Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ আজ সর্বব্যাপী দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও অবক্ষয়ের শিকার। এর জন্য আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাপনার অনিয়ম, ভ্রান্তি ও দুর্বলতার দায় সবচেয়ে বেশি। দেশে ঘুষ-দুনীতি, লুটপাট, দখলবাজি ও অর্থপাচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রায় সবই উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারী ব্যক্তি। শিক্ষাব্যবস্থাকে শ্রেফ সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও উচ্চ গ্রেডের প্রতিযাগিতায় পরিনত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষাবাণিজ্যের কারখানায় পরিনত করা হয়েছে। এর ফলে সামাজিক বৈষম্য ও অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের বিস্তার ঘটেছে। শিক্ষাখাতে সরকারের অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের সুযোগে দেশে অসংখ্য স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। এক সময়ে সমাজের উচ্চবিত্ত, শিক্ষানুরাগী-দানশীল ব্যক্তিরা শিক্ষানুরাগ ও সমাজহিতৈষণা থেকে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিতে মূল ভ’মিকা পালন করলেও গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষায় ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক বিনিয়োগ বেড়ে গিয়ে শিক্ষার মূলধারাকে একটি বাণিজ্যিক প্রবণতার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। তথাকথিত নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জপিএ-ফাইভ অর্জনের প্রতিযোগীতায় ঠেলে দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি ছাড়াও একেকজন শিক্ষার্থীর পেছনে মাসে অতিরিক্ত হাজার হাজার টাকা খরচ করতে অভিভাবকদের বাধ্য করছে। শিক্ষায় এই ব্যয়বাহুল্য ও উচ্চ গ্রেডের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করে তুলেছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০২২ সালের গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যয়ের শতকরা মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করে সরকার। অবশিষ্ট ৭১ ভাগ বহন করতে হয় শিক্ষার্থীদের পরিবারকে। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী মাদরাসায় অধ্যয়ন করছে। খুব অল্প সংখ্যক আলিয়া মাদরাসার কথা বাদ দিলে মূলধারার ক্বওমি মাদারাসাগুলোতে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। এ হিসেবে শিক্ষায় সরকারি ব্যয় এখানে উল্লেখিত ২৯ ভাগের চেয়ে আরো অনেক কম হওয়ার কথা। ইউনেস্কোর এই প্রতিবেদনে প্রথমবারের মত দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার তুলনামূলক পর্যালোচনা স্থান পেয়েছে। ব্রাকের সহযোগিতায় প্রণীত রিপোর্টটি গত মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশী বেসরকারি প্রতিষ্ঠাননির্ভর। শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শতকরা ৯৪ভাগই বেসরকারি প্রতিষ্ঠাননির্ভর। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ হার শ্রীলঙ্কায়, ৮০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থান বাংলাদেশের, ৫৫শতাংশ। মাধ্যমিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিক্ষার্থীর হার ভারতের, ৫১ শতাংশ। আঞ্চলিক সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় শিক্ষাখাতে বিদ্যমান বৈষম্য এবং শিক্ষায় পারিবারিক ব্যয়বাহুল্য পুরো অঞ্চলে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে এর তীব্রতা প্রতিবেশী যে কোনো দেশের চেয়ে বেশী। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় শিক্ষাকে সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত ও সহজলভ্য করে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানেও প্রাথমিক স্তরে বিনামূল্যে শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শতকরা ৫৫ ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবারকেই বেসরকারি বিদ্যালয়ে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে(১৭) বলা হয়েছে, রাষ্ট্র: ক-একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক অঙ্গিকার পুরণে ব্যর্থতার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করে শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষ, সৃজনশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব সরকারের। সেখানে শিক্ষাকে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতামূলক পণ্যে পরিনত করার মধ্য দিয়ে যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে তার দায়ও সরকারের উপর বর্তায়। শিক্ষা অতিরিক্ত ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পা রাখার আগেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার গড় হার শতকরা প্রায় ৭৫ শতাংশ। গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হলেও শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ না থাকা এবং সরকারী নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক প্রবণতায় আক্রান্ত হয়েছে। শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্য দিয়ে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষাখাতে সরকারের বিনিয়োগ রাষ্ট্রের উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। শিক্ষাখাতে সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষায় সার্টিফিকেট বাণিজ্য, অনৈতিক প্রতিযোগীতা এবং ব্যয়বাহুল্য বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ভর্তি ও পুন:ভর্তির খরচ, কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনি, নোট-গাইডবুক ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়ায় পারিবারিক শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধির তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষায় সরকারি বাজেট বরাদ্দে বৈষম্য দূর করতে হবে। সরকারের ঘোষিত নীতি অনুসারে প্রাথমিক স্তরে বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করার সাথে সাথে মাধ্যমিক স্তরে সরকারি বরাদ্দ ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন