুয়ারি এক বৈঠক বসে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য দেশগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে ইসরাইলের প্রতি ওই বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।

ইউক্রেন নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন মাতামাতির অন্ত নাই। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লংঘন করছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে বিশ্বের মানবতাবোধ আর বিবেক কোথায়? পৃথিবীর কত দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো হয়। ফিলিস্তিনে কেনো শান্তিরক্ষি বাহিনী পাঠানো হয় না? ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে। ফিলিস্তিনিদের জমি দখল ও হত্যা দুটিই ইসরাইলিদের কাছে ডাল-ভাত। এ বিষয়ে বিশ্ব বিবেক নিশ্চুপ। গাজা কার্যত এক ছাদখোলা কারাগার। ফিলিস্তিনিরা মুসলিম, তাদের উপর অত্যাচার আর তাদের ভূমি জবরদখল করছে এমন একটি পক্ষ, যার উগ্রবাদ স্পষ্ট দৃশ্যমান হলেও কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই! ফিলিস্তিনে মানবতার বিপর্যয় ও গণহত্যা আধুনিক সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ী সংকট। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইসরাইলের দাবনীয় শক্তির কাছে সবাই যেন নতি স্বীকার করেছে।

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ২০২২ সালে ১৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনের নাগরিক ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত হয়েছে, যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ জনের বেশি ছিল শিশু। এ সময়ে ইসরাইলের হামলায় আহত হয়েছে কমপক্ষে ৯ হাজার ফিলিস্তিনি। সম্প্রতি ইসরাইলের নতুন সরকার গঠনের পরপরই জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী বেন গভির পবিত্র আল আকসা মসজিদ পরিদর্শন করায় অত্যন্ত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা স্থানীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকা- মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তিপ্রক্রিয়াকে আরও দূরে ঠেলে দেবে।

এএফপি জানায়, পশ্চিম তীরে চলতি মাসে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রায় ২০ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গত ২০২১ বছরের ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত ইসরাইলের হামলায় ৬৬ জন শিশুসহ ২৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। ছয়শ’ শিশু ও চারশ’ নারীসহ দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিল। সে হামলায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ছিল গুরুতর। সে সময় ২০০০ ভবন ধ্বংস হয়েছিল। ৮ লাখ মানুষ পানি সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বারবার এ ধরনের হামলার কারণে ইতিপূর্বে আয়ারল্যান্ড ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে রাষ্ট্রটিকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া বিশ্বের ৬০০ শিল্পী ইসরাইলে অনুষ্ঠান করা বয়কট করেছেন। ইসরাইলকে সাংস্কৃতিক ও একাডেমিকভাবে বর্জন করার ডাক দিয়ে ভারতের ‘ইন্ডিয়ান ক্যাম্পেইন ফর দ্য কালচারাল অ্যান্ড একাডেমিক বয়কট’ শীর্ষক যে প্রচারাভিযান জারি আছে, তার মূল কথা হলো, ইসরাইলের মতো একটি সহিংস দখলদার এবং বর্ণবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা গভীরভাবে অন্যায্য এবং নৈতিকতাবিরোধী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইল তার নিয়ন্ত্রণ করা অঞ্চলজুড়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদি আধিপত্য বজায় রাখার অভিপ্রায় জারি রেখেছে।’ বিদায়ী বছরে পশ্চিম তীরে ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর কর্মকা-ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক, কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থা। ইসরাইলের সেনাদের নিয়ে এর আগেও কথা তুলেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিএইচআর। তার অভিযোগ, ইসরাইলের সেনারা নিছক সন্দেহের বশে বা সতর্কতার জন্য ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এটা আন্তর্জাতিক নীতিমালার লঙ্ঘন।

মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল সব সময় সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণবাদী, সন্ত্রাসী, দখলদার ও দখলদার দেশের সহযোগী হয়ে দানবীয় শক্তি দেখিয়েছে। অতীতে ইহুদিদের খ্রিস্টানরা মেরেছে, নাতসিরা মেরেছে। ইংরেজ ও ব্রিটিশরা মেরেছে। ইউরোপ থেকে নির্বাসিত হয়েছে। এডলফ হিটলার প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি মারার পর তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেনÑ ‘আমি ইচ্ছা করলে সব ইহুদিদের মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কিছু রেখে দিলাম এ জন্য যে, পরবর্তী প্রজš§ যেন বুঝতে পারে ওরা কত জঘন্য, আর কেন আমি ইহুদি বিদ্বেষী ছিলাম’।

আমেরিকা-ইউরোপের সাহায্য ছাড়া সন্ত্রাসী ইসরাইল তার অবৈধ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। আমেরিকা-ইউরোপ ভালো করেই জানে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য লড়াইয়ে আরবদের কিছুই করতে পারেনি, তাই শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকে তাদের দাবার গুঁটি বানিয়ে খেলছে।

ইসরাইলের লক্ষ্য হামাসের প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তির পাশাপাশি হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবাননকে রাজপথে নামানো। একটিতেও তারা বিজয়ী হয়নি। বরং রাজনৈতিক ফ্রন্টেও তারা বারবার পরাজিত হয়েছে। সামরিক দিক থেকে হামাস পৃথিবীর অন্যতম সেরা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে শত বছর এগোনো, ইসরাইল ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো পরাশক্তির সমরযন্ত্রকে উড়িয়ে দিতে না পারলেও বহুবারই পিছু হটতে বাধ্য করেছে। শুধু তাই নয়, গাজায় হামলার পর ইসরাইলি সেনাদের মধ্যেও হতাশা লক্ষ করা গেছে! দেশটির চ্যানেল ১২-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক পাইলট স্বীকার করেছেন, ‘আমরা রকেট হামলা ঠেকানো ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে ধ্বংসে ব্যর্থ হয়ে তাদের ভবন ধ্বংস করে হতাশা মিটিয়েছি।’

নেতানিয়াহুকে গাজায় ভয়াবহভাবে নিপীড়ন, ৬৫টি শিশুসহ আড়াই শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে একদা মাথা নিচু করে বিদায় নিতে হয়েছিল। পদ হারানোর পর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরাইলকে কাঠগড়ায় দেখতে আরও বেশি আগ্রহী বলে দেখা যাচ্ছে।
ইসরাইলের ফিলিস্তিন ও আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্টকারী যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক কর্মকা- বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমের সঙ্গে ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে একটি সার্বভৌম ও কার্যকর রাষ্ট্রের জন্য ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার আদায়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ১০ জানুয়ারি জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) নির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ওআইসির স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বাংলাদেশের অভিমত ব্যক্ত করেন। সম্প্রতি জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে সংঘটিত ইসরাইলের উসকানিমূলক কর্মকা- এবং ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে এই সভা হয়।

ফিলিস্তিনে যা চলছে, তা কোনো নৈতিক আচরণবিধির মাপকাঠিতে ন্যায়সংগত হতে পারে না। ফিলিস্তিন মূলত একটি আরব দেশ এবং তাকে আরব দেশ হিসেবেই থাকতে দিতে হবে। গত মে মাসে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সেনাদের গুলি শরীরে লাগার পর উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন একজন নারী। নিথর শরীর। পরনে জ্যাকেট। তাতে লেখা ‘প্রেস’। বলছি আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের কথা। তাকে আর বাঁচানো যায়নি। শুধু সাংবাদিক শিরিন আকলেহই নন। দশকের পর দশক ধরে ইসরাইলি দখলদারদের শিকার হচ্ছে সর্বস্তরের ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ এমনকি গণমাধ্যমও। ২০২২ সালটাও ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা ছিল না। ইসরাইলের দখলদারি, অভিযান আর নৃশংসতায় এ বছরটিও ছিল তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। খোদ জাতিসংঘ বলেছে, ২০০৬ সালের পর সদ্য বিদায় নেয়া বছরটি ছিলো পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃস্বপ্নের।

ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বুকে অবৈধ ও বেআইনিভাবে গড়ে তোলা এক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ইসরাইল। ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখল এবং ফিলিস্তিনিদের গণহারে হত্যা ও উচ্ছেদের মাধ্যমে গড়ে তোলা এই রাষ্ট্র প্রথম দিন থেকেই সন্ত্রাসী আচরণ করে যাচ্ছে। কেবলমাত্র এই অবৈধ রাষ্ট্রের বিলোপ এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হতে পারে আরব-ইসরাইল সংকটের সমাধান। একটা সময় আসবে যখন অবৈধ দখলে সাধের বসতি ছেড়ে চোখের জল সঙ্গী করে চলে যেতে হবে ইহুদিদের। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতায় দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর নৃশংসতা ও আগ্রাসন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়ে চলেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নতুন বৈশ্বিক সংকট এবং অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখ-ের গুরুতর পরিস্থিতি থেকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ যাতে সরিয়ে না নেয়, সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন