পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে নির্মাণ শিল্পের উপকরণ আবিষ্কার এবং ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতির ক্রমোন্নয়নের মাধ্যমে। হাজার হাজার বছর আগে পিরামিড, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা সবই নির্মাণ শিল্পের এক অনন্য উৎকর্ষের উদাহরণ। গুহাবাস থেকে মানবসমাজ যখন জনপদে বসতি স্থাপন শুরু করে তখন থেকেই ধাপে ধাপে টেকসই বসতি স্থাপনের জন্য আধুনিক নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার চলে আসছে। ক্রমাগত গবেষণার হাত ধরেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে একবিংশে এসেও চলছে তার ধারাবাহিকতা। বর্তমান সময়কে বলা চলে নির্মাণ শিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগ।
দেশে ক্রমবর্ধমান নির্মাণ কর্ম তৎপরতার সাথে সিমেন্ট শিল্পও অপেক্ষাকৃত দ্রুত বিকাশমান শিল্প হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দীর্ঘকাল ধরেই নির্মাণ কাজে ইটপাথর বা অন্যান্য বস্তু দিয়ে গাঁথার কাজে সিমেন্ট সংযোজক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃতহয়ে আসছে। প্রচলিত সিমেন্টের মধ্যে পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট বহুল ব্যবহৃত, যা চুন ও কাদার মিশ্রণ পুড়িয়ে পাউডারের মতো চূর্ণ করে তৈরি করা হয়। বালি ও পানির সাথে সিমেন্ট মিশিয়ে ‘মর্টার’ এবং ইট বা পাথরের টুকরা, সিমেন্ট, বালি ও পানি মিশিয়ে কংক্রিট তৈরি করা হয়। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়, যা দেশেই উৎপাদিত হয়। সিমেন্ট উৎপাদনে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও (ভারত, মিয়ানমার) এখন সিমেন্ট রপ্তানি হচ্ছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি সিমেন্ট ব্যবহার ছিল মাত্র ৬৫ কিলোগ্রাম। বিশেষত পার্শ্ববর্তী ভারত (১৫০ কিলোগ্রাম), ইন্দোনেশিয়া (১২৭ কিলোগ্রাম), মালয়েশিয়া (৫২৯ কিলোগ্রাম) এবং থাইল্যান্ডের (৪২৫ কিলোগ্রাম) তুলনায় এ পরিমাণ খুবই কম। এক সময়ে দেশের বাজারে বিদেশি সিমেন্টের রাজত্ব থাকলেও সেটি এখন পুরোপুরিই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। ক্রমেই তার পরিসর বাড়ছে। বলা চলে, সিমেন্টের বাজার এখন প্রায় পুরোপুরিই দখলে রেখেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু তাই নয়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশী সিমেন্ট অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। গুণগত মানসম্পন্ন বাংলাদেশী সিমেন্টের কদর বিদেশের বাজারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্ভাবনাময় সিমেন্ট শিল্পের এ উত্থানের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
সিমেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তথ্যসূত্র মতে, গত দুই দশক ধরে দেশের সিমেন্ট শিল্প অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের সিমেন্টের মানও অনেক উন্নত। একই সঙ্গে দেশের সিমেন্ট উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। দেশে এখন সিমেন্টের চাহিদার পরিমাণ ৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, সেখানে বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ৫৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ফলে এখন দেশের চাহিদা পূরণ করে সিমেন্ট রপ্তানি করাও সম্ভব। তবে এ জন্য সরকারের পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য, মিয়ানমার ও নেপালে সিমেন্ট রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ আছে। তবে যোগাযোগ অবকাঠামোর অভাব ও নানা শুল্ক-অশুল্ক বাধায় তা ধরা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানে পণ্যের অবাধ যাতায়াত সম্ভব হলে বাংলাদেশের সিমেন্ট রপ্তানি বাড়তে পারে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। ১৯৪১ সালে আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি নামে দেশে প্রথম সিমেন্ট কারখানা স্থাপন হয় সিলেটের ছাতকে সুরমা নদীর তীরে। স্বাধীনতার পরে একমাত্র সিমেন্ট কারখানাটি বিসিআইসির অধীনে ছাতক সিমেন্ট নামে উৎপাদন অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিঙ্কার অ্যান্ড গ্রাইডিং ফ্যাক্টরি নামে আরেকটি কারখানা স্থাপন করা হয়, যা চট্টগ্রামের প্রথম কারখানা। বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৯২ সালের দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় দেশের প্রথম বেসরকারি খাতে বাগেরহাটের মোংলায় মেঘনা সিমেন্ট মিল স্থাপন করে বসুন্ধরা গ্রুপ। এ মিলে উৎপাদিত কিং ব্রান্ড সিমেন্ট শুরুতে বেশ পরিচিত লাভ করে। পরে অন্য বড় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন এ খাতে। এরপর থেকে গড়ে ওঠে বহু সিমেন্ট কারখানা। বিশেষ করে ১৯৯৫ সালের পর থেকে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অনেকে এগিয়ে আসেন এ খাতে। এরপরই একে একে গড়ে ওঠতে থাকে সিমেন্ট কারখানা। এখন দেশের ভারী শিল্পের মধ্যে এ খাত বড় অংশ দখল করে আছে। উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি হচ্ছে দেশের সিমেন্টে। সাশ্রয় হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। তাছাড়া রপ্তানির মাধ্যমে উল্টো বৈদিশেক মুদ্রা আয়েরও নতুন পথ খুলেছে এ খাতের মাধ্যমে। প্রায় দেড় দশক আগে সিমেন্ট রপ্তানির দ্বার খুলেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে সিমেন্ট রপ্তানি খুব একটা বাড়েনি। উত্তর-পূর্ব ভারত ব্যতীত আরও কোথাও রপ্তানির তেমন বিশেষ সুযোগ নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত অবকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও উন্নতি হলে রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক হবে। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ, নেপাল ও ভুটানের অবকাঠামো উন্নতি হলে সিমেন্ট রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। তাছাড়া সরকার যদি সিমেন্ট রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দেয়, তাহলে রপ্তানিতে কিছুটা গতি আসার সম্ভাবনা আছে।
সিমেন্ট উৎপাদন করতে গিয়ে কাঁচামাল হিসেবে প্রাথমিক ধাপে ব্যবহার করা হয় চুনাপাথর (লাইমস্টোন) এবং মাটি। এগুলোকে প্রথমে চূর্ণ করা হয়, তারপর ঢুকানো হয় বিশাল আকৃতির সিলিন্ডারের ভেতর। সেখানে ১৪০০-১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মিশ্রণটিকে উত্তপ্ত করা হয়, যাকে বলা হয় ক্যালসিনেশন। উচ্চ তাপমাত্রায় উপাদানগুলো ভেঙে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় ক্লিংকার। ক্লিঙ্কার ঠান্ডা করে মেশানো হয় জিপসাম ও চুনাপাথর। সঙ্গে আনুপাতিক হারে মেশানো হয় লোহার আকরিক অথবা ছাই যেগুলো স্ল্যাগ এবং ফ্লাইঅ্যাশ নামে বেশি পরিচিত। এরপর মিশ্রণটি একটি বলমিলের ভিতরে চূর্ণ করে তৈরি হয় সিমেন্ট।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের অনেক সূচকের মধ্যে নির্মাণ বা অবকাঠামো খাত অন্যতম। মাথাপিছু বাৎসরিক সিমেন্ট ব্যবহারে যদিও বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে, তারপরও সামগ্রিক সূচকে বিশ্বে সিমেন্ট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকেই থাকে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট ব্যবহার হয় চীনে যা মাথাপিছু ১ হাজার ৮০০ কেজি। প্রতিবেশী ভারতে মাথাপিছু ৩২০ কেজি এবং মিয়ানমারে ২৮০ কেজি। সে হিসেবে মাথাপিছু মাত্র ২০০ কেজি সিমেন্টের ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে হলেও আয়তনের হিসেবে আমাদের এই ছোট্ট দেশটির বার্ষিক চাহিদা প্রায় তিন কোটি মেট্রিক টন সিমেন্ট। যদিও আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে দেশে সক্রিয় ছোট-বড় সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদার ২০-২৫ শতাংশ যায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে, ১০-১৫ শতাংশ ব্যবহার হয় শিল্প কারখানা তৈরিতে এবং বাকি প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণে। বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদন করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর বাকি প্রায় ৮০ শতাংশ যোগান দেয় দেশীয় কোম্পানিগুলো।
স্থানীয় কাঁচামাল এবং আমদানিকৃত ক্লিনকার উভয় উপাদান থেকেই স্থানীয়ভাবে সিমেন্ট তৈরি হয়। দেশীয় কোম্পানিগুলি চীন, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ক্লিনকার আমদানি করে। দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন সিমেন্ট কারখানাগুলি প্রায় ৬০ শতাংশ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলি যেমন লাফার্জ মল্লিন্স, সিমেক্স, হলসিম, হিডেলবার্জ বাকি ৪০% সিমেন্ট উৎপাদন করে। দেশে প্রধান প্রধান সিমেন্ট কোম্পানিগুলি হলো শাহসিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, ফ্রেশ, ক্রাউন, সেভেন সার্কেল, আরামিত এবং রয়েল ইত্যাদি। যেসকল সিমেন্ট কারখানা আমদানিকৃত ক্লিনকার থেকে সিমেন্ট তৈরি করে তাদের অবস্থান মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মংলায়। ২০১০ সালে রেজিস্ট্রিকৃত সিমেন্ট কারখানার সংখ্যা ৭৪ হলেও বর্তমানে উৎপাদনে নিয়োজিত কারখানার সংখ্যা মাত্র ৩০টি। এই সকল সিমেন্ট কারখানার মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ২১ মিলিয়ন টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিটি ৫০ কিলোগ্রাম ওজনের সিমেন্টের বস্তা ৩৮০-৪৩০ টাকায় বিক্রয় হয়। স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে সিমেন্ট উৎপাদনের বিষয়টি স্থানীয় উৎসের ওপর নির্ভরশীল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, জয়পুরহাট ও সিলেট অঞ্চলে চুনাপাথরের খনি রয়েছে। ছাতক ও আয়েনপুর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি (সিলেট অঞ্চলে) স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চুনাপাথর থেকে সিমেন্ট উৎপাদন করে। এ দুটি সিমেন্ট কারখানার মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় তিন মিলিয়ন টন। কারখানা দুটি সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে।
সিমেন্ট শিল্পে আশাতীত অগ্রগতি সাধিত হওয়ার পেছনে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই বিপ্লবের প্রধান কারিগর। বাংলাদেশের সিমেন্ট এখন মানের ক্ষেত্রেও বিদেশি সিমেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা রাখে। বিদেশের বাজারও খোলা রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সরকারি নীতি ও সহযোগিতা। বাংলাদেশে সিমেন্টের মূল্য বিদেশের বাজারের চেয়ে অনেক কম। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও কম। বাংলাদেশ চাইলে দুবাই, আফগানিস্তান ও ভারতের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় সিমেন্ট রপ্তানি করতে পারে। শুধু প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। এ দেশে সিমেন্ট শিল্পের অনেক বড় সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট শিল্প কারখানার প্রসার ঘটানো সম্ভব। ফলে সিমেন্ট উৎপাদন শিল্পে বাংলাদেশ এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী। একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।