পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোয় জীবনযাপন ও অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে বড় আকারে। এতে বিদ্যুৎ ও শিল্পপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধি পাবে, যার প্রতিক্রিয়া পণ্যমূল্যের উপর পড়বে। ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিআই) সভাপতি বলেছেন, মাইক্রোসফট-গুগলের মতো বড় বড় কোম্পানি পরিবর্তিত বাস্তবতায় হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করছে। আমাদের এখানে কর্মী ছাঁটাই না করে প্রফিট মার্জিন কমিয়ে হলেও ব্যবসা সচল রাখতে হবে। তার এ বক্তব্য অত্যন্ত বাস্তবোচিত ও যৌক্তিক। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠনের উদ্বেগের কথা কারো অজানা নেই। তাদের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ রয়েছে। এর আগে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য বাড়তি মূল্য দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এবার গ্যাসের দাম বাড়ানোয় তাদের দাবি, শিল্পে অবিছিন্ন গ্যাস দিতে হবে। সরকার শিল্পে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এই শীতে যখন বিদ্যুতের চাহিদা কম, তখনও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্রীষ্মে কী হবে, সহজেই অনুমেয়। গ্যাসের ক্ষেত্রে তো রীতিমত হাহাকার চলছে। শিল্প ও আবাসিকসহ সকল ক্ষেত্রেই চলছে গ্যাসের ভয়াবহ সংকট। কারখানা চলছে না ঠিকমতো। রান্নাবান্নাও বন্ধ অধিকাংশ সময়। ব্যবসায়ীদের মতে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতির আশু পউন্নতি না হলে উৎপাদন ব্যহত হবে। পণ্যমূল্য তো বাড়বেই। রফতানিও ব্যহত হবে। ২০২৩ সালে রফতানি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসায়ীদের শংকা, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত নাও হতে পারে। শিল্প, উৎপাদন ও রফতানির যখন এই হাল ও আশংকা, তখন কৃষিতেও সুখবর দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্মরণ করা যেতে পারে, করোনাকালে সবকিছু বন্ধ থাকলেও কৃষি ছিল সচল। অর্থনীতির বিভিন্ন চাপ একাই মোকাবিলা করেছে কৃষি। নিশ্চিত খাদ্য নিরাপত্তার বিকল্প নেই যখন, তখন বোরো আবাদ ব্যহত হতে পারে বলে আশংকা তৈরি হয়েছে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের সঙ্গে সারের দাম বাড়ায় আবাদের খরচ বেড়ে গেছে, যা যোগান দেয়া অধিকাংশ কৃষকের পক্ষেই অসম্ভব। কৃষকদের মতে, ডিজেল, বিদ্যুৎ ও সার-কীটনাশকের দাম বাড়ায় প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকার বেশি পড়বে। উৎপাদন খরচ বাড়লে ভোক্তা পর্যায়ে চালের দামও বাড়বে।
তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির দাম বাড়লে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং উৎপাদন-অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর এসবের যাবতীয় খেসারত জনগণকেই গুনতে হয়। ২০২২ সাল দেশের জনগণের বিশেষ করে নি¤œআয় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তদের খুবই খারাপভাবে গেছে। তাদের আয় বাড়েনি; অথচ খরচ বেড়েছে লাগামহীন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। সেবা ও পণ্য কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় তাদের কম পণ্য কিনে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, গত এক বছরে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য মোটেই স্বস্তিকর ছিল না। সংগঠনটির মতে, চাল, ডাল, আটা-ময়দা, তেল, চিনি, সবজি, মাছ-গোশত, ফল-ফলারি, মশলাপাতি, সাবান-সোডা, ওষুধ, পরিবহন ভাড়া, শিক্ষাব্যয় ইত্যাদি প্রায় সবকিছুরই দাম বেড়েছে। উল্লেখ্য কেবল রাজধানীতেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়েনি, দেশের সর্বত্রই বেড়েছে। এজন্য সকল পর্যায়ের মানুষকেই বাড়াতি মূল্য গুনতে হয়েছে। ২০২৩ সালে যে জীবনযাত্রার ব্যয় ও পণ্যমূল্য আরো বাড়বে, সে আলামত স্পষ্ট। সেবার দাম যেমন বাড়ানো হচ্ছে, তেমনি পণ্যের দাম লাগাতার বাড়ানো হচ্ছে। সেবার দাম বাড়াচ্ছে সরকার। পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা। গরিব মানুষ বা সাধারণ মানুষের প্রতি ন্যূনতম মমতা, শ্রদ্ধাভক্তি থাকলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের এতটা বেপরোয়া হওয়ার কথা নয়। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার কথা বলে সরকার তেল-গ্যাস এবং তেল-গ্যাসনির্ভর বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেশি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এই যে যথেচ্ছাচার চলছে, সে বিষয়ে যেন জনগণের কিছু বলার নেই। নিরবে সবকিছু তারা সহ্য করে যাচ্ছে। কতদিন এভাবে সহ্য করবে, সেটাই প্রশ্ন।
গণকষ্ট ও গণদুর্ভোগ লাঘব, অর্থনীতির গতি সচল এবং চলমান উন্নয়ন কর্মকা- অব্যাহত রাখতে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সমন্বিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণের তাকিদ উচ্চারিত হচ্ছে বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের তরফে। মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জকেই বড় করে দেখছেন অনেকে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সরাসরি। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখতে হলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে হলে কাঁচামালসহ উৎপাদনের আবশ্যিক উপকরণসমূহের দাম কম হতে হবে। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল, তেল, গ্যাস ইত্যাদির দাম বেশি, কাজেই সেই দামেই আমাদের আমদানি করতে হবে। এমতাবস্থায়, অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম যথেচ্ছ না বাড়িয়ে এসবের ব্যবহারে কৃচ্ছতা অবলম্বন এবং চুরি-অপচয় রোধ করতে পারি আমরা। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এসবের চুরি-অপচয় বন্ধ ও সিস্টেমলস কমালে দফায় দফায় দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। এদিকেই সরকারের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত ও জরুরি। বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সুবিধাজনক নয়। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি আরেকটি মহামন্দার শিকারে পরিণত হতে পারে। অনেকের মতে, ইতোমধ্যে মন্দা শুরু হয়ে গেছে। মন্দা বা মহামন্দা হলে জ্বালানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, পণ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, দারিদ্র্য বাড়বে। আরো অনেক কিছু হবে। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে আমরাও বাইরে আসতে পারবো না। সমূহ আশংকায় এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে কাজে লাগতে হবে। উন্নয়নের ফিরিস্তি উল্লেখ করে গলাবাজি করার অবকাশ এখন নেই। এখনই সময় সবাই মিলে একসাথে কাজ করার। বিবিধ সংকট থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত রাখার চেয়ে উত্তম কোনো কাজ হতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।