Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানিলন্ডারিং রুখতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

মো. আতিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রতিটি দেশেই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশে অর্থ পাচার এক বিরাট বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে এহেন অপরাধের জন্য বিশেষ আইন থাকলেও আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি অনৈতিক পন্থায় দেশের টাকা বিদেশে পাচার করছে। আবার অনেকেই ওইসব টাকা দ্বারা সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এটা দেশের স্থিতিশীলতা, তথা জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থে বিরাট হুমকি। এমন এক পরিস্থিতিতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে এ সংক্রান্ত আইনটির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ।

যদিও সরকার অর্থ পাচার নিরোধ বা বন্ধের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ পাশ করেছে; যা ২০১৫ সালে প্রয়োজনের নিরিখে আংশিক সংশোধিতও হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী, বৈধ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে অর্থ-সম্পত্তি প্রেরণ বা পাচার কিংবা দেশের বাইরে উপার্জিত সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে, তা ফেরত না আনা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অর্জিত অর্থ বা প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, থেমে নেই অর্থ পাচার। দেশের সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে এই ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে দৃশ্যমান ও কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যাতে অন্য কেউ একই ধরনের অপরাধ করতে ভয় পায়।

আমাদের দেশে ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। এটা জারির মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতকে অপরাধমুক্ত করার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। সরকারের সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া বর্তমান সরকার দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে। সরকারের এ নীতি বাস্তবায়নে বিএফআইইউ বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে, তারপরও অর্থপাচার কমছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, মূলত তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয় মানি লন্ডারিং। আর এই কাজটি করতে যে তিনটি ধাপ পার করতে হয় তাকে বলে ঝঃধমব ড়ভ গড়হবু খধঁহফবৎরহম. অবৈধ অর্থ কিংবা সম্পদকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঢোকানোর মাধ্যমে শুরু হয় মানি লন্ডারিং। এটি হতে পারে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ডিপোজিট হিসেবে ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখার মাধ্যমে; অর্থনীতির পরিভাষায় এ ধাপটি পরিচিত ‘চষধপবসবহঃ’ নামে। এরপর শুরু হয় লেনদেন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে অর্থ ব্যাংকে ‘প্লেসমেন্ট’ করা হলে তা একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে শত শত ভুয়া অ্যাকাউন্টে লেনদেন শুরু করা হয়। এ ধাপকে বলা হয় ‘খধুবৎরহম’। আর শেষ ধাপটি পরিচিত ‘ওহঃবৎমৎধঃরড়হ’ বা সমন্বয়করণ নামে। অর্থাৎ এ ধাপে পুরো অবৈধ সম্পদটিকে বৈধভাবে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে অবৈধভাবে আয়ের মাধ্যমে অর্জিত টাকাকে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদিও মানি লন্ডারিংকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু সবসময় যে এ তিন ধাপে ব্যাপারটি ঘটে, বিষয়টি এমন নয়। বর্তমানে ইলেকট্রনিক মানি, হুন্ডি, অফশোর ব্যাংকিং, ডার্ক ওয়েবের কারণে মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়াটি আরো জটিল হয়ে উঠছে।

সাধারণভাবে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং ঘটে ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে বৈশ্বিক আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৩ সালে এসে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ধারণা, কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অর্থ পাচার তথা মানি লন্ডারিংয়ের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে গেছে।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের কত টাকা জমা আছে তার একটি ধারণা প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। ২০২০ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ২০১ কোটি টাকারও বেশি। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি এ তথ্য প্রকাশ করে। যদিও সেখান থেকে গ্রাহকের বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয় বা টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। এ গোপনীয়তার নীতির কারণে সারা বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশি ধনকুবেররা কীভাবে সেই অর্থ সুইস ব্যাংকে পাঠান, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হুন্ডি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালেই এ অর্থ পাচার হচ্ছে।

প্রতিবছর কত টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয় সেই সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথাও নেই, যা দুঃখজনক। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র মোতাবেক, সম্প্রতি কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আদালতে আসছে, সেগুলো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো, অর্থাৎ বেশিরভাগ ঘটনা কেউ জানেই না।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর একটি হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কারসাজি, আরেকটি পন্থা হলো হুন্ডি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়; ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। একইভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না। টাকা পাচারের পুরো বিষয়টি যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে, সেজন্য সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। অর্থ পাচারের বিষয়গুলো নজরদারির জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি ইউনিট গঠন করেছে অনেক আগেই। এর নাম ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশের বাইরে ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি প্রতিবছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য শর্তসাপেক্ষে অর্থ নেওয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেওয়া নিষিদ্ধ। তাহলে অনেক বাংলাদেশি কানাডায় বাড়ি কিনেছেন কীভাবে? সূত্র মোতাবেক, কানাডায় যে কোনো ব্যক্তি বাড়ি ক্রয় করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কানাডার নাগরিক না হলেও কোনো সমস্যা নেই। যারা পুরোপুরি নগদ টাকা দিয়ে বাড়ি ক্রয় করেন, তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী যে রপ্তানি করেন, সেখান থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশের ব্যাংকে রাখেন। সে টাকা বাংলাদেশে আসছে না। একটি দেশ থেকে টাকা তখনই পাচার হয়, যখন সেখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগ আস্থা কম থাকে।

যদিও অর্থ পাচারের মূল উৎস বা মাধ্যম নানামুখী, যেমন বিদেশে বিনিয়োগের আড়ালে অর্থ পাচার, দুর্নীতি বা অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার মতো অবৈধ ব্যবসা-অর্জিত অর্থ বিদেশে নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পাচার, ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং’ বা মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার, উন্নত সুযোগ-সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে রাখা এবং নিজেও গোপনে ঐ দেশের নাগরিক হয়ে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য অর্থ পাচার করে জমা করা, অনেক সময় দেশে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী ‘নিরাপদে’ দেশে অর্থ পাচার করেন, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ‘ট্রান্সফার মিস প্রাইসিং’-এর মাধ্যমেও অর্থ পাচারের আশঙ্কা থাকে। এই বিষয়গুলো দ্রুত চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কেননা মানি লন্ডারিং দেশের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থার গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। অপরাধীরা অপরাধমূলক কর্মকা-ের দ্বারা অবৈধভাবে আহরিত অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বৈধ করার প্রয়াস পায়, অর্থাৎ নেপথ্যে অন্য অপরাধ সংঘটিত হয়। এ ধরনের অপরাধ থেকে অর্জিত অর্থ দ্বারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলা আগে তদন্ত করত শুধু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা দেখাশোনাও করত দুদক। তবে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের পর থেকে দুদুকসহ পাঁচটি সংস্থা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়। এটি একটি প্রশংসাসূচক উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সর্বপ্রথম সরকার এবং তারপর গঠিত সহযোগী সংগঠনসমূহকে সুচারূভাবে তদন্তপূর্বক কাজ করতে হবে। দেশ ও দেশের সার্বিক অগ্রগতি বিশেষ করে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধে মানি লন্ডারিং রুখতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হতে হবে।


লেখক: সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন