পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। কৃষি নির্ভর এ দেশের ফসলের জন্যে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা নদী থেকে পাওয়া যায়। দেশের মানুষের সাথে নদীর সম্পর্ক এক অকৃত্রিম বন্ধন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির যোগাযোগ, শিল্প, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নদীর অস্তিত্ব স্পষ্ট। বাঙ্গালিদের বলা হয়ে থাকে, মাছেভাতে বাঙ্গালি। এ মাছের যোগান আমরা নদী থেকে পেয়ে থাকি। সহস্রাব্দ বছর আগ থেকেই বাংলার মানুষের জীবনের সাথে নদী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। নদীপথে যাতায়াত সহজ ও আরামদায়ক হওয়ায় মানুষের যানবাহনের একসময় সহজ পথ ছিল নদী। সময় এবং ভাড়া সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ বেছে নিত নৌপথ।
একশ্রেণীর মানুষ যেভাবে নদীকে দূষিত ও অবৈধ দখল করছে, তা আমাদেরকে এক ভয়ংকর হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত চার দশকে দেশের প্রায় অর্ধেক নদী শুকিয়ে গেছে। থইথই পানি দিয়ে যে নদী পরিপূর্ণ থাকত সে নদী এখন পানি শূন্য। প্রতি বছর নদীর র্দৈঘ্য কমছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কমেছে প্রায় ১৯,২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় রয়েছে ৩৮৩টি নদ-নদী। এগুলোর বেশিরভাগেরই অবস্থা সংকটাপন্ন। নদ-নদী ও প্রাকৃতিক খাল রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করে। কিন্তু তাদের গৃহিত পদক্ষেপগুলো তেমন একটা নজরে আসে না। দূষণ ও ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত শিল্পায়ণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সেতু-কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে ছোট বড় অনেক নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ এলাকায় ছোট ছোট কালভার্ট-ব্রিজ অনেক নিচু করে বানানো হয়েছে, যার ফলে ব্রিজের নিচে দিয়ে বড় কোনো নৌকা বা লঞ্চ যাতায়াত করতে পারে না।
দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার হলেও নৌপরিবহনযোগ্য নৌপথের দৈর্ঘ্য বর্ষাকালে ৫৯৬৮ কিলোমিটার আর শীতকালে ৩৮৬৫ কিলোমিটার। নৌপথে বন্দর থেকে বন্দরে সহজে যোগাযোগ করা যায়। বাংলাদেশের প্রধান নদীবন্দরগুলোর মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা অন্যতম। এছাড়াও ভৈরববাজার, আশুগঞ্জ, চাঁদপুর, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, আজমিরিগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে নদীবন্দর রয়েছে। নৌপথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন, নৌপথের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ প্রধান দুটি সংস্থার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। এগুলো হলো, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌপথ রক্ষার জন্যে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, দেশের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথের খনন করবে নব্য বাড়ানোর জন্য। এতে ব্যয় হচ্ছে, প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ পরিকল্পনার আওতায় ১৭৮টি নদী রয়েছে, যাতে করে বিভিন্ন নদী বন্দর থেকে পণ্য সহজে এবং দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। ২০১৯ সালে অনুমোদন হওয়া এ প্রকল্পের শেষ হবার কথা রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে। পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ড্রেজিং মেটারিয়াল বা উত্তোলিত বালু নদী বা নদীর পাড়ে ফেলা যাবে না। কিন্তু ড্রেজিং প্রকল্পে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ নদীতে ফেলা হয়েছে। ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ নদীর পাড়ে এবং ২৭ দশমিক ১০ শতাংশ কৃষিজমিতে ফেলা হয়েছে। এটা নদীতে বা নদীর পাড়ে ফেলা উচিত না। নির্দেশনা না পালন করায় নদী আবার ভরাট হচ্ছে। এতে লক্ষ্য করা যায় যে, কিছুদিন পরেই আবার নদীতে নব্য সংকট দেখা দেয়। তাছাড়া খননের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় প্রক্রিয়াটি মন্থর হয়ে পড়েছে।
নদীপথে পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া সড়কপথ থেকে অনেক সুবিধা এবং ব্যয়ও তুলনামূলক অনেক কম। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতি টন কার্গো পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে যেখানে সড়কপথে ব্যয় সাড়ে ৪ টাকা, সেখানে রেলপথে আড়াই টাকা এবং নৌপথে খরচ মাত্র ১ টাকা। অভ্যন্তরীণ নদীপথ ব্যবহার করার কারণে প্রতি বছর বাঁচানো যেতে পারে পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ লিটার ডিজেল। এতে এক লাখ ৫৫ হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নৌপথের নাব্য রক্ষা করা গেলে কৃষিতে বছরে এক হাজার ১৯৭ কোটি ৮ লাখ ১৯ হাজার টাকা এবং মৎস্য খাতে তিন কোটি ৬৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় হতো। অন্যদিকে নৌপথের মাধ্যমে ১৩৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার টাকা বছরে আয় হতো। ভাঙন প্রতিরোধের ফলে সাশ্রয় হতো ১১ কোটি ২১ লাখ ৫১ হাজার টাকা; অর্থাৎ শুধু বড় ছয়টি নদীপথ খনন করে নাব্য ধরে রাখা গেলে বছরে প্রায় ১৪শ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো।
ভারতের দেওয়া বাঁধ তিস্তা ব্যারেজ ও ফারাক্কা বাঁধের কারণে পানিপ্রবাহের অনেক তারতম্য লক্ষণীয়। বাংলাদেশের উজানের ৫৪টি নদীর পানির উৎস হচ্ছে ভারত। এ বাঁধের ফলে পানির অভাবে বাংলাদেশের নদীতে চর ভেসে উঠেছে এবং ফসল উৎপাদনের পরিমাণ আগের তুলনায় হ্রাস পয়েছে। তাছাড়া সব ধরণের বর্জ্যপদার্থ নদীর পানিতে ফেলার ফলে নদী সজীবতা হারিয়ে ফেলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকার চার নদী ও খালে বিলে পাওয়া গেছে প্রায় ৭২ হাজার টনের বেশি বর্জ্য। এ বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে নদী ও পরিবেশ বাঁচানো যাবে না। অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলায় দেখা দিচ্ছে, অনেক পানিবাহিত জটিল রোগ। টেনারি, শিল্পকারখানা এবং মেডিক্যালের অধিকাংশ বর্জ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদীতে ফেলা হয়, যা নদীর নব্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ঢাকা থেকে বরিশালের নৌ পথের দূরত্ব ১৬৮ কিলোমিটার। যাত্রাপথে সময় লাগে প্রায় ৯-১২ ঘন্টা। নদীর অবৈধ দখলের কারণে এবং নদীতে চর জাগায় নৌযান অনেকটা ঘুরে যেতে হয়, যাতে অনেক সময় লেগে যায়। নিয়মিত খননের পাশাপাশি নদীগুলোকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। অবৈধ বালু উত্তোলন ও নদ দখল রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
ই-মেইল:[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।