Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে এ মাসেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সুপারিশ কার্যকর হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১ টাকা ১০ পয়সা বাড়বে। এখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ১৩ পয়সা। এটা বেড়ে হবে ৮ টাকা ২৩ পয়সা। উল্লেখ করা যেতে পারে, ভোক্তা পর্যায়ে সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ে ২০২০ সালের মার্চে। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত, কি উচিত নয়, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা রয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়বে। সব কিছুর দাম বাড়বে। মানুষের দুর্দশা চরমে উঠবে। করোনার প্রভাব থাকতে থাকতেই ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনৈতিকে অস্থির ও এলোমেলো করে দেয়। বাংলাদেশও তার প্রভাব পড়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় বড় আকারে। এ কারণে বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ও পরিবহনে খরচ বেড়ে যায়। এখন মূল্যস্ফীতি আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। মানুষের আয় বাড়েনি। ক্ষেত্র বিশেষে অনেকের আয় কমে গেছে। অনেক চাকরি হারিয়েছে। এমতাবস্থায়, দরিদ্র ও নিম্নউপার্জনের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষেরও এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। এমনি নাজুক সময়ে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অধিকাংশ মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা সীমা ছাড়িয়ে যাবে। পণ্য ও সেবার আরো মূল্যস্ফীতির ভার বহন করার ক্ষমতা তাদের নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা বলেছে, বিদ্যুতের দাম বাড়লে গার্মেন্টসহ সব শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়বে, পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। স্থানীয় বাজার ও রফতানি ব্যহত হবে। এর আগে গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখনই এ আশঙ্কা করা হয়েছিল, ভোক্তা পর্যায়েও দাম বাড়ানো হবে। সেটা যে এত তাড়াতাড়ি বাড়ানো হবে, সে ধারণা অনেকের ছিল না। বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেছেন, বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আছে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

সংকট ও উচ্চমূল্যের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কর্মসূচি নেয় সরকার। বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়। দিনেরাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লোডশেডিং করার কথা থাকলেও দেখা যায়, তারচেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এমনকি ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত কোনো কোনো দিন লোডশেডিং করা হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল থাকার সময় বিদ্যুৎ-প্রবাহের ওঠা-নামা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহের এহেন পরিস্থিতিতে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। শিল্পমালিকরা কার্যত অসহায় ও দিশাহারা হয়ে পড়ে। তারা বাধ্য হয়ে এমনও প্রস্তাব দেয় যে, শিল্প-কারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিলে বিদ্যুতের বাড়তি কিছু মূল্য দিতেও তারা প্রস্তুত আছে। তাদের সে কথা রাখা হয়নি। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, যার খেসারত এখনো তাদের দিতে হচ্ছে। ওদিকে বিদ্যুৎ প্রবাহের ওঠা-নামার কারণে মানুষের বৈদ্যুতিক গৃহসামগ্রী ব্যাপকভাবে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কে তাদের এই ক্ষতি পূরণ করবে? অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিকল্প হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দিতে পারবে? শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা ও ব্যবহার কম থাকে। শীত চলে গেলে বিদ্যুতের চাহিদা ও ব্যবহার বাড়বে। তখন কি চাহিদা মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে? এ নিশ্চয়তা দিতে পারেনি বিতরণ সংস্থাগুলো। তাদের মতে, উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। তবে শর্ত হলো, প্রয়োজনীয় গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে হবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের দায়িত্ব এটা। যদি এ বিভাগ এসব সরবরাহ করতে পারে, তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তার মতে, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল যদি বর্তমান দামে পাওয়া যায়, তাহলেও বিপিডিসির ঘাটতি থাকবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে, সরকারের ভর্তুকি বহাল আছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। তার এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভবপর হতে পারে। ১৭ হাজার কোটি টাকায় যে সম্ভব নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। সারকথা দাঁড়াচ্ছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা ছাড়াই গ্রাহকদের বর্ধিত বিদ্যুৎমূল্য দিতে হবে।

প্রশ্ন হলো, নিশ্চয়তা ছাড়া গ্রাহকদের বর্ধিত মূল্য গুনতে হবে কেন? হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকিই বা কেন দিতে হবে? সরকারের নয়, এ টাকা জনগণের। জনগণ কেন এত ভর্তুকি দেবে? এ কথা কারো অজানা নেই, সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অতি উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কেনে। তারপর গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করে কম দামে। কেনা- বেচায় যে বিরাট ফারাক, সেটাই ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করা হয়। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরকারের চুক্তি এমন যে, বিদ্যুৎ না কিনলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। তাতে বিদ্যুৎ না কিনেও সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মালিক অধিকাংশই সরকারি দলের অনুগত। সমালোচকরা বলে থাকেন, মুফতে তাদের বিরাট লাভের ভাগী করে দেয়ার জন্যই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল চালু রাখা হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই জঞ্জাল ছেঁটে ফেলা হলে প্রতিবছর এত ভর্তুকি দিতে হতো না, যখন তখন বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হতো না। কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তরফে বলা হয়েছে, চুরি, সিস্টেমলস, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। অথচ, এসব না করে গ্রাহকদের পকেট কাটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারের উচিত ভোক্তাদের পকেটে হাত না দিয়ে চুরি, অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা। এখাতে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তাহলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন