Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা থেকে বের হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত শনিবার জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থা অন্য সংস্থার উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শুধু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, রাষ্ট্রের বিভাগগুলোও এ প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। তিনি আরো বলেছেন, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে তাদের মধ্যে এ আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা বেশি মাত্রায় প্রতীয়মান হয়। বিচার বিভাগ এ প্রতিযোগিতায় কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি এবং করবেও না। বরং আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি রাষ্ট্রের বিভাগ এবং  প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। শাসনতন্ত্র আমাদের উপর যতটুকু দায়িত্ব এবং ক্ষমতা অর্পণ করেছে আমরা ততটুকুই করব। আমরা আশা করব, রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানও বিচার বিভাগকে সেভাবেই সহযোগিতা করবে। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক সরকার পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করতে পারবে আর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না, এটা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা। গণতন্ত্রকে বিকশিত করার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুুল আমিন চৌধুরী বলেছেন, বিচার করলেই শুধু হবে না তা দৃশ্যমান হতে হবেÑ এ বিষয়টি ভুলে গেলে বিচার বিভাগ থাকবে না। একটা জামিন পেলে সঙ্গে সঙ্গে উপর আদালতে স্থগিত হয়ে যায়। এটা কেন? জামিন পাওয়া আসামীর অধিকার। পুলিশ বা অন্য কারো কথায় সেই অধিকার খর্ব করা যায় না। বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা বলেছেন, জনগণের শেষ ভরসাস্থল আদালত। বিচারকদের শতভাগ পক্ষপাতহীনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটালে সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মাঝে ভুল ধারণার সৃষ্টি হবে।
প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি যেসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন, সেগুলো সময়ের বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। রাষ্ট্রের এক সংস্থা যে অন্য সংস্থার উপর প্রভাব বিস্তারে লিপ্ত এবং সে কারণে যে গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে তা খোলাসা করে না বললেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল যেসব অভিযোগ ও বক্তব্য তুলে ধরছে তা মূলত এই প্রভাব বিস্তারের কুফল। গত কিছুদিনে প্রশাসনে ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার মত যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোও প্রধান বিচাপতির বক্তব্যের প্রমাণ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বর্তমানে যে ধরনের অন্যায়-অবিচার প্রশ্রয় পাচ্ছে সেসবও প্রভাব বিস্তারের কারণে ঘটছে। এটাও লক্ষণীয় যে, প্রশাসন বর্তমানে এক প্রকার অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি কতটা বিস্তৃত তার পূর্ণ বিবরণ না থাকলেও সামগ্রিকভাবে এটা বলা অসঙ্গত নয় যে, প্রধান বিচারপতি যখন এনিয়ে কথা বলেছেন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তখন তার ভিত্তি রয়েছে। পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সঙ্গত বিবেচনা থেকেই সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছেন, পুলিশ বা অন্য কারো কথায় আসামীর জামিন পাওয়ার স্বাধীনতা খর্ব করা যায় না। আদালতের যদি এখতিয়ার থাকে জামিন দিতে পারেন। কিন্তু জামিন স্থগিত করার তো কোন আইন বা বিধান নেই। পুলিশ কোন মামলা নিয়ে রিমান্ড আবেদন করে বসে। আমরা বিচারকরা ডান-বাম কিছুই না দেখে পুলিশের কথায় আসামীকে রিমান্ডে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু কেন আমরা পুলিশকে বলতে পারি না, তোমরা কেন রিমান্ড চাও? তিনি বলেছেন, যাদের সাহস নেই তারা চাকরি ছেড়ে চলে যান। বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা বলেছেন, বিচারকদের শতভাগ পক্ষপাতহীনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটালে সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মাঝে ভুল ধারণার সৃষ্টি হবে। জেলা জজদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, একটি জেলার অভিভাবক হিসেবে আপনাদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। কাগজে-কলমে শুধু অভিভাবক হলে চলবে না। প্রকৃত বিবেচনা থেকেই এটা বলা যায়, দেশে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা না থাকলে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার কোন কিছুই থাকে না। ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে না পারলে দেশের মানুষের আর যাবার কোন জায়গা থাকে না। গত কয়েক বছরে নির্বাহী বিভাগ কোন কোন ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। অধস্তন আদালত সম্পর্কে তো আইনজীবীরাই বলেছেন যে, এদের উপর সরকারি প্রভাব রয়েছে। তারা বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারটিকেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত করেছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করে বলেছেন, তার দেয়া তালিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, একটি সুষ্ঠু ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে প্রভাব বর্জিত ব্যবস্থাপনা ও বিচার বিভাগের প্রকৃত ও পূর্ণ স্বাধীনতা অপরিহার্য।
একটি দায়বদ্ধ সরকার গঠনে নির্বাচনী ব্যবস্থার যে গুরুত্ব এবং সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সামগ্রিক এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই বিবেচনার দাবি রাখে। এই যে প্রভাব বিস্তারের আলোচনা এর মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বা ভ্রান্তি। অবশ্যই এটা লক্ষণীয় যে, ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হয়েছে। এর ফলে প্রশাসনের সর্বত্রই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। এক বিভাগ কর্তৃক অন্য বিভাগের উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তব এ চিত্রের আলোকেই প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত প্রবণতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য। তা না হলে সর্বত্রই বিশৃঙ্খলা ও অচলায়তন দেখা দেবে, যা কাম্য হতে পারে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন