Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পথশিশুদের সুরক্ষা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে

আলিম খান | প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

পথই যাদের আশ্রয় তারাই পথশিশু। নির্দিষ্ট কোনো পরিবার কাঠামোয় বেড়ে উঠে না বিধায় এদের জীবনের মৌলিক চাহিদার কোনটাই হয় না পূরণ। পথশিশুদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি যাবতীয় মানবাধিকার থেকে এরা থাকে বঞ্চিত। আবার, অদক্ষ থাকায় নাগরিক হিসেবেও এরা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাই এরা থাকে নাগরিক সুবিধার বাইরে। এদের সমবয়সী ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, খেলাধুলা করে, নাচগান করে। লালিত হয় মা-বাবার পরম স্নেহ-যত্নে। অথচ মানবেতর অবস্থায় এদের বছরের পর বছর সময় কেটে যায় খোলা আকাশের নিচে, মাঠে, বাস স্ট্রেশন, রেল স্টেশন কিংবা লঞ্চ ঘাটে। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার তথ্য মতে, পথশিশুরা যে খোলা জায়গায় থাকে সেখানে তাদের নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকতে পারে এরা। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে। খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নৈশপ্রহরীদের দিতে হয়। তারা পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়। বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই। তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য মতে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। বিআইডিএস ও ইউনিসেফের এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। কেবল ঢাকা শহরে রয়েছে সাত লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জনে। আর ২০২৪ সাল নাগাদ সংখ্যাটা হবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জন। বিপুল সংখ্যার এই জনগোষ্ঠী সমাজে সবচেয়ে অবহেলার স্বীকার। কোনদিন খেয়ে কোনদিন বা না খেয়েই পার হয় এদের বেলা। ফলে জীবনের মহান উদ্দেশ্য এদের কাছে অন্ন-বস্ত্রের অভাব পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। শিক্ষা মানুষকে রুচিশীল-মননশীল ও বিকশিত করে। আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। কিন্তু পথশিশুরা পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায় না। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকায় তারা বিকশিত হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। অধিকাংশের মধ্যেই নেই ব্যক্তিগত উৎকর্ষ। তাদের চিন্তা-চেতনার পরিসর সংকীর্ণ। সমাজে তাদের হেয় চোখে দেখা হয়। ফলে তাদের মধ্যে গড়ে উঠে না সামজিক মূল্যবোধ। তাদের নৈতিক মূল্যবোধ জাগরণেরও কোন সুযোগ নেই। অধিকাংশ পথশিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকারগ্রস্ত। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিবেদন বলছে, অর্থের অভাবে ৭৫ শতাংশ শিশু চিকিৎসকের কাছে যেতে পারে না। অসুস্থ হলে ৫৪ শতাংশ শিশুর দেখাশোনার কেউ থাকে না। পথশিশুদের অধিকাংশই ভুগছে অপুষ্টিতে। ফলে প্রতিনিয়তই তারা আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে। তারা নিয়মিত গোসল করতে পারে না। অধিকাংশ পথশিশুকেই খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করতে হয়। অন্য এক গবেষণার তথ্য মতে, ৫৫ শতাংশ পথশিশুই স্বাস্থ্যের দিক থেকে স্বাভাবিক নেই এবং ৬৪ শতাংশ শিশুর নিজেকে পরিচালনার সক্ষমতা নেই। এ জন্য তারা সামাজিক সমস্যাবলীতে জড়িত হচ্ছে গভীরভাবে। যেমন: জীবনের ভারসাম্য হারিয়ে ডাকাতি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, ছুরিকাঘাত, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানাবিধ অবৈধ কাজ করে থাকে তারা। বর্তমান সমাজে বিরাজমান আতঙ্ক ‘মাদককাসক্তি’। মাদকের গ্রহণ ও কেনাবেচার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পথশিশুরা। অভিভাবকহীন হওয়ায় মাদক ও চোরাকারবারী চক্র খুব সহজেই স্বল্প মূল্যে এদেরকে কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশ শিশু ফোরামের তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশ পথশিশুই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদকাসক্তে আসক্ত। পত্রিকার তথ্য মতে, দেশের ২১ শতাংশ পথশিশুকে মাদকাসক্তের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে। আর পথশিশুর ৫৮ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে যুক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)-এর গবেষণায় এ চিত্র অবলোকন করা যায়। অধিদপ্তরটি ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে শিশুদের মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার করার তথ্য প্রকাশ করেছে। গবেষকদের মতে, পথশিশুরা অন্যান্য মাদকসেবীর তুলনায় অতি সহজেই মাদক সেবন করে থাকে। মাদকাসক্তের মধ্যে ৫৩ শতাংশ শিশু সরাসরি কারবারিদের থেকে মাদক ক্রয় ও লেনদেন করে থাকে। পথশিশুদের মধ্যে ১৪ শতাংশ শিশুর মতে, ১০ বছর হওয়ার আগে থেকেই মাদক ব্যবহার করে আসছে তারা। এর জন্য মাদকের সহজলভ্যতা ও সরবারহতা যেমন দায়ী তেমনি এদের অশ্রয়হীন অমানবিক অবস্থা অধিকতর দায়ী। নেশাদ্রব্যের মধ্যে বেশির ভাগ আসক্ত হচ্ছে গাঁজায়। কারণ, গাঁজার দাম তুলনামূলক অন্যান্য মাদকের চেয়ে কম। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুরা গাঁজা সেবনে আসক্ত। ডান্ডিতে আসক্ত ১৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু। এছাড়া পথশিশুরা অন্যান্য মাদকেও আসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়েও তারা লিপ্ত হচ্ছে নানান ধরনের অপকর্মে। পথশিশুদের প্রায় শতভাগই কোন না কোনভাবে শিশুশ্রমের সাথে যুক্ত। বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে এরা। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে কুলি, হকার, রিকশা শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদকবাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক প্রভৃতি। তাছাড়া, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এদের নিয়োজিত করা হয়। সেই ভোর থেকে কাজ শুরু হয়ে রাতের অনেকটা সময়জুড়ে কাজ করতে হয় এদের। একটু ভুল হলেই মালিকের হাতে খেতে হয় মার। কখনো কখনো হারাতে হয় চাকরি। সারাদিনে কাজের ধরন বুঝে ২/৩ বেলা খাবার পায় এই শিশুশ্রমিকরা। দিনশেষে ২০ থেকে ৫০/৬০ টাকা কিংবা মাস শেষে ৫০০/৬০০ টাকা পেয়ে থাকে, যা তাদের শ্রম এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। অনেক সময় তাদের পারিশ্রমিক না দিয়েই বিদায় করা হয়। মালিক পক্ষের কাছে কোনো দাবি তুললেই চাকরিচ্যুত হতে হয়। এভাবেই চলছে তাদের যাপিত কষ্টময় জীবন। ফলস্বরূপ, এই বিপুল-সংখ্যক পথশিশুর একটা বিশাল অংশই জড়িয়ে পড়ে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। উঠতি বয়সী পথশিশুরা মিছিল মিটিং, বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউনে কিংবা হরতালের পিকেটিংয়ে অহরহ অপব্যবহৃত হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে কিংবা একবেলা পেটপুরে খাওয়ার বিনিময়ে এসব দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে এসব পথশিশু। শোডাউন ছাড়াও পিকেটিং, ভাঙচুর কিংবা ককটেল নিক্ষেপের মতো বিপজ্জনক কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। পথশিশুদের মধ্যে একটা বড় অংশ হলো মেয়েশিশু। এসব মেয়েশিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার› হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার। তাছাড়া এদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে নেই কোন সচেতনতা কিংবা যত্ন। এভাবেই বেড়ে উঠছে ক্রমবিকাশ এই জনগোষ্ঠী। তাদের মানবাধিকার যেমন লঙ্ঘিত তেমনি নাগরিক অধিকার উপেক্ষিত। ফলে, নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে তারা অপারগই থেকে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার, কিছু আর্ন্তজার্তিক সংস্থা ও এনজিও এই বিষয়ে কাজ করছে তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধ- শতাব্দী পার হলেও পথশিশুদের জন্য প্রণয়ন হয়নি সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা। বাস্তবায়ন হয়নি কার্যকর কোনো পরিকল্পনা। ফলে বাংলাদেশের এই যুগসন্ধিক্ষণে পথশিশু সমস্যা প্রকট হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের প্রধান কাজই হলো জনকল্যাণ সাধন। জনগণ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উপাদান। রাষ্ট্রের উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তি তৈরির কোন বিকল্প নেই। এই পথশিশু জনগণেরই একটি বৃহৎ অংশ। পথশিশু সমস্যা সমাধান না হলে, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে এই পথশিশু সমস্যা। আমাদের মাথাপিছু আয়, জিডিপির আকার, জাতীয় বাজেটের বিস্তৃতি এবং উন্নয়ন সূচক জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমাদের এ অর্জন ব্যাহত হবে। পথশিশু সমস্যা কেবল জাতীয় নয় এটি একটি সামাজিক সমস্যাও। তাই এই সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে কার্যকর সরকারি উদ্যোগ যেমন নিতে হবে, তেমনি সমাজের প্রতিটি স্তরেরই থাকতে হবে সচেতনতা। তাদের মানবাধিকার যেন খর্বিত না হয় সে দিকটা যেমন নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি নাগরিক অধিকারও রক্ষা করতে হবে। পথশিশুদের প্রতি হতে হবে সহানুভূতিশীল। তাদের সাথে করতে হবে উদার আচরণ। মানবতার জাগরণই দিতে পারে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান।

লেখক: কবি ও সংগঠক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন