Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নরেন্দ্র মোদি কোন পথে এগোচ্ছেন?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ভারতের মধ্যাঞ্চলে কেদারনাথ মন্দিরের সামনে সুন্দর এবং বহুমূল্যের জোব্বা পরিহিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবিটা দেখে সত্যজিৎ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’ উপন্যাসটার কথা মনে পড়ল। মনে হলো, এখনই এমন একটা উপন্যাস লেখা যেতে পারে, যার নাম হতে পারে ‘ধর্মস্থানে সাবধান’। একদিকে তিনি কেদারনাথ, মহাকালেশ্বর, উজ্জয়িনীর মন্দিরে মন্দিরে ঘুরছেন, কপালে তিলক, হাতে রুদ্রাক্ষ, অন্যদিকে এতদিনেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের একজন ধর্মনিরপেক্ষ প্রধান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। সেটা যে তিনি চেয়েছেন, এমনও নয়। তিনি হিন্দুত্বের বিরাট বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছেন। প্রতি মুহূর্তে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিষ উগরে দেওয়া হচ্ছে। নিন্দুকরা বলেন, তাঁর অনুগামীরা বিভিন্ন সভায় হিংসার বার্তা ছড়াচ্ছেন। মারো, কাটো, গোলি মারো ইত্যাদি বার্তা দিয়ে দেশে এক বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। আর তিনি জোব্বা পরে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরছেন। সুতরাং এই বৈপরীত্যের মধ্যে আর যাই থাক, সহৃদয়তার কোনও লক্ষণই নেই। সবটাই ভঙ্গি দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকার একটা অপচেষ্টা মাত্র। অবশ্য তারও একটা উদ্দেশ্য আছে।

তার শাসন ব্যবস্থার খতিয়ান ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে, তিনি একমাত্র সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি ছাড়া সব বিষয়েই ফেল করেছেন। এই বিভেদ কিংবা হিংসাও একটা সচেতন প্রয়াস। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে হিন্দুভেটি এককাট্টা করাই লক্ষ্য। কাজের খতিয়ান নয়, হিন্দুত্ব। কাজের খতিয়ানকে আড়াল করতেই এই উন্মার্গগামিতা। কেননা, কাজের খতিয়ানকে মাপকাঠি করলে আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপির পঞ্চাশটি আসনও পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু হিংসা ছড়িয়ে ভোট কুড়ানোর সরল রাস্তা মানুষের ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পেতে পারে না। একটা শ্রেণি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার বিষে নিমগ্ন মানুষজন মেতেছেন উল্লাসে। আমরা দেখেছি, গেরুয়াধারী এবং সন্ন্যাসীদের মতো পোশাক পরা কিছু মানুষ অপরাধীদের ভাষায় হিংসা আর বিদ্বেষের কথা বলছেন। সংযত ভাষা আজ হারিয়ে গিয়েছে। লুম্পেনদের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বহু সাধু বিষ উগরে দিচ্ছেন। একটা ঘৃণা সহস্র ঘৃণার জন্ম দেয়, একটা পাপ দেশকে টেনে হিঁচড়ে অতলে তলিয়ে দেয়, সেটা কি মোদি জানেন না? তিনি সবই জানেন। তাঁরই ইতিবাচক উদাসীনতার ভয়ঙ্কর লক্ষণগুলো সমাজে ইতোমধ্যেই ফুটে উঠেছে। অন্ধজনেও তা অনুভব করতে পারেন। তাঁর শাসনব্যবস্থা দেশকে শুধু নিঃস্বই করেনি, শুধু দেউলিয়াই করেনি। তাঁর শাসনব্যবস্থার একদেশদর্শিতা ও পরোক্ষ ঘৃণা দেশের মধ্যে সহস্র ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। আসলে বিজেপির রাজনীতিতে এটাই অন্তিম পুঁজি। শুধুমাত্র ভোট জয়ের জন্য দেশে কোটি কোটি হিন্দুকে তাতিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণার আবহ তৈরি করলে সেই দেশ নরকে পরিণত হতে বাধ্য। মোদির শাসনে সেই এমনতরো পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং বিজেপি, হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠন সেই নরককে গুলজার করে তুলতে চাইছে।

এসব দেখে আর চোখ বুজে থাকতে পারেনি সুপ্রিম কোর্ট। সমাজে এত অন্যায়, এত হিংসার বিস্তার দেখে সুপ্রিম কোর্ট ভর্ৎসনা করেছে মোদি সরকারকে। মোদি যখন কেদারনাথ মন্দিরে ‘আধ্যাত্মিক সাধনায়’ ব্যস্ত তখন সুপ্রিম কোর্ট সরকারের আধ্যাত্মিক চেতনা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। সরকারকে হতে হবে সংবেদনশীল। মোদি তো ১৩০ কোটি দেশবাসীর প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে মুসলিমরাও আছেন। কিন্তু শুধু হিন্দুত্বের স্বার্থকে আগলে মুসলিমদের প্রতি বিষোদ্গার করে সাচ্চা শাসক হওয়া যায় না। হিন্দুর ভোটে যাবজ্জীবন ক্ষমতায় থাকার কৌশল যদি তিনি রপ্ত করেও ফেলেন, তবুও এই দৃষ্টিভঙ্গি অযৌক্তিক, অন্যায়, পাপ। সেই ঝাঁঝটুকু প্রকাশ পেয়েছে সুপ্রিম কোর্টের তীব্র ভর্ৎসনায়। যথার্থ পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে শেষ কথাটুকু বলে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। বলেছে, যারা হিংসা ছড়াচ্ছে, রাজ্যগুলো তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ফৌজদারি মামলা দায়ের করুক। প্রশাসনকে নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে দেশজুড়ে এই ঘৃণা আর হিংসার বাড়বাড়ন্তকে বন্ধ করতে হবে। নাহলে সেটাকে আদালত অবমাননা বলে ধরা হবে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে মর্যাদা দিতেই হবে।

কিন্তু কে কার কথা শোনে। সরকার না শোনে সুপ্রিম কোর্টে কথা, না মানে সংবিধানের ভাষা। তাই বিজেপি পান্ডাদের পীড়নে আজ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মুক্তমনা মানুষের জীবন যে দুর্বিষহ, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। মোদির এই ধরনের আচরণে বিশ্বমঞ্চও আজ ক্ষুব্ধ। কয়েকদিন আগেই জাতিসংঘের মহাসচির আন্তোনিও গুতেরেস হেট স্পিচ নিয়ে চরম সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু তাতে মোদির কিছু এসে যায় না। এদিকে কান দিলে সিংহাসন হাতছাড়া হয়ে যাবে। মোদির জনপ্রিয়তার পারদ অবশ্য রোজই নামছে। তাই মোদি বিশ্বাস করেন, ২০২৪ পর্যন্ত পারদমাত্রাকে ঊর্ধ্বমুখী রাখতে গেলে হিংসা, বিদ্বেষ আর বাহুবলকেই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। সুপ্রিম কোর্ট বারবার তিরস্কার করলেও মোদি বলছেন না যে, অবিলম্বে বিজেপি শাসিত রাজ্যে বন্ধ হোক এই হিংসা। যিনিই হিংসার বার্তা দেবেন, তাকেই দেশদ্রোহী বলে গ্রেপ্তার করে মামলা হবে, বলেননি তিনি এমন কথাও। আর কোনোদিন বলবেনও না।

রাজ্যে রাজ্যে হিন্দুধর্ম সংসদের আয়োজন করে নেতারা ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, উসকানিমূলক মন্তব্য করে অশান্তি পাকাতে চাইছেন সুপ্রিম কোর্ট তাই উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখ- এবং দিল্লিকে সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। প্রথম দুই রাজ্যে ক্ষমতায় বিজেপি এবং দিল্লির পুলিশ চলে অমিত শাহের নির্দেশে। তাহলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে, কারা হিংসা ছড়াচ্ছে।

অবশ্য এই প্রথম নয়। এর আগেও সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র এবং বিজেপি অধীন রাজ্যগুলিকে সংযত হতে বলেছিল। যেমন ২০২১ এর জুলাই মাসে উত্তরাখ- সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সেবার করকিতে যে ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, সেখানেও এই ধরনের হিংসামূলক বার্তা ছড়ানো হয়েছিল। বিচারপতি খানউইলকার তখন তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, অবিলম্বে এসব বন্ধ করুন। সরকার পক্ষ বলেছিল, আমরা বিষয়টি দেখব। বিচারপতি বলেছিলেন, কোর্ট বলার পর দেখব বলছেন কেন, আগে দেখেননি কেন? তারপরও কিন্তু বন্ধ হয়নি হিংসার চাষ। সুতরাং এটা নিশ্চিত, বিদ্বেষপূর্ণ বাতাবরণ তৈরি করার প্রয়াস জারি থাকবেই। এই প্রয়াসটুকু কেড়ে নিলে বিজেপি হয়ে যাবে বিগ জিরো। ব্যর্থ শাসকদের ভোটে জিততে হিংসা আর বিদ্বেষকেই যে অস্ত্র করতে হয়। বিগ জিরো থেকে হিরো হওয়ার পথে একমাত্র সম্বল হিংসা।

আসলে মোদির একটা বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে। সেটা হলো, যে পথে পুতিনের রাশিয়া গিয়েছে, যে পথে জিনপিংয়ের চিন গিয়েছে সেই পথেই ভারতকে নিয়ে যাওয়া। পুতিন সংবিধান বদলে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাশিয়ার প্রধান পদে আসীন হয়েছেন। চীনের প্রধান জিনপিংও অনির্দিষ্টকালের জন্য পার্টি, দেশ, সামরিক শক্তি, দেশের সিক্রেট সার্ভিসের ক্ষমতা দখল করেছেন। এর জন্য তিনিও দেশের সংবিধানকে বদলেছেন। সেই লক্ষ্যেই কানে তুলো দিয়ে এগিয়ে চালছেন মোদি। নানা কারসাজিতে তিনি আজীবন দেশের ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করেছেন। এর জন্য তাঁর সামনে দুটি পথ। একপথে হিংসা ও বিদ্বেষের মাধ্যমে হিন্দুভোটকে অটুট রাখা এবং দ্বিতীয় পথ হলো ডিলিমিটেশন বা আসনের পুনর্বিন্যাস। এই ডিলিমিটেশনের আসল উদ্দেশ্য হলো, ভোটের আগে জয় নিশ্চিত করা। জানা গিয়েছে, লোকসভার আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৭৭২ করা হবে। অর্থাৎ, কাগজে-কলমে সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো আসনে জয় হাসিল করার তত্ত্বেই হবে এই ডিলিমিটেশন!

একদিকে শাসক ছক কষে, অন্যদিকে আড়ালে ভবিতব্য মুচকি হাসে। গণতন্ত্রের সেই শক্তিটুকুর তল মাপতে না-জানালে কোনও ছকেই কাজ দেয় না। ব্যর্থ শাসকের সলিল সমাধি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
function like(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "clike_"+cid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_like.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function dislike(cid) { var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "cdislike_"+cid; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_comment_dislike.php?cid="+cid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rlike(rid) { //alert(rid); var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rlike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_like.php?rid="+rid; //alert(url); xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function rdislike(rid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "rdislike_"+rid; //alert(xmlhttp.responseText); document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com/api/insert_reply_dislike.php?rid="+rid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } function nclike(nid){ var xmlhttp; if (window.XMLHttpRequest) {// code for IE7+, Firefox, Chrome, Opera, Safari xmlhttp=new XMLHttpRequest(); } else {// code for IE6, IE5 xmlhttp=new ActiveXObject("Microsoft.XMLHTTP"); } xmlhttp.onreadystatechange=function() { if (xmlhttp.readyState==4 && xmlhttp.status==200) { var divname = "nlike"; document.getElementById(divname).innerHTML=xmlhttp.responseText; } } var url = "https://old.dailyinqilab.com//api/insert_news_comment_like.php?nid="+nid; xmlhttp.open("GET",url,true); xmlhttp.send(); } $("#ar_news_content img").each(function() { var imageCaption = $(this).attr("alt"); if (imageCaption != '') { var imgWidth = $(this).width(); var imgHeight = $(this).height(); var position = $(this).position(); var positionTop = (position.top + imgHeight - 26) /*$("" + imageCaption + "").css({ "position": "absolute", "top": positionTop + "px", "left": "0", "width": imgWidth + "px" }).insertAfter(this); */ $("" + imageCaption + "").css({ "margin-bottom": "10px" }).insertAfter(this); } }); -->