Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও রাজধানীর যাতায়াত মসৃণ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বহুদিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে। ২০১৮ সালে তো আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। শিক্ষার্থীদের সে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফে দুর্ঘটনা কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমা তো দূরের কথা, প্রতিবছরই বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৮২৯টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৭৭১৩ জনের। আহত হয়েছে ১২৬১৫ জন। ২০২১ সালের তুলনায় এ বছর দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার বেড়েছে যথাক্রমে ২৭.১৪ শতাংশ ও ২২.৭৪ শতাংশ। যারা দুর্ঘটনায় মারা গেছে, তাদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। তারা প্রায় শতভাগ রোজগারে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯৭৩টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৩০৯১ জনের। দুর্ঘটনা ও মৃতের এ সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। লক্ষণীয়, দুর্ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। সড়ক দুর্ঘনায় ক্ষতি হয়েছে ২৩৪৬০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১.৫ শতাংশের ওপর। ২০২২ সালে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৫৯টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ২৪৬ জনের। ২০২১ সালে ১৩১টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ১৩৯ জনের। এখানেও দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দুটিই বেড়েছে। বাড়ার হার যথাক্রমে ৯৭.৭০ শতাংশ ও ৭৯.৫৬ শতাংশ। মৃতের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৬০ শতাংশ। তার পরেই মোটরসাইকেল আরোহীর ২৬.৪৯ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ কয়েকটি দেশের একটি। মৃতের দিক দিয়েও। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকারের উপায় ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি। চালক, পরিবহন মালিক, যাত্রী-পথচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারোরই সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়নি। সরকারও এ ব্যাপারে অমনোযোগী। একটি দুর্ঘটনা, একটি প্রাণহানি মানে একটি পরিবারের নিরালম্ব হয়ে পড়া। এভাবে প্রতিবছর কত পরিবার যে বিপন্নদশায় পতিত হচ্ছে, তার খবর কেউ রাখে না। সড়ক দুর্ঘটনার মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি রোধ করতে হলে দুর্ঘটনা কমাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ঢাকা দেশের রাজধানী বটে। কিন্তু এ শহর মানুষ বসবাসের খুব উপযোগী নয়। দূষিত শহরের তালিকায় কদিন আগেও ঢাকা চতুর্থ বলে জানিয়েছে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। এমন কোনো দূষণ নেই, যাতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত নয় এ শহর। ধারণ ক্ষমতার অন্তত চারগুণ মানুষ বাস করে এখানে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই শহরের রাস্তাঘাটের সংখ্যা অপ্রতুল। তার মধ্যে প্রতিদিন শত শত নতুন যানবাহন নামছে রাস্তায়। যানজট নিত্যদিনের প্রায় সার্বক্ষণিক সমস্যা। ১০ মিনিটের পথ দুই ঘণ্টায়ও যাওয়া যায় না। প্রায় দুই কোটি মানুষের এ শহরে প্রতিদিন সড়কে কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, জ্বালানির কত অপচয় হয়, মানুষের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের কতটা হানি হয়, তার ইয়ত্তা নেই। কর্মঘণ্টা, জ্বালানি ও যানবাহনের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের তরফে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান দেয়া হলেও তা জিডিপির দুই শতাংশের কম নয়। শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতির হিসাব আসলে করা যায় না। যানজট কমিয়ে ঢাকায় চলাচল সহজ ও মসৃণ করা সম্ভব হলে এই অপরিমেয় ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতে পারে। যানজটমুক্ত চলাচল নিশ্চিত করার জন্য সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে ইত্যাদি প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। হানিফ, কুড়িল, মহাখালী, মগবাজারসহ কয়েকটি ফ্লাইওভার তো আগেই হয়েছে। ইতোমধ্যে বিআরটি ও মেট্রোরেলের অংশবিশেষ খুলে দেয়া হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলগেট পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হয়েছে, যা এবছরই খুলে দেয়া হবে। এর যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত অংশের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। হবে কিনা বলা মুশকিল। ইতোমধ্যে দফায় দফায় প্রকল্পের সময় ও অর্থ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কাজ সে অনুযায়ী হয়নি। ঢাকা শহরের জন্য মেগা প্রকল্পসহ দেশের প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রেই এটা সাধারণ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো প্রকল্পই নির্দিষ্ট সময় ও নির্ধারিত অর্থব্যয়ে সম্পন্ন হয়নি বা হয় না। এতে প্রকল্পের সেবা থেকে মানুষ যেমন বঞ্চিত থাকে, তেমনি জাতীয় অর্থের ব্যাপক অপচয়ও হয়ে থাকে। এই ‘অপসংস্কৃতি’ থেকে কবে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে, ভবিতব্যই বলতে পারে।

ঢাকার উন্নয়ন ও যানজট নিরসনে নেয়া প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে এতদিনে মানুষের যাতায়াত ও চলাচল অনেক সহজ হতো, যানজটের বেশুমার ক্ষতি কমতো এবং শহরের বাসযোগ্যতার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হতো। দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পগুলো বিশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কাজের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে তেমন কোনো সমন্বয় নেই। এ কারণে মানুষের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনারও শেষ থাকছে না। একই কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের তাকিদ দিয়েছেন। এ জন্য অর্থছাড় ও দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বলা বাহুল্য, তারপরও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি বা হচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের অমনোযোগিতা, অনভিজ্ঞতা ও পারঙ্গমতার ঘাটতি এর জন্য দায়ী বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সড়ক দুর্ঘটনা দেশের একটি অপ্রতিরোধ্য ও গুরুতর সমস্যা। এর সমাধানে অভিজ্ঞজনের পরামর্শ, প্রয়োজনীয় কর্মনকশা, উচ্চ আদালতের তাকিদ ও নির্দেশনা কম দেয়া হয়নি। কিন্তু এসব সুচারুরূপে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হয়নি। এর দায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা বিভাগ এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা আশা করবো, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও যানজট নিরসনে ত্বরিত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন