Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুটিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যহানিকর

ডা: এম ফেরদৌস | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:২৪ এএম

সুন্দর ও আকর্ষণীয় ফিগারের জন্য মেদহীন স্বাস্থ্য থাকা পূর্বশর্ত। কারণ মেদবহুল স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়। স্থুলস্বাস্থ্য যেমন একদিকে দেখতে অসুন্দর তেমনি মেদবহুল স্বাস্থ্য বহু ধরনের রোগের সাথে সম্পৃক্ত। তাই মেদহীন স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ কিছু খাবারের নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত ব্যায়াম, মনের জোর ইত্যাদির প্রয়োজন। আজকের আলোচনায় আমরা কেন মোটা হই, মোটা হলে কি কি অসুবিধা হতে পারে, মোটা হওয়া থেকে কিভাবে পরত্রাণ পেতে পারি ইত্যাদির ওপর আলোকপাত করবো।

মোটা হওয়ার কারণ:
মোটা হওয়ার কারণ নির্ণয়ের পূর্বে আমাদেরকে জানতে হবে কাকে আমরা মোটা বলব, শরীরের ওজন কতটুকু হলে মোটার পর্যায়ে পড়ে। এ ব্যাপারে তথ্য হলো- শরীরের ওজনের শতকরা পঁচিশ ভাগ বেশি যদি চর্বি থাকে তাহলে আমরা নিদ্বিধায় তাকে মোটা বলতে পারি। কারণ শরীরের ওজনের দশভাগের নীচে কারো চর্বি থাকে না সে ছেলেই হউক আর মেয়েই হোক না কেন। তবে সবক্ষেত্রেই শরীরের বেশি ওজন শুধুমাত্র চর্বিও জন্যই হয় না। অনেকের শরীরের মাংসে বা পেশিতে ওজন বেশি থাকতে পারে। কারো বা শরীরের হাড় মোটা থাকে তার ফলেও ওজন বেশি হবে।

মেদবৃদ্ধির সঠিক কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে সারা বিশ্বে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু সঠিক কারণগুলোর ব্যাপারে বেশ মতভেদ রয়েছে। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, মেদবৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে

প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া। দেখা গেছে বেশিরভাগ স্থুল লোকের মেদবৃদ্ধির কারণ এটাই। কিন্তু আমরা কেন বেশি খাই? অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে কিন্তু এ প্রবণতা নেই। অন্যান্য প্রার্ণীদের মধ্যে নিজ থেকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা কৌশল কাজ করে যার ফলে দেখা যায় যে অন্যান্য প্রাণীরা যতটুকু তাদের ক্ষিদে থাকবে ততটুকুই খাবে অথবা যতটুকু খেতে পারবে বা খাবার ইচ্ছে হবে ততটুকুই খাবে, এর বেশি খাবে না। কিন্তু মানুষের বেলায় এসব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করে না। কারণ যতটুকু খাবার খেলে ক্ষুধা নিবৃত্তি হয় তার চেয়ে বেশি খাওয়ার প্রবণতা মানুষের মাঝে রয়েছে। বিশেষ করে ছোটবেলায় অনেকের অভ্যাস। আর অভ্যাস গড়ার পেছনে অনেক বাবা-মার অবদান রয়েছে। তারা মনে করেন সন্তান যত বেশি খাবে তত স্বাস্থ্য ভাল হবে। আর স্বাস্থ্য বলতে মোটাসোটা হওয়াটাই বুঝে থাকেন। আসলে স্বাস্থ্য হচ্ছে সুস্থ থাকা। কিন্তু অনেক বাবা-মা বেশিবেশি খাইয়ে তাদের সন্তানদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন এবং পরবর্তীতে বয়সকালেও এই প্রবণতা থেকে যায় এবং পরিণামে আর মোটা কমাবার উপায় থাকে না। তাছাড়া, শৈশবে কিছু কিছু মানসিক সমস্যার জন্যও বেশি খাওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে। যেমন দেখা গেছে, বাচ্চা কোন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না, যার কারণ হতে পারে পারিবারিক পরিস্থিতি, বাবা-মার অমিল ইত্যাদি, তখন বাচ্চারা তাদের অতিরিক্ত খাওয়ার মাঝে নিরাপত্তা খুঁজে বেড়ায়। তাছাড়া স্কুলে পড়াশোনায় হয়ত অন্যান্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে যেহেতু সবার আইকিউ বা বুদ্ধিস্তর এক নয় এবং এই পিছিয়ে পড়ার জন্য স্কুলে ও বাসায় উভয় জায়গায় তিরস্কৃত হচ্ছে ফলে সে তার উদ্বেগ দূর করতে যেয়ে বেশি খাওয়া শুরু করে। আবার মানসিক প্রতিবন্ধিরাও বেশি খেতে পারে, যেহেতু এটা বুঝতে পারে না যে কখন খাওয়া উচিত বা কখন খাওয়া উচিত নয়।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আমরা শরীরে হরমোন নিঃসরণকারী গ্রন্থিগুলোর কোন অসুখের কারণে মেদবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করতে পারি। এ সকল গ্রন্থির মধ্যে রয়েছে থাইরয়েড গøান্ডের হরমোন প্রয়োজনের তুলনায় কম নিঃসরণ। যাদের এই সমস্যা রয়েছে তাদের ওজন বাড়ার প্রবণতা রয়েছে।

অন্যান্য গ্রন্থি যেমন সুপ্রারেনাল গ্রন্থি, পিটুইটারী গ্রন্থি ইত্যাদির সমস্যা থাকলেও শরীর মোটা হওয়ার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। মেয়েরা অনেক সময় ওভারিতে ছোট ছোট টিউমার হলে, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে ইত্যাদি কারণেও মোটা হতে পারে।

অন্যান্য কারণের মধ্যে দেখা যায় যে, বয়স ভেদে মোটা হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। যেমন বয়ঃসন্ধিক্ষণে বাড়ন্ত ছেলেমেয়েরা বেশি খায় কিন্তু এসময় শরীর গড়নের জন্য অনেক ক্যালরিও খরচ করতে হয়। এই সময় নিঃসৃত হরমোন শরীরে চর্বি জমাতে সাহায্য করে কিন্তু এই সময়ে অতিরিক্ত ক্যালরি খরচের ফলে মেদ কমে যায়। কিন্তু যারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া করছেন তাদের শরীরে মেদ জমছে।
মেয়েদের বেলায় মধ্যবয়সে তাদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে শরীরের ইস্ট্রোজেন কম হয়ে যায়, ফলে ক্ষুধা বেড়ে যায় তাই অনেক মহিলাই মোটা হয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া এই সময় তারা নিজেদের শরীর নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। কাজকর্ম কমে যায় কিন্তু খাওয়া-দাওয়া কমে না। অনেকে মনে করেন আর শরীরটা ঠিক করে লাভ নেই। তাই অলসতা তাকে মোটা করে তোলে। তাছাড়া মহিলাদের জরায়ু ফেলে দেয়া অপারেশন করার পরেও অনেকে মোটা হয়ে যায়।

ব্যায়াম ও পরিশ্রম:
পরিমিত ব্যায়াম ও পরিশ্রম না করার কারণেও শরীরে মেদ জমতে পারে এবং এই সমস্যা যারা শহরে বাস করেন তাদের মধ্যেই দেখা যায়। কারণ গ্রামের মানুষেরা যেমন খান তেমন পরিশ্রমও করেন, তাই তাদের শরীরে তেমন মেদ জমতে পারে না, অনেক সময় দেখা যায় বিয়ের পরে মেয়েরা মুটিয়ে যাচ্ছে, এর কারণ হচ্ছে আত্মতৃপ্তি। বিয়ের পরে মেয়েরা প্রচুর খাওয়া-দাওয়া শুরু করেন এবং ঘুমও প্রচুর বেড়ে যায়। ফলে মুটিয়ে যাবার প্রবণতা দেখা দেয়। আবার বয়সকালে যাদের হাতে টাকা-পয়সা বেশ সঞ্চিত হয়, কর্ম জীবনে স্থিতি আসে, মন ও শরীর দুটোই ভাল থাকে, তাই এই সময় লোকে আয়েশী হয়ে পড়ে এবং মোটার প্রবণতা দেখা দেয়।

আরো কিছু কারণ:
১. যে সকল বাড়িতে রান্নাবান্না ভাল হয়ে থাকে সে বাড়ির সদস্যদের মোটা হওয়ার প্রবণতা থাকে। যাদের বাড়িতে মুখরোচক খাবার মজুদ থাকে, তাদের দেখা যায় ক্ষুধা না পেলেও মাঝে মধ্যেই ও সকল খাবার খাচ্ছেন।

২. যারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন তারা অবসাদ নিরসনকল্পে অতিরিক্ত খাওয়ার মাঝে বৈচিত্র খুঁজে পাচ্ছেন।

৩. সন্তান প্রসবের পরে মেয়েদের পেট একটু থলথলে হয়ে যায়। তখন আপাত মোটা মনে হতে পারে। যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ দিচ্ছেন তারা বেশি করে খাওয়া-দাওয়ার ফলে শরীরে মেদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে যাচ্ছেন।

৪. অপারেশনের পরেও অনেকে মোটা হয়ে পড়েন, এটাও অধিক যতœ নেয়া খাওয়ার ফলে। কিছু লোকের বংশগত কারণেও মোটা হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

মোটাদের সমস্যা:
মেদবৃদ্ধিতে যে সকল সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে, ডায়াবেটিক, বøাডপ্রেসার, করোনারি থ্রম্বোসিস, হার্টের অসুখ, মোটা মহিলাদের পিত্তথলিতে পাথর ইত্যাদি। যারা রোগা ছিলেন কিন্তু মধ্যবয়সে মোটা হওয়ার ফলে যৌনজীবনে যদিও তেমন সমস্যা হয় না, তবে বেশি মোটা হলে নড়াচড়া করতে অসুবিধা হতে পারে। কারণ যৌনক্রিয়া একটি উচ্চ ক্যালরির ব্যায়াম।
মোটা মহিলাদের বাচ্চা হওয়াকালীন সমস্যা হতে পারে তার মধ্যে হাই বøাডপ্রেসার ও ট্যাক্সিমিয়া ইত্যাদির আশংকা বিদ্যমান।

মোটা হওয়া থেকে পরিত্রাণের উপায়
এ জন্য প্রয়োজন বিশেষ কিছু খাবারের ডায়েটিং, ব্যায়াম ও মনের জোর। এর কোন একটার অভাব হলে বা সামঞ্জস্যের অভাব হলে উদ্দেশ্য সফল হবে না। প্রতিকারের জন্য নি¤œলিখিত ডায়েটিং- এর উপদেশগুলো মেনে চলতে পারেন।

ডায়েটিং-এর জন্য ১০ টি উপদেশ
১) খাদ্যে মাংসের পরিমাণ কমিয়ে দিবেন, দিনে একবারের বেশি নয়, বাকি সময় নিরামিষ খাবেন। মুরগির মাংস এদিক দিয়ে আদর্শ। গরু, ছাগলের মাংস কিনলে চর্বি কম দেখে কিনবেন। রান্না করলে ছোট ছোট টুকরো করে রান্না করবেন।
২) তেল কম দিয়ে রান্না করবেন। প্রয়োজনে রান্নায় ভুট্টার তেল বা সূর্যমুখীর তেল ব্যবহার করবেন।
৩) মাংস রান্নার আগে চর্বিগুলো বাদ দিবেন।
৪) কাঁচা ও সবুজ শাকসবজি বেশি করে খাবেন। সিম ও নানা রকমের ডাল খাবেন। সিদ্ধ করে খাবার চেষ্টা করবেন।

৫) দুধ ও দই খেতে হলে মাঠাতোলা খাবেন।
৬) যতটা সম্ভব খাবার বেক বা গ্রিল করে খাবেন।
৭) গরু ও খাসীর মাংসের পরিবর্তে মুরগী ও মাছ পছন্দ করুন।
৮) ভাত-রুটি কম খাবেন। ফলমূল বেশি খাবেন, পাউরুটি মাখন ছাড়া খাবেন, টোস্ট করে খেলে ভাল হয়।
৯) খাবার একবারে অনেকটা না খেয়ে বারে বারে কম করে খাবেন। কিন্তু বারে বারে যেন বেশি ক্যালরির খাবার খাওয়া না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। তবে শশা, সালাদ, ফলমূল হালকা লাঞ্চ বা ডিনার খাবার চেষ্টা করবেন।

১০) সপ্তাহে এক/দু’দিন রোজা রাখবেন। রোজার আগে সেহরী ও পরে ইফতারিতে আবার বেশি খাবেন না। নি¤œলিখিত অভ্যাসগুলো বর্জন করার চেষ্টা করবেন।

১০ টি খারাপ অভ্যাস:
১) ফাস্ট ফুড দোকানে যে সকল খাবার পাওয়া যায় এগুলো ক্ষুধা পেলে খাওয়া উচিত নয়। কারণ দোকানে যে সকল বার্গার, রোল ইত্যাদি পাওয়া যায় তা খেলে আরো মেদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
২) মাখন, ক্রিম, ক্রিমটিজ আইসক্রিম ক্রিমযুক্ত দুধ খাবেন না।
৩) সপ্তাহে দুটোর বেশি ডিম খাবেন না।
৪) অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার পেস্ট্রি কেক, সিঙ্গারা ইত্যাদি খাওয়া কমিয়ে দিবেন।
৫) ফলমূল ও আনাজ কাটার আগে ধুয়ে নিবেন। কাটার পর ধুলে পুষ্টি কমে যাবে।
৬) সকালে নাস্তা না খেয়ে এর পওে অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়।
৭) টিফিনের সময় কাজু বাদাম, ক্রিমযুক্ত বিস্কুট ইত্যাদি খাবেন না।
৮) আপনার জীবনযাত্রার সাথে মানানসই নয় এমন ডায়েটিং করবেন না।
৯) অনেকে ডায়েটিং শুরু করার দু’এক সপ্তাহের মধ্যে এমন মনে করেন, এখন কমে যাবে সেটা না দেখা পেলে হতাশ হয়ে পড়েন, ফলে ডায়েটিং করা ছেড়ে দেন। এটা ঠিক নয়, ধৈর্য ধরে ডায়েটিং করে যেতে হবে।
১০) পরিশেষে বলতে চাই ব্যক্তিবিশেষের শারীরিক অবস্থার উপর খাদ্য তালিকার রদবদল ঘটতে পারে যেমন : কারো দু’চার চামচ ভাত খেলেই ওজন বাড়ে, তাই তার উচিত ভাত না খেতে চেষ্টা করা। কারণ অঙ্কের হিসেবে হয়তো শরীর সব সময় চলে না।

ত্বক যৌন ও কসমেটিক বিশেষজ্ঞ
মোবাইল: ০১৯২০৭৮৯৮২৪

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন