Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ফুলতলী ছাহেব কিবলা রহ. খানেকায় পীর, ময়দানে বীর

মুজাহিদুল ইসলাম বুলবুল | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো ১৫টি বছর। ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পৃথিবীর জমিন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মুজাদ্দিদে জামান, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। এতিমের বিহ্বল চোখ তাঁকে আজও খুঁজে ফিরে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত লতিফিয়া এতিমখানা ফুলতলীর সম্প্রতি ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী ফুলতলীর পৃষ্ঠপোষকতায় এতিমখানাটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এতিমখানায় রূপ নিয়েছে। মানুষকে ভালোবাসার, মানুষের সেবা করার এক অনন্য নজির তিনি দেখিয়ে গেছেন। অসহায়, দুস্থ মানুষের চোখ আজও তাঁর স্মরণে অশ্রুসজল হয়। ফুলতলী ছাহেব বাড়ির লঙ্গরখানা, ফ্রি ডিসপেনসারি, ফ্রি খতনা ক্যাম্প ইত্যাদি আজও তাঁর পবিত্র স্মৃতি ধারণ করে সগৌরবে এগিয়ে চলেছে। তিনি মানুষকে পরকালের ফিকির শেখাতেন। আজও খানেকার মাহফিলগুলোতে জিকিরের শব্দের সাথে জাকিরিনের হৃদয়ে তাঁর স্মৃতির ঢেউ ওঠে।

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বহুমুখী খিদমাতের প্রসার আজ দুনিয়াব্যাপী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, মাদরাসার সংখ্যা অগণিত। বিশেষ করে, বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট আজ দুনিয়াজুড়ে সুপ্রসিদ্ধ।

এতিমের লালন-পালন, অসহায়ের সেবা, মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, খানেকায় মশগুল জিকির, আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন-বিভোরতা, কোরআন হাদীসের সুদীর্ঘ খিদমাত ইত্যাদির পাশাপাশি জীবনভর তিনি শিখিয়ে গেছেন আকিদার ক্ষেত্রে আপোসহীনতা; জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ। ইসলামদ্রোহী নাস্তিক-মুরতাদদের কাছে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এক আতংকের নাম। তাঁর জীবদ্দশায় যখনই ইসলামবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, তিনি মাঠে নেমে পড়েছেন। তাঁর বজ্র হুংকার বাতিলের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে।

শাহাদাতের তামান্না যে প্রকৃত ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তিনি তাঁর সংগ্রামী জীবনের মাধ্যমে মুসলমানদের তা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে হৃদয়ে শাহাদাতের তামান্না লালনকারী প্রতিটি মুজাহিদ আজ তাঁকেই স্মরণ করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বিগত দিনগুলোতে ইসলামদ্রোহী শক্তির একেকটি ষড়যন্ত্র এবং আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির একেকটি বজ্র হুংকার। বাংলাদেশের জমিন থেকে ইসলামী মূল্যবোধকে মিটিয়ে দেয়া, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে আগামী প্রজন্মকে আল্লাহর দীন থেকে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র নতুন নয়। এ কথা মানতেই হবে, এইদেশে ইসলামকে টিকিয়ে রেখেছে ইসলামী শিক্ষা তথা দীনি প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা। সুতরাং দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শকুনদৃষ্টি অনেক পুরনো। সেই ঐতিহাসিক লংমার্চের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যখন ফাজিল এবং কামিলের স্তর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হলো, তখন বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। একটি স্বতন্ত্র আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ছাহেব কিবলার নেতৃত্বে গর্জে উঠেছিলো দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

যখনই এই দেশে ইসলামবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র হয়েছে, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। তিনি ছিলেন এক দক্ষ সংগঠক। নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন ঘরানার ওলামা-মাশায়েখদের এক মঞ্চে সমবেত করে তিনি যে আশা আর শক্তির সঞ্চার করেছিলেন, সেই আশা, সেই শক্তি এখনও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করে। জীবনভর তাগুতের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ছিলো অব্যাহত। কোনো জালিম শাসকের সামনে কখনও নত হননি, বরং শাসকের চোখে চোখ রেখে সত্যকে উচ্চারণ করেছেন এই নির্ভীক বীর সিপাহসালার। ১৯৮৮ সালে যখন তৎকালীন সরকার ইনকিলাব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো, ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, অবিলম্বে ইনকিলাব খুলে দাও, না হলে এ আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।

দুর্দিনে আজ তোমায় খুঁজে
এই দুই চোখ হয় পেরেশান
খানেকায় পীর, ময়দানে বীর
স্মৃতিমন্থন তোমার বয়ান।

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর তরীকার ঊর্ধ্বতন বুজুর্গ সায়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির চেতনাকে আমৃত্যু লালন করে সেই চেতনা জমিনে উজ্জীবিত রেখে গেছেন। প্রকৃত ওলী আল্লাহ যাঁরা, তাঁরা যে কেবলই খানেকার পীর নন, বরং দীনের প্রয়োজনে রক্ত দানে, জীবন দানে তাঁরা যে অগ্রগামী, সেই প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন এই জমিনে রক্ত দিয়ে। তাঁর আপোসহীন সংগ্রামী জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। তাঁকে আঘাত করতে করতে নিহত ভেবে ফেলে গিয়েছিলো একদল হায়েনা। কোরআনের সম্মানে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোহাব্বাতে জীবন ছিলো উৎসর্গীত। আল্লাহর দীনকে সমুন্নত রাখতে সংগ্রাম করাকে, রক্ত দেয়াকে তিনি ভালোবাসতেন। গর্ববোধ করতেন। একবার তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার একদল আহত রক্তাক্ত কর্মী দেখে তিনি খুশি হয়েছিলেন। শুকরিয়া আদায় করে বলেছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর দীনের জন্য রক্ত দিতে পারে, আমার এমন একদল কর্মী তৈরি হয়েছে।

আজ এই মুহূর্তে যখন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামদ্রোহী শক্তির আস্ফালন, আগামী প্রজন্মকে সংশয়বাদী বানিয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র, মানুষের বাচ্চাকে বানরের বাচ্চা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘৃণ্য তৎপরতা, তখন বারবার যাঁকে মনে পড়ছে, তিনি হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। মনে পড়ছে, প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর দক্ষ এবং সংগ্রামী ভূমিকার কথা। তাঁর সংগ্রামী স্মৃতিগুলো আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। আজকের এই কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো ঈমানদারের জন্য মুখ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, বেড়ালের মতো ১ হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের মতো একদিন বাঁচাই উত্তম। যে নাস্তিক্যবাদী শিক্ষানীতি এ দেশের মুসলমান শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যত অন্ধকার। অভিভাবকদের নীরবতা আমাদের প্রজন্মকে ঈমানহারা করবে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এই ইসলামবিদ্বেষী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াই তাহলে আগামীতে আমাদের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের ঈমানী তাকত বাড়িয়ে দিন। আমাদের তাঁর মকবুল ওলী হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ঈমানদীপ্ত সংগ্রামী জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আল্লাহর দীনকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার হিম্মত দান করুন।

লেখক: কবি ও কণ্ঠশিল্পী।
[email protected]



 

Show all comments
  • Md Parves Hossain ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ৭:৪০ এএম says : 0
    রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের এক উজ্জ্বল প্রতীক ছিলেন হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ইলমে দীনের খিদমাতের পাশাপাশি তাঁর মানবসেবামূলক নানান কাজের জন্য পৃথিবী জুড়ে লাখ লাখ মানুষ তাঁকে চোখের জলে স্মরণ করছে।
    Total Reply(0) Reply
  • মুহা: শামসুল ইসলাম ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১০:৪৬ এএম says : 0
    ফুলতলী রহ.এর দর্শন নিয়ে যুগে যুগে তৈরি হোক এমন মর্দে মুজাহিদ। জাতির এমন ক্রান্তিলগ্নে সদা মনে পড়ে হে প্রিয় রাহবার। আল্লাহ তার দর্জাকে বুলন্দ থেকে বুলন্দ আ'তা করুন। আ-মীন
    Total Reply(0) Reply
  • মুহা: শামসুল ইসলাম ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১০:৪৬ এএম says : 0
    ফুলতলী রহ.এর দর্শন নিয়ে যুগে যুগে তৈরি হোক এমন মর্দে মুজাহিদ। জাতির এমন ক্রান্তিলগ্নে সদা মনে পড়ে হে প্রিয় রাহবার। আল্লাহ তার দর্জাকে বুলন্দ থেকে বুলন্দ আ'তা করুন। আ-মীন
    Total Reply(0) Reply
  • Rabbul Islam Khan ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ৭:৪০ এএম says : 0
    হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বাংলার জমিনে রক্ত দিয়ে সুন্নীয়তকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক সময় কোরআনুল কারীমের একটি হরফকে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করা হতো, আলহামদুলিল্লাহ্ হযরত ছাহেব কিবলার ত্যাগ আর পরিশ্রমের ফলে পৃথিবীর বহু দেশে এখন দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের মাধ্যমে পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত চর্চা অব্যাহত রয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • মাহফুজ শিপলু ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ৭:৩৭ এএম says : 0
    আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল্লামা ফুলতলী (রহঃ) এর অবদান গুলো কবুল করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Gaffar ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ৭:৩৭ এএম says : 0
    আল্লাহুম্মা আমীন
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shabbir Ahmed ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম says : 0
    আলহামদুলিল্লাহ, সিলেটবাসী গর্বিত যে এমন একজন মর্দে মুজাহিদ পেয়েছিলাম।তিনি ছিলেন অনুস্বরণীয় ব্যক্তিত্ব। ইসলাম প্রচারে আমৃত্যু নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন।ইসলামের বিরুদ্ধে কোন নীতি বা সিদ্ধান্ত নিলে সবার আগেই যিনি প্রতিবাদ করতেন তিনি হচ্ছেন আমাদের মুর্শিদ হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলা রহঃ। বিপথগামী বনী আদমকে সঠিক পথ দেখাতে সর্বদা এগিয়ে রাখতেন।ক্বলবে ইসলাহ,আমলে ইসলাহ এর সঠিক শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি অন্যায়ের প্রতিবাদ ছিল অত্যান্ত জোরেশোরে। আল্লাহ তায়ালা উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা এবং উনার দরজা বুলন্দি কামনা করছি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন