Inqilab Logo

বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

একনায়কতন্ত্রের মার্জিতরূপই কর্তৃত্ববাদ

কৃষিবিদ শাহাদত হোসেন বিপ্লব | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

সুইডেন ভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান IDEA বিশে^ গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত Global State of Democracy 2022 প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদী দেশের তালিকায় স্থান দিয়েছে। গত বছর একই প্রতিষ্ঠান একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, দুনিয়া জুড়ে বড় সংখ্যক দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে যাচ্ছে। বিশে^র জনসংখ্যার ৭০% মানুষ বসবাসকারী দেশসমূহে গণতান্ত্রিক শাসন কার্যকর নেই অথবা গণতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে বাস করছে।| Oxford Dectionary of Politics G Authoritarianism বা কর্তৃত্ববাদ হচ্ছে, একধরনের শাসন ব্যবস্থা, যেখানে সরকার জনগণের কাছ থেকে প্রশ্নহীন অনুগত্য আশা করে, জনগণের বিশ^াস ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে। ব্যক্তি স্বাধীনতার তোয়াক্কা করে না। সাধারণভাবে স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্রের শৈল্পিক বা মার্জিতরূপকে কর্তৃত্ববাদ বলা হয়। যেখানে নির্বাচন আছে কিন্তু গণতন্ত্র নেই।
আটক, নির্যাতন ও মামলা বেশির ভাগ সময়ই কর্তৃত্ববাদী নেতাদের দীর্ঘদিন গদিতে থাকতে সাহায্য করে। একুশ শতকের নব্য একনায়কেরা এখন ভোট জালিয়াতি করে গদিতে থাকার বৈধতা দাবি করে। যে সব দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার রয়েছে, সে সব দেশে বিরোধীদের উপর সরকারিভাবে উৎপীড়ন চালানো হয়। বিক্ষোভকে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো নির্যাতন দিয়ে কয়েকদিনের জন্য থামিয়ে রাখতে পারছে, কিন্তু একেবারে তা উবে যাচ্ছে না। সবচেয়ে সফল স্বৈরাচার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শুধু বিরোধীদের নির্যাতনের পথ বেছে নেয় না। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে নিজের লোকদের সেখানে বসিয়ে তা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং যারা তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করে, সেই ক্ষমতাধর সহযোগীদের অবাধে দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়ে দেয়। ফলে দেশটির অভিজাত শ্রেণি ও প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান কর্তৃত্ববাদী সরকারের অনুগত থাকে।
গবেষকদের মতে, নির্বাচন ব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদ(Dissection) হলো কর্তৃত্ববাদের মূল নিয়ামক। আরো ৩টি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় কর্তৃত্ববাদের অনুষঙ্গ(Accessories) হিসেবে কাজ করে। যথা: ১) বিরোধী রাজনৈতিক মতকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া। ২) কর্তৃত্ববাদের নীতিগত প্রতিষ্ঠানিকীকরণ (Institutionalization)। ৩) ধর্মীয় নেতাদের রাজনৈতিক ব্যবহার। এই তিনটির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সর্বনাশ সাধিত হয়। একজন গবেষক ডিজিটাল আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগের কারণে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের দেশ’ এবং ২০১৮ সালে নিশিথ রাতের অনিয়মপূর্ণ ও অস্বাভাবিক নির্বাচনের সরকারকে ‘সাইবার স্বৈরাচার’ বলে অভিহিত করেছেন (নয়া দিগন্ত, ২৯-০৭-২২)। ফরেন পলিসি পত্রিকায় সুমিত গাঙ্গুলী ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের পরিহাস’ আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনাকে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার পত্তনকারী (Founder) আখ্যা দেন।
জেনেভা ভিত্তিক কফি আনান ফাউন্ডেশন এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছে, সময়মত ভোটগ্রহণই নির্বাচনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের কণ্ঠস্বর ও রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলনই মূল লক্ষ্য। নির্বাচন মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি প্রক্রিয়ামাত্র। যে কোনো সরকারের বৈধতার পক্ষে একটি মাত্র হাতিয়ার হলো, বৈধ, স্বচ্ছ ও জবাবদতিহিমূলক নির্বাচন। গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত কোনো দেশের নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন Level Playing Field তৈরি করা। ক্ষমতাসীন মহল বিরোধী পক্ষের অংশগ্রহণে যত বাধার সৃষ্টি করবে, নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ তত তীব্র হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকদিন ধরেই বলে যাচ্ছেন, সমতা ভিত্তিক (Equality based) এবং টেকসই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি (Sustain Economic and Political Progress) নিশ্চিত করতে না পারায় দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের উত্থান ঘটছে, যারা গণতান্ত্রিক রীতি নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নষ্ট করে ফেলছেন। দুর্বল রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, দুর্বল আইনের শাসন, উচ্চ বৈষম্য ও দুর্নীতি গণতন্ত্রে ক্ষয় ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে। এ সময়ে এমন অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতার উত্থান ঘটেছে, যারা নিজের দেশে ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজে ভূমিকা রাখছেন।
২০১৪ সালের বিনা ভোটের এবং ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী, বেতনভুক্ত বুদ্ধিজীবী ও মৌসুমী বিবেকবানদের প্রাত্যহিক মন্ত্রই ছিলো, বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা যাবে না। যে কোনো মূল্যে বিএনপি’র ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি। অথচ, যে জনগণের স্বার্থের কথা, তরুণদের ভবিষ্যতের কথা, কৃষকের সমস্যার কথা, শ্রমিকের চাকরি সুরক্ষার কথা, নারী ও শিশুর নিরাপত্তার কথা বলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করলো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করলো সেই জনতা-কৃষক-শ্রমিক-তরুণ-নারীর অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, বরং খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। ফলে বিভিন্ন লীগ পেটোয়া বাহিনীতে এবং পুলিশ সরকারের অপকর্মের সহায়ক (Auxilliary) বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক লুট স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি সরকারের অনাচার মেনে নেই, নিজেকে বিবেক বর্জিত ও পলায়নপর মানুষ হিসেবে ঘোষণা করি এবং বেশিরভাগ মানুষই যদি সুবিধা ভোগী বা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাই, তাহলে এই সরকার আরো জেঁকে বসবে। সম্পূর্ণ থেমে যাবে। গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে।
কর্তৃত্ববাদী নেতারা অনেক সময় এমন নির্যাতনমূলক তৎপরতা শুরু করেন, যা এক সময় তার জন্য বুমেরাং হয়ে আসে এবং তার জের ধরেই তাকে ক্ষমতাচুত্য হতে হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের জন্য শহরের মধ্যবিত্ত ও শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিক শ্রেণিসহ সেই দেশের অন্তত ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষকে আন্দোলনে নামতে হয়। এই পরিমাণ লোক সক্রিয়ভাবে অংশ নিলে আন্তর্জাতিক বিশে^র পক্ষে উদাসীন থাকা অস¤ভব হয়ে ওঠে (শেলী ইংলিস, ইউনিভার্সিটি অফ ডেটন)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী বলেছেন, ‘বিএনপি যে জনসমর্থন দেখিয়েছে সামনে বিরোধী জোট আরও ভারী হচ্ছে। তাতে জনসমর্থন আরো বৃহত্তর রূপ নিলে, জনগণের পক্ষে থাকা বাইরের শক্তির কাছ থেকে সুবিধা পাবে বিএনপি’।

লেখক: যুগ্ম-সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী কৃষকদল কেন্দ্রীয় কমিটি



 

Show all comments
  • Mahbubul Alam ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ১০:৫৪ এএম says : 0
    অসাধারণ লিখেছো বিপ্লব!চালিয়ে যেকে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Bakar Siddique ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:৫০ পিএম says : 0
    লেখা খুবই তাত্বিক। সবাই এই লেখার মূল্য বুজবে না। তবু লিখতে হবে। একটা লেখা লেখলে অনেক পড়তে হয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন