Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাদরাসার ‘ধর্ম ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে সকল ধর্মকে আঘাত করা হয়েছে

(গতকাল প্রকাশিতের পর)

জাকারিয়া শাহীন | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে মহান আল্লাহ তাআলা স্বয়ং নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি এই জাতিকে অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন নি। পবিত্র কুরআনে এর সুস্পষ্ট ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আদি মানব আদম (আ.)-কে পানি ও মাটি মিশ্রিত কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এই উপাদানের কথা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে বিভিন্ন বাচনভঙ্গিতে উল্লেখ করেন। ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা।’ (সূরা সাজদাহ: ৭)। ‘পঁচা কাদা থেকে তৈরি শুষ্ক ঠনঠনে মাটি।’ (সূরা হিজর: ২৬)। ‘এঁটেল মাটি।’ (সূরা সাফফাত: ১১)। ‘পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মাটি।’ (সূরা আর-রহমান: ১৪)। আর এই উপাদান থেকে আল্লাহ তাআলা তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেন। কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন নি। ‘আল্লাহ তাআলা তাকে (আদম) নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা ছোয়াদ: ৭৫)। তিনি তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করে তার শরীরে রূহ (প্রাণ) ফুঁকে দেন। ফেরেশতাদের নির্দেশ দেন তার সম্মানার্থে সিজদাহ করতে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি যখন তাকে সম্পূর্ণরূপে তৈরি করে ফেলব তার ভেতর আমার থেকে রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সম্মানার্থে সিজদায় পড়ে যেও।’ (সূরা সোয়াদ:৭২) ‘সে সময়কে স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি শুকনো কাদার ঠনঠনে মাটি দ্বারা এক মানব সৃষ্টি করতে চাই। তাকে যখন পরিপূর্ণ রূপ দান করব, তখন তোমরা সকলে তার সামনে সিজদায় পড়ে যেও। সুতরাং সমস্ত ফেরেশতা সিজদা করলÑ ইবলিস ব্যতীত। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল।’ (সূরা হিজর: ২৬-৩১)

অতঃপর আদম (আ.) থেকে তার স্ত্রীর হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। (সূরা আ‘রাফ:১৮৯)। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) ও স্ত্রী হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে বসবাস করার নির্দেশ দেন। একটি নির্দিষ্ট গাছের কাছে যেতে নিষেধ করেন। অতঃপর শয়তান তাদের মিথ্যা কথা বলে গাছের নিকট নিয়ে যায়। তারা উভয়ে শয়তানের ধোঁকার শিকার হন। ফলে জান্নাতে তাদের পোশাক খুলে যায়। তারা জান্নাতের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান ঢেকে নেন। (সূরা আ’রাফ: ১৯-২২)। অতঃপর আদম ও হাওয়া (আ.) নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চান। ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজ সত্তার উপর জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন ও আমাদের প্রতি রহম না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ (সূরা আরাফ: ২৩) অতঃপর আল্লাহ তাআলা আদম ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া এবং শয়তানকে পৃথিবীতে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আর বলেন, ‘তোমরা সেখানে জীবন যাপন করবে, সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে। আর সেখান থেকেই তোমাদের পুনরায় জীবিত করে আখিরাতে উঠানো হবে।’ (সূরা আ‘রাফ: ২৪-২৫)। দুনিয়াতে আদম ও হাওয়া (আ.) আসার পর আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়ের পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে নতুন প্রক্রিয়ায় মানুষের বংশধারা চালু করেন। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যুগ পরাম্পরায় বংশানুক্রমিকভাবে বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের বসবাস। এই প্রক্রিয়ার মূল উপাদান হচ্ছে নারী-পুরুষের মিশ্রিত শুক্রাণু, যার বর্ণনা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেন।

‘আল্লাহ তিনিই, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি (আদম) হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকেই তার স্ত্রীকে বানিয়েছেন, যাতে সে তার কাছে এসে শান্তি লাভ করতে পারে। তারপর পুরুষ যখন স্ত্রীকে আচ্ছন্ন করল, তখন স্ত্রী (গর্ভের) হালকা এক বোঝা বহন করল, যা নিয়ে সে চলাফেরা করতে থাকল।’ (সূরা আ‘রাফ: ১৮৯)। ‘অতঃপর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সূরা নিসা: ০১)। মায়ের গর্ভে সন্তানের আকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর তিনি তার (আদমের) বংশধারা চালু করেছেন নিঃসারিত তুচ্ছ পানি থেকে। তারপর তাকে (মায়ের গর্বে) সুষম করেছেন এবং তাঁর (আল্লাহ) নিকট হতে তাতে রূহ (প্রাণ) সঞ্চার করেছেন। আর তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সূরা সাজদাহ: ৮-৯, সূরা হজ্জ-৫)। ‘তাদের দু’জন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ বিস্তার করেছে।’ (সূরা নিসা: ৪)।

উল্লিখিত আয়াতসমূহ ছাড়াও পবিত্র কুরআনে আরো অনেক আয়াত রয়েছেÑ যা আল্লাহ কর্তৃক মানব সৃষ্টির সূচনাকে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে। এছাড়াও মানুষের নিপুণ সুন্দর আকৃতি, তাদের চলন-বলন, বাচনভঙ্গি, মেধা-বুদ্ধি, আবিষ্কার, সৃজনশীলতা ইত্যাদিও প্রমাণ করে, তারা এমনি এমনি বিবর্তনে সৃষ্ট নয়। বরং এক মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের সৃষ্টি করেছেন। আর তিনিই আল্লাহÑ যিনি সুনিপুণ কারুকার্যের ন্যায় মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা ত্বীন: ৪)।

আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত পবিত্র কুরআনে মানব জাতির ইতিহাস থাকার পরেও অপ্রমাণিত ধারণামূলক ইতিহাস মুসলিম শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া; ইসলামকে বিকৃত করার নীল নকশার বাস্তবায়ন। কুরআন নাযিলের পর এত বছরে আল্লাহর এই ভূপৃষ্ঠে মুসলমাদের এমন প্রকাশ্যে হাতে ধরিয়ে কুরআনের বিকৃতি শিক্ষা দেওয়ার দুঃসাহস ইতঃপূর্বে কেউ করেনি। আল্লাহ তাআলার কাছে এই জাতির উপর গজব নাযিল হওয়া থেকে পানাহ চাই। মানুষ এক মহান স্রষ্টা থেকে সৃষ্টি; এর প্রমাণ শুধু কুরআন ও মুসলিমদের বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ পৃথিবীর সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ আদিকাল থেকেই বিশ্বাস করে আসছে, মানুষের প্রথম পুরুষ ও নারীকে এক মহান সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। তাদের উভয় থেকে বংশানুক্রমিকভাবে পৃথিবীতে মানুষের বিস্তার ঘটে। যার বিশদ বর্ণনা তাদের ধর্মগ্রন্থসমূহে রয়েছে। যা প্রমাণ করে, বিবর্তনবাদ সকল ধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।

খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয়গ্রন্থ ‘পবিত্র বাইবেল’-এর পুরাতন নিয়ম (তাওরাত) অংশে ‘আদিপুস্তক’-এর প্রথম অধ্যায়ে ‘সৃষ্টির প্রথম মানুষ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ঈশ্বর প্রথম মানব-মানবীকে সৃষ্টি করেন এবং তাদের পৃথিবীতে বংশবৃদ্ধির নির্দেশ দেন। (আদিপুস্তক-১: ২৬-২৮) ‘বাইবেল’ এর ‘পুরাতন নিয়ম’ অংশ ইহুদিদেরও ধর্মগ্রন্থ। তারাও উপরিউক্ত ইতিহাসই বিশ্বাস করে। হিন্দুধর্মের ‘বেদ’, ‘মহাভারত’ ও ‘উপনিষদ’-এর মধ্যে মানুষ ও সকল সৃষ্টিরাজি মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনিভাবে সকল ধর্মের মানুষই এরূপ বিশ্বাস করে। সুতরাং, এমন ‘বিবর্তনবাদ’ স্কুল, কলেজ, মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্য বইয়ে অর্šর্ভুক্ত করে সকল ধর্মেকে আঘাত করা হয়েছে। এমন কাজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। (সমাপ্ত)


লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন