Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতান্ত্রিক বিপর্যয় থেকে দেশে দেশে মানবিক বিপর্যয়ের আলামত

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

রুশ-মার্কিন ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাঢোলের মধ্যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বর্বরতার নতুন নতুন নজির স্থাপন করছে জায়নবাদী ইসরাইলীরা। একদিকে ইউক্রেনে ইহুদী পুতুল সরকার ইউরোপসহ বিশ্বের জন্য বড় ধরণের সামরিক-অর্থনৈতিক হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ কথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে, চলমান পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো পক্ষের দৃশ্যমান বিজয় অর্জন অসম্ভব। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক যোগান বন্ধ হয়ে গেলে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রতিদিন শত শত বাড়িঘর ও জনপদ ধ্বংস, হাজার হাজার মানুষ হতাহত এবং ইউরোপে অভিবাসি মানুষের চাপসহ পুরো বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তার সংকট সৃষ্টি করেছে এই যুদ্ধ। যুদ্ধ বন্ধে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক তৎপরতা এগিয়ে নেয়ার বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে শত শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তার নতুন ঘোষণা মূলত যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতেই ভূমিকা রাখছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে দখলদারিত্বের যুদ্ধে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার (কয়েক লাখ কোটি ডলার) খরচ করে শূন্য হাতে ফিরে গেলেও এ সময়ে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও ওয়ার কন্ট্রাক্টররা হাজার হাজার কোটি ডলারের মুনাফা করেছে। আশির দশেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তানের আগ্রাসন মুজাহিদদের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ঠান্ডাযুদ্ধ তথা দুই পারমানবিক পরাশক্তির দ্বন্দ্ব আকস্মিকভাবে থেমে গেলেও ন্যাটোর তৎপরতা বন্ধের বদলে এর তৎপরতা ও শক্তিবৃদ্ধি অব্যাহত রেখে বিশ্বকে সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে আরো ভারসাম্যহীন করে তোলা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো কার্যত রণেভঙ্গ দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাণিজ্যের বিনিয়োগকারীরা নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য নতুন যুদ্ধক্ষেত্র ও রণকৌশল গ্রহণ করেছিল। নব্বই দশকে ইউরোপের শহরগুলোতে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার পর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একযোগে কয়েকটি সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনা ঘটিয়ে ওয়ার অন টেররিজম বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলমান জনসংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোই ছিল এই যুদ্ধের মূল টার্গেট। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মেইন থিয়েটারের পাশাপাশি আরব বসন্তের নামে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ দেশগুলোর রাজাদের জন্য নিরাপত্তাহীনতার নতুন বার্তা এবং লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রক্সি যুদ্ধের আউটলাইন ছিল পশ্চিমা মহাপরিকল্পনারই অংশ। এর মধ্য দিয়ে সউদী আরব, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রচুক্তিতে আবদ্ধ করা হয়। সেই অস্ত্রের গরিমায় নিজস্ব সামরিক জোট গঠন করে ইয়েমেনের উপর আগ্রাসন শুরু করে তা এখনো অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়া, চীন ও ইরানের কৌশলগত বন্ধুত্ব এবং সামরিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ওয়ার অন টেররিজমের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে অনেকটাই ব্যর্থ করে দেয়। ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের দাবী করতে পারেনি মার্কিনিরা। উপরন্তু সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সাথে তুরস্কের এরদোগান সরকারের বৈরীতা ও মতভেদ কমিয়ে আনতে রাশিয়ার মধ্যস্থতা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে।

পশ্চিমারা মুসলমানদের মধ্যে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা খুঁজে বেড়ালেও এসব অভিযোগ ও তকমার স্বপক্ষে কোনো অকাট্য তথ্যপ্রমান হাজির করতে পারেনি। ২০ বছর যুদ্ধ করেও আল কায়েদা, আইএস বা এ জাতীয় গোষ্ঠীর তৎপরতার পেছনে মূল ধারার কোনো ইসলামধর্মীয় গ্রুপ, দল বা গোষ্ঠীর সমর্থনেরও প্রমান দিতে পারেনি। পক্ষান্তরে কট্টর ইহুদী জায়নবাদী তৎপরতার কারণে ফিলিস্তিনী জনগণের উপর বর্বর আগ্রাসন, টার্গেটেড কিলিং এবং অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে নতুন করে ভূমি দখলের তৎপরতা বিশ্বের কাছে উলঙ্গভাবে ধরা পড়লেও বিশ্বসম্প্রদায়ের নীরবতা বিস্ময়কর। ইউক্রেন ও আঞ্চলিক যুদ্ধের নেপথ্যে জায়নবাদী ইসরাইলের অপতৎপরতা এবং যুদ্ধবাজ মার্কিনীদের ইন্ধন সারাবিশ্বের চোখ যখন ইউক্রেনে নিবদ্ধ, তখন মাত্র দুই বছরের কম সময়ের ব্যবধানে ইসরাইলের কট্টরপন্থী লিকুদ পার্টির নেতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তৃতীয়বারের মত আবারো ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একযুগ ইসরাইলের ক্ষমতায় থাকার পর ২০২১ সালে নানাবিধ দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ নিয়ে গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন নেতানিয়াহু। জায়নবাদীদের চির অভিষ্ট গ্রেটার ইসরাইল গঠনে নেতানিয়াহুর ভূমিকার কারণেই কট্টরপন্থী ইসরাইলীরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বারবার তাকেই বেঁছে নিচ্ছে। তার হাত প্রতিদিনই ফিলিস্তিনী শিশু, নারী ও বেসামরিক মানুষের রক্তে রঞ্জিত হলেও পশ্চিমা রাষ্ট্র কিংবা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কেউ তাকে সন্ত্রাসী, হত্যাকারী বা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বলে তকমা দিয়ে নিষেধাজ্ঞার চাপ পোহাতে হয়না। একপাক্ষিক অভিযোগ তুলে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে পশ্চিমা রাষ্ট্র ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিদ্রোহী গ্রুপের প্রক্সিযুদ্ধ কিংবা হাজার কোটি ডলার সামরিক আগ্রাসন চালালেও ইসরাইলের ক্ষেত্রে সম্পুর্ণ বিপরীত চিত্রই দেখা যায়। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরাইলের বিমান হামলা, শিশুহত্যা, হাসপাতাল-স্কুল ও জনপদ ধ্বংসের জন্য সব সময় পশ্চিমাদের তরফ থেকে ইসরাইলকে অভিযুক্ত করার বদলে পুরস্কৃত করে আসছে। এ থেকে স্পষ্টই প্রমানিত হয়, ইসরাইল মূলত ইঙ্গ-মার্কিনীদের সাম্রাজ্যবাদী ইসলামোফোবিক এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে। ইসরাইলের নির্বাচনে কোনো পরাশক্তি কিংবা আঞ্চলিক শক্তির দৃশ্যমান কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব থাকেনা। অথচ আরব ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পশ্চিমাদের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা যায়। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইসরাইলে গত ৪ বছরে ৫টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোনো নির্বাচনেই কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় নানা ইস্যুতে সরকারের ভাঙ্গা-গড়া অবিশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। তবে নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায় ফিরে আসতে কট্টর আরব বিদ্বেষী বেন গাভিরের সাথে হাত মেলাতে হয়েছে। নভেম্বরে নির্বাচনে বেন গাভীরের ওত্জমা ইয়াহুদি পার্টি তৃতীয় বৃহত্তম দল ও জোট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব পাওয়ার জন্য আরব বিদ্বেষী নেতার প্রকাশ্য হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বড় ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচনের একমাস আগে পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনী অধ্যুষিত শেখ জারাহ এলাকায় আরব বিদ্বেষী মিছিল থেকে বেন গাভিরকে নাকি ফিলিস্তিনীদের দিকে প্রকাশ্য অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিতে দেখা গেছে। আরব মুসলমানদের ভূমি দখল করে তাদেরকে উদ্বাস্তু করে যারা তাদের সামনে শ্লোগান দেয় ’আরবদের মৃত্যু চাই’, সে সব হিংস্র রাজনৈতিক নেতাদেরকে যদি তাদের জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায় তাতে অন্যের কিছু করার নেই। এটাই গণতন্তের মূল মেসেজ। এটা ইসরাইল বা ভারতে প্রযুক্ত হলেও অনেক দেশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র যেন অত্যন্ত সীমিত। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির নেপথ্য ভূমিকায় সেখানে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা ও জনমত চরমভাবে পদদলিত হতে দেখা যায়। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

ইসরাইলী জায়নবাদ আর হিটলারের ফ্যাসিবাদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। হিটলারের প্রতিপক্ষ শুধু ইহুদিরা ছিলনা। ইহুদী, কমিউনিষ্ট, সমাজতন্ত্রী ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোতে তাদের টার্গেট ছিল। কিন্তু ইসরাইলী জায়নবাদীরা সর্বতোভাবে প্রতিবেশী আরবদের উপর সামরিক আগ্রাসন, গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি ও ভূমি দখলের মধ্য দিয়ে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এক নাগাড়ে ১২ বছর ধরে ইসরাইল শাসনকালে ফিলিস্তিনীদের উপর আগ্রাসন, নৃশংস হামলা, টার্গেট কিলিং এবং তীব্র হিংসাত্মক উত্তেজনা জিইয়ে রাখাই ছিল নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকার মূল কৌশল। তবে এবারের নির্বাচনে তার চেয়েও কট্টর আরব বিদ্বেষী রিলিজিয়াস জায়নিজম পার্টির নেতা ইতামার বেন গাভিরের হাত ধরে গত ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টর জায়নবাদী সরকারের প্রধান হয়েছেন নেতানিয়াহু। সরকারের সবচেয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেই বেন গাভির পূর্ব জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণের অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থান পরিদর্শন করে তাদের নতুন সরকারের চেহারাটা আরব ও বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে উন্মোচিত করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের সাবেক অধ্যাপক, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বহুগ্রন্থের লেখক মারওয়ান বিশারা নেতানিয়াহুকে ইসরাইলী জায়নবাদের গডফাদার বলে অভিহিত করেছেন। ইসরাইলে নতুন সরকারের আত্মপ্রকাশের আগেই আল জাজিরা ও আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত মারওয়ান বিশারার লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম, ‘নেতানিয়াহু, দ্য গডফাদার অব মর্ডান ইসরাইলী ফ্যাসিজম’ শিরোনামের শোল্ডার সাব-হেডিংয়ে তিনি লিখেছেন, ইসরাইলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন আগামী সরকারই হতে যাচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে চরমপন্থী সরকার। এক সপ্তাহের মধ্যে বেন গাভির হিংস্র চেহারা নিয়ে আল আকসা প্রাঙ্গণে পা রাখার মধ্য দিয়ে বিশারার সেই আশঙ্কারই বাস্তব রূপ দেখা গেল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন শান্তি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, তখন ইসরাইলের নবগঠিত চরম ডানপন্থী সরকার ফ্যাসিবাদী হিংস্রতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সহাবস্থান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে বর্ণবাদী উগ্রতা চাপিয়ে দেয়ার রাজনৈতিক কারসাজি সেখানকার গণতন্ত্রপন্থী নাগরিকরা মেনে নিতে পারছে না। নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যেই ইসরাইলের রাজপথে প্রতিবাদী বিক্ষোভে নেমেছে সাধারণ মানুষ। সেখানকার নাগরিকরা তাদের দেশের সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ ও বিপন্ন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে রাজপথে নেমে এসেছে। গত সোমবার ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদে ইজরাইলীরা বর্তমান জোট সরকারকে লক্ষ্য করে ‘বিবলিক্যাল ডিজঅ্যাস্টার’ শ্লোগান লেখা প্লাকার্ড নিয়ে মিছিলে যোগ দিতে দেখা গেছে। ইসরাইলের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এবং সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে পুনরায় ক্ষমতার পাদপীঠে অবস্থানের নেতিবাচক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন নেতানিয়াহু। তাদের ভাষায়, গণতন্ত্র, নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটি এখন দুর্নীতি, জায়নিস্ট ফ্যাসিবাদ ও হিংসাত্মক রাজনীতির চারণভ’মিতে পরিনত হতে চলেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার রাজনৈতিক ভারসাম্য ভেঙ্গে গিয়ে একটি ইউনিপোলার বিশ্ব কাঠামো গড়ে তোলা হলেও প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশই স্বয়ংসম্পুর্ণ নয়। বিশ্ব সংস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার মোড়লদের একচক্ষু নীতি বিশ্বকে ক্রমশ অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল করে তুলছে। চরম পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার খেসারত দিচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ভরকেন্দ্রে অবস্থান করা পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রক কর্পোরেট অর্থনীতি ও মার্কিন ফেডারেল রির্জাভের নিয়ন্ত্রণ মূলত ইহুদি ব্যাংকার ও গোপন সংগঠনের হাতে। তাদের কাছে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষের শান্তি, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের নিরাপত্তা, জ্বালানি ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব স্বার্থ একটি আরেকটির উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা বিশ্বকে শুধুমাত্র ইসলামোফোবিয়ার টেবলেট খাইয়ে মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশগুলোকে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, দুর্ভীক্ষ-দারিদ্র্য ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ওয়ার অন টেররিজমের নামে আফগানিস্তানে ন্যাটোর দখলদারিত্ব কায়েমের আগেও দেশটি এশিয়ার অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত অনগ্রসর দেশ হিসেবে পরিগণিত হলেও সেখানে কখনো এমন দুর্ভীক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থা ছিল না। একইভাবে ইরাকও আট বছরের ইরাক-ইরান যুদ্ধের রেশ কাটিয়ে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। রিজিম চেঞ্জের গৃহযুদ্ধ শুরুর আগেএক দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা ৫ ভাগের উপরে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও রিজিম চেঞ্জের নাম করে চাপানো যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সামরিক বাজেট খরচ হয়েছে তার অর্ধেক যদি বিশ্বের দারিদ্র্য মোচনে ব্যয় করা হত তাহলে বিশ্ব থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর হয়ে যেত। দুই দশকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে। ইরাক দখলের আগে জায়নবাদী মিডিয়ার মিথ্যা প্রপাগান্ডার আশ্রয় নেয়ার পাশাপাশি বলা হয়েছিল, তারা সেখানে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বাগদাদের নারীরা বসরাই গোলাপ ফুল নিয়ে স্বাগত জানানোর খবরও প্রচারিত হয়েছিল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় লাখ লাখ ইরাকি শিশুর মৃত্যুর পরিসংখ্যান ইঙ্গ-মার্কিনীদের কাছে মূল্যহীন। এই মহূর্তে সিরিয়ায় লাখ লাখ মানুষ দুর্ভীক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ তৎপরতা বিষয়ক সমন্বয়ক, আন্ডার সেক্রেটারি মার্টিন গ্রিফিথ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, আফগানিস্তানের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ এখন অতি দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করছে। এদের মধ্যে অন্তত ২ কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। ইয়েমেনেও একই অবস্থা বিরাজমান। দেশগুলো দখল করতে হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করা হলেও দেশগুলোর পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তহবিল গঠন না করে উপরন্তু তাদের উপর নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোটি কোটি মানুষকে দুর্ভীক্ষ ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। পশ্চিমাদের এমন কর্মকাণ্ড গণহত্যার চেয়ে কম নয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞার সুযোগ সৃষ্টির ন্যুনতম আশঙ্কাও সম্মিলিত প্রয়াসে দূর করতে হবে। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে এবং ক্ষমতায় যেতে জনগণের ইচ্ছা, প্রত্যাশা ও অংশগ্রহণের অধিকারকে অগ্রাহ্য ও বঞ্চিত করা হলে জনগণ বিদেশি হস্তক্ষেপকেও স্বাগত জানাতে কুণ্ঠিত হয় না। সে ধরণের পরিস্থিতি আখেরে কারো জন্যই মঙ্গলজনক হয় না। সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে আমরা এখন দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আপাতত না থাকলেও একেবারে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর তা হলে, আমাদের অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন