Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চলছে স্মার্ট ও মেরামতের স্লোগান

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে স্মার্ট করে তুলতে চায়। আর বিএনপি চায় বাংলাদেশকে মেরামত করতে। বিএনপির মেরামতটি কেমন হবে সে ব্যাপারে দলটি ২৭ দফা রূপরেখা দিয়েছে। নাম দিয়েছে রেইনবো ন্যাশন।

ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশকে ইংরেজিতে স্মার্ট বাংলায় পরিপাটি করতে চায়। যদিও সেই পরিপাটির ধারণাটি স্পষ্ট নয়। কোন জায়গায়, চেহারায় না অন্তরে, ভেতরে না বাইরে কোথায় পরিপাটি করবে? নির্বাচন, সুশাসন, দুর্নীতি দমন কোথায়? নাকি রাষ্ট্রের পুরো কাঠামোতে? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানটিতে কিন্তু স্মার্ট ভাব কম ছিল না। তা নেতাকর্মীদের পোশাক-আসাক এমন কি মঞ্চেও। ওই মঞ্চে বক্তৃতার সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আবৃতিভরা কণ্ঠে স্মার্ট শব্দ উচ্চারণের মহূর্তেই ঘটলো বিপত্তি। ভেঙে কাত হয়ে পড়ে আস্ত মঞ্চটি। মঞ্চেটির আর মেরামতেরও অবস্থা থাকেনি। তাৎক্ষণিক বলা হয়েছে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক ওঠায় মঞ্চের এ অবস্থা হয়েছে। মঞ্চ স্মার্টই ছিল।

সরকারি মহলের স্মার্টনেসের এ অবস্থার মাঝে বিএনপির মেরামত কাজের নমুনাও আছে। অন্তত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এর তরতাজা উদাহরণ চলছে। তার রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে যে ২৭ দফা রূপরেখা প্রকাশ করেছে এর ৭ নম্বরে আছে ‘সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে।’ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা আছে সেখানে। একই সঙ্গে ‘ফ্লোর ক্রসিং’ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার প্রতিবন্ধক ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের পক্ষে পরোক্ষ ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। শুনতে তো চমৎকার। কাজে কতটা হবে, সেটাই প্রশ্ন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে নির্বাচিত বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া দলীয় সিদ্ধান্তে পদত্যাগের পর উপনির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। এটি তার ‘স্বাধীন মতের পক্ষে স্বাধীন অবস্থান’। সেই হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তিনি। কিন্তু বিএনপি তার স্বাধীন মত এবং মতের পক্ষে অবস্থানকে সম্মান দেখায়নি। দল কেন্দ্র থেকে তাকে বহিষ্কার করেছে। আর স্থানীয় বিএনপি তাকে নিজ এলাকায় করেছে অবাঞ্চিত। কী দাঁড়ালো অর্থটা? তাহলে দলটি তার ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে’ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের যে অঙ্গীকার করেছিল সেটি কি রক্ষা হলো?

নেতৃত্ব এবং দল ‘স্মার্ট’ না হলে কর্মীরা ‘স্মার্ট’ হবে না। মঞ্চ টেকসই হওয়াতো আরো পরের ব্যাপার। মাত্র কয়দিন আগেই পালিত হলো সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়, যা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করে এসে এখন ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে যে বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করে, বিজয়ী হয়ে আত্মশাসনের জন্য যে অধিকার পেয়েছিল, যে সংবিধান রচনা করেছিল, তার আলোকে অতি অল্প শতাংশ নাগরিক হতে পেরেছেন আর বাকি বড় অংশই আসলে সবকিছু থেকে বঞ্চিত থেকে আনস্মার্টই থাকছে। দেশের বহুদলীয় ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বহুস্বরের মুক্ত পরিসর কোথায় আছে? কোনটার কাঠামো ঠিক আছে? কোনটার মেরামত জরুরি নয়?

স্মার্ট উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ ভেঙে পড়ার দিনই টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের চতুর্থ বছর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন। এর বিপরীতে রেইনবো ন্যাশনের ক্যাম্পেইনে দেশ চরছেন বিএনপি নেতারা। বোঝানোর চেষ্টা করছেন, কীভাবে রাষ্ট্র মেরামত করবেন তারা। আর এ রকম সময়েই বসেছে বিএনপিবিহীন সংসদের ২১তম অধিবেশন। এর উদ্বোধনী বক্তব্যে রাষ্ট্রপতির উপলব্ধি, বড় কঠিন সময়ে পড়েছে বাংলাদেশ। সময়টিকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘সন্ধিক্ষণ’ নামে। এর ব্যাখ্যা বিভিন্ন হতে পারে। ক্ষমতাসীনরা কাঙ্খিত স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য একটি স্মার্ট ইলেকশনের তাগিদ মাথায় নিচ্ছেন না। আবার বিএনপি রেইনবো নেশনের জন্য রেইনবোর আবহের গরজ বোধ করছে না। এগোচ্ছে যার যার মতো। আবার শ্রেণি চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে বেশ মিলও উভয়ের। বিএনপি বা কোনো দল না এলে নির্বাচন ঠেকে থাকবে না, আগের মতো এ সিদ্ধান্তের কথা খোলাসা করেছে সরকার। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে কী হয়, না গেলেই বা কোন পরিণতি বরণ করতে হয়, দুই অভিজ্ঞতায়ই সমৃদ্ধ দলটি। সেইক্ষেত্রে তাদের বিকল্প হচ্ছে নির্বাচন হতে না দেওয়া। অবস্থাটা জটিল। এর মাঝে আবার দুদিকেই ভোট-জোটের ব্যতিক্রমী রিহার্সাল। ধরনেও ভিন্নতা। ক্ষমতাসীনদের মাঝে জাতীয় পার্টিসহ পুরনো মিত্রদের এক করার এন্তার চেষ্টা। এর মাঝে লুকোচুরি নেই। জামায়াতকে দৌড়ের ওপর রাখলেও হেফাজতকে স্মার্টলি আয়ত্ব করে নিয়েছে সরকার। সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া আরো তুঙ্গে তাদের।

ওদিকে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের ইসলামী আন্দোলনকে আয়ত্ব করতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুদলেরই তুমুল প্রতিযোগিতা। ডান বা ধর্মাশ্রয়ীদের নিয়ে এমন সমীকরণে আওয়াম লীগ-বিএনপি বামদেরও ছাড় দেয় না। আয়ত্ব করতে না পারলে আবার গালমন্দও করে। নাস্তিক-মুরতাদ নামে বদনাম করে। এবার বিএনপির ছকে কেবল অতি বাম, অতি ডান নয়; মধ্যপন্থী কয়েকটি মহলও এখন সরকারের বিরুদ্ধে মিলেমিশে একাকার। তারা বিএনপির প্রতি সন্তুষ্ট বা দলটির ঘোরতোর পক্ষ নিয়েছে এমনও নয়। তাদের অবস্থান আপনাআপনি চলে যাচ্ছে বিএনপির দিকে এবং সরকারের বিপরীতে। তাদের নি¤œ ভাষায় গালাগাল করা হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। বামরা কী করে বিএনপির দিকে যায়, এমন খেদোক্তিও করা হয়েছে। তার বেনিফিট নিচ্ছে বিএনপি। জোটের জট না পাকিয়ে সহযাত্রী বাড়াচ্ছে বিএনপি। ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আনবে সেই ওয়াদা দিচ্ছে ডানে-বামে সব দিকে। কেবল জামায়াতসহ ডান নয়, বাম কট্টরসহ মধ্য ঘরানার অনেকেও যুগপতের নামে মাঠে তৎপর। বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন তারিখে গণমিছিল, গণঅবস্থান, গণসমাবেশ ধরনের নানা কর্মসূচি চলছে তাদের। ভেতরে ভেতরে এসব দলকে কাছে নেয়ার চেষ্টা আছে সরকারের। সফল না হওয়ায় এখন মোকাবেলায় সরকারের যারপরনাই তৎপরতাও লক্ষণীয়। পুলিশ নিয়ে মাঠে নামছে, সাবেক মিত্রদেরও টানছে। ১৪ দল তাজা করছে। হেফাজতের পাশাপাশি, তরিকত ফেডারেশন, চরমোনাই, জাকের পার্টিকেও পাশে রাখছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন