Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বিতর্ক

| প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশকে নিয়ে দুই শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বা বিষয় বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিতর্কের উপলক্ষ হোক, সেটা সঙ্গতকারণেই কাম্য নয়। বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সাম্প্রতিককালে জোরদার হয়ে উঠেছে। একদা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে কোল্ডওয়ার চলমান ছিল। গোটা বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর এই কোল্ডওয়ার আপনা আপনিই স্তিমিত হয়ে যায়। দ্বিধাবিভক্তিও আর আগের মতো থাকে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ফের কোল্ডওয়ার শুরু হয়েছে। এবং ক্রমাগত তা জোরদার হচ্ছে। একই সঙ্গে দুই শক্তির প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই অভিমত, ইউক্রেন যুদ্ধ আসলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বলে কথিত দেশগুলো। রাশিয়ার বলয়ে আছে শক্তিমান চীন ও অল্প কিছু দেশ। ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে অশান্ত-অনিরাপদ করার ঝুঁকির মধ্যে যেমন ফেলেছে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক মন্দার কবলে নিক্ষেপ করেছে। দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন বাংলাদেশের কোনো ইস্যুতে পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে তখন আমাদের বিচলিত না হয়ে উপায় থাকে না। বাংলাদেশের কোনো ইস্যু আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হোক কিংবা কোনো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা জড়িয়ে পড়ি, সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। অথচ, সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।

ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ১৪ ডিসেম্বর গুমের শিকার হওয়া ‘মায়ের ডাক’ নামীয় সংগঠনের সংগঠকের শাহিনবাগের বাসায় যান সেখানে পূর্ব নির্ধারিত একটি বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য। বৈঠক চলাকালে ‘মায়ের কান্না’ নামক অপর একটি সংগঠনের লোকেরা ওই বাসার সামনে অবস্থান নেয়। বাসায় ঢোকার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায়, নিরাপত্তাজনিত কারণে বৈঠক শেষ না করেই পিটার হাস বেরিয়ে আসেন। অপেক্ষমান লোকেরা তার গাড়ি ঘিরে ধরে। পরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পরের দিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ডেকে পিটার হাসের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানানো হয়। ঘটনার শুরু এভাবে। পিটার হাসের এই তৎপরতাকে বাংলাদেশ সরকার ভালো চোখে দেখেনি। সরকার দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা রাষ্ট্রদূতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা রকম মন্তব্য করেন। অনেকে একে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন। বলেন, এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী ও ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই ইস্যুতে রাশিয়া হঠাৎই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবেশ করে। গত ২০ ডিসেম্বর রাশিয়ার ঢাকাস্থ দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়ে বলে, মস্কো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করেছে। বিবৃতিতে নামোল্লেখ না করে আরো বলা হয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে যারা নিজেদের ‘বিশ্বের শাসক’ মনে করে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কাজ চলছে। এই বিবৃতির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক টুইটে বলে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ হস্থক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া, এটি কি ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? এর পর ২২ ডিসেম্বর নিয়মিত ব্রিফিংয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাখঢাক না করেই বলেন, ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দেশটির হস্তক্ষেপের চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার বিষয়ে নিশ্চিতে বরাবরই সোচ্চার। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ বিষয়টিও তার বক্তব্যে আনেন। বলেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি) নির্বাচন স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়ে প্রকাশ্যে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। রাশিয়া বিশ্বাস করে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এ ধরনের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। দেখা যাচ্ছে, পিটার হাসের শাহীনবাগে যাওয়া, নির্বাচন ও মানবাধিকার ইত্যাদি প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে রাশিয়ার বক্তব্যের প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। এ থেকে এমন একটি ধারণা তৈরি হতে পারে, মার্কিন হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, সখ্য গড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এটা মনে করতে পারে। আর যদি করে, সেটা আমাদের জন্য শুভ হবে না। এই প্রবাদটি কারো অজানা নেই, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’ এর নিকটতম প্রমাণ ইউক্রেন। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ এই যুদ্ধে ইউক্রেন এখন ধ্বংস্তূপ। কাজেই, অভিজ্ঞতা থেকে, নজির থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কোনো শক্তিদ্বন্দ্বে শামিল হওয়া ঠিক হবে না।

রাশিয়া আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। স্বাধীনতাযুদ্ধে থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা ও অবদান আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি। কিন্তু কী কারণে রাশিয়া বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাগযুদ্ধে জড়ালো, সেটা আমাদের জানা নেই। তার এহেন অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ভুলবার্তা দিতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট অবস্থান আছে, যার কোনোটা হয়তো রাশিয়ার পক্ষে, কোনোটা বিপক্ষে। এটা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থের অনুকূলে অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নেয়। সব রাষ্ট্রই সেটা করে। বিশদ বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের বাণিজ্য, শিক্ষা, যাতায়াত, বিনিয়োগ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বেশি সম্পর্ক ও যোগাযোগ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান প্রভৃতি দেশ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী, বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্যিক অংশীদার। কোনো কারণে, তাদের সঙ্গে সম্পের্কের টানাপোড়েন দেখা দিলে এসব ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যা আমাদের জন্য হতে পারে বিপর্যয়কর। আমাদের রফতানি বাণিজ্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্ভর। ওইসব দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশিও রয়েছে। এসব কথা আমাদের ভাবতে হবে। এমন কিছু কোনোভাবেই করা ঠিক হবে না, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এই সারকথা দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন