Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

এ পৃথিবীতে আছে অনেক দেশ, অজস্র জাতি। কোথাও প্রাকৃতিক, কোথাও ভৌগোলিক কারণে এক দেশ অন্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। আবার কোথাও বা রাজনৈতিক কারণে এক জাতি অন্য জাতি থেকে আলাদা। রাজনৈতিক কারণে এমনকি এক দেশ বা এক জাতিরও দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। আমাদের বাংলাদেশ, এশিয়া মহাদেশের কোরিয়া, পাশ্চত্যের জার্মানিও এক সময়ে ভাগ হয়েছিল। বর্তমানে আমেরিকাতেও তার নিদর্শন মেলে। কিন্তু যত দেশ বা জাতি এ পৃথিবীতে থাকুক না কেন, মানুষের প্রথম পরিচয় মানুষ, দ্বিতীয় পরিচয় এই পৃথিবী নামক এক বিরাট দেশের অধিবাসী। রাজনৈতিক কারণে এক দেশ কেটে দু’টুকরো করলে যেমন মানুষে মানুষে সংযোগ বন্ধ করা যায় না, নানা কারণে পৃথিবীর বহু দেশে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও ঠিক তেমনি, জাতিতে জাতিতে বিচ্ছেদ চিরন্তন ভাবা যায় না। বস্তুত সবাই যেন একই বাড়ির লোক, ঘর আলাদা, বসন-ভূষণ, আদব-কায়দা এবং খাওয়া-দাওয়া চলাফেরা আলাদা কিন্তু বেঁচে থাকার সব রসদ একই জায়গা থেকে আসে। সবাই একইভাবে সুখে হাসে ও দুঃখে কাঁদে। একই অনুভূতি, একই রক্ত এবং একই পরিণতি সকলের জন্য বরাদ্দ। তাই যদি হয় তো ভিন্ন ঘরে গেলে কেউ আগন্তুক বলে গণ্য হব কেন? বিভিন্ন দেশে গেলে কেন বলা হবে পরবাসী?
আমার দেশ, আমার বাড়ি, আমার ঘর, এই ধরনের ভাবনা যুগে-যুগে মনুষ্যত্বকে খর্ব করছে। মানুষের স্বাধীন চলার পথকে শীর্ণ করে তাকে আত্মকেন্দ্রিক করছে। আমার-আমার করতে করতে মানুষ পরম আত্মীয়কে পর ভাবতে শিখেছে। এমনকি তার আগের বিচারেও যারা তার আত্মীয়, তার নিজের দেশের লোক, তাদের এখন অতি সহজেই সে বলছে বিদেশি। কেউ-কেউ আবার অন্য উপসর্গের শিকার। ভূত দেখে আঁতকে ওঠার মতো বা বিকারের ঘোরে ভুল বকার মতো নিজেদের ভাবছে বিদেশি, নিজের দেশকে মনে করছে বিদেশ। অস্বীকার করা যায় না, মনে করার সঙ্গত কারণ হয়তো আছে, স্বদেশিদের কেউ-কেউ তাদের হয়তো ভূতের ভয় দেখিয়েছে অথবা খাইয়েছে এমন কিছু বিষ, যা তাদের দেহ-মনে বিকার আনতে সক্ষম।

এই মুহূর্তে সকলের আগে দরকার মানুষে-মানুষে বিশ্বাস সৃষ্টি, জাতিতে-জাতিতে ও বর্ণে-বর্ণে সম্প্রীতি স্থাপন। আমরা যে নিজের দেশকেও বিদেশ ভাবি বা নিজের দেশের মানুষকে বিদেশি আখ্যা দেই, তার মূলে কাজ করে পারস্পরিক অবিশ্বাস, ভুল বোঝাবুঝি। অবশ্য সত্যের খাতিরে এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে, নির্বিচার শোষণ এবং নির্লজ্জ অত্যাচারও অনেক সময় এ ধরনের মানসিকতার সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগায়। এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য গাছের মাথায় পানি না ঢেলে তার গোড়ার তদারকি দরকার। অর্থাৎ ঘন ঘন বৈঠক, আলাপ-আলোচনা ইত্যাদির মাত্রা কমিয়ে মূল গলদ দূর করার জন্য কার্যকর কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এমন ব্যবস্থা, যা অনুন্নতদের উন্নতি বিধানে সহায়ক হয়, মানুষে-মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস সৃষ্টিতে ফলপ্রসূ হয়।

উন্নত চরিত্রের মানুষেরা সব দেশকেই নিজের দেশ ভাবেন, সব ঘরকেই মনে করেন নিজের ঘর। তাঁদের কাছে বিদেশ বলে কিছু নেই, অনাত্মীয় বলে কেউ নেই। তাঁরা যখন যেখানে থাকেন সেখানেই ভাবেন স্বদেশে যখন যাদের মধ্যে থাকেন, তাদেরকে ভাবেন স্বজাতি। দৃষ্টি সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত বলেই ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতিগত অনৈক্য তাঁদের কাছে কোনো সমস্যাই নয়। মাদার তেরেসা কত দূর দেশের মানুষ। কিন্তু তিনি নিজ গুণে কত সহজে পরকে আপন করে নিলেন। অনায়াসে বুকে তুলে নিলেন পর দেশের অসহায় শিশুদের। ভগিনী নিবেদিতা সাগরপার থেকে এসে সাত সাগরের সুধা ঢাললেন মানুষের কল্যাণের জন্য। এদেশই যে তাঁর নিজের দেশ হয়ে উঠেছিল তা কি তাঁর অতি বড় বিরোধীরা অস্বীকার করতে পারেন? শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের সাথে কাজ করে গেলেন দূরদেশি এলম হাস্ট, পিয়ারসন প্রমুখ মনীষী। বিদেশকে স্বদেশ ভাবতে পেরেছিলেন বলেই না তাঁদের পক্ষে এই আত্মত্যাগ সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশের অনেকেই দেশে-দেশে নিজের দেশকে খুঁজে পেয়েছেন। আমাদের আপনজনেরা ইউরোপ বা আমেরিকার যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন তাঁর আত্মীয়, অনুরাগী ও সুহৃদ গোষ্ঠী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকের মধ্যেও বিদেশিদের আপন করে নিয়েছেন, সর্বস্বপণ করে তারা এগিয়ে গিয়েছেন তাঁকে সাহায্য করতে, তাছাড়া আছেন মাওলানা ভাসানী, দেশে-দেশে যাঁর ঘর।

স্বদেশপ্রেম ও সমাজ চেতনা আধুনিক কালের চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে মানুষ মধ্যযুগে কত না সংগ্রাম করেছে। বিশেষ করে, ইউরোপে রাষ্ট্রতন্ত্র যখন সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন যুদ্ধ ব্যবসায়ীরা স্বদেশ রক্ষার নামে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়েছেন। তারপর কত না উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী তাদের রাষ্ট্রীয় সীমারেখা চিহ্নিত করেছে। এই যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমারেখা, তাকে সুরক্ষিত করার জন্য সকল দেশ সর্বদা তাদের নিজ নিজ সৈন্যবাহিনীকে সজাগ রাখে। তথাপি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমানা বিবাদ নিয়ে কখনো যুদ্ধ, কখনো ছায়াবিবাদ চলছে। এই অবশ্যম্ভাবী ঘটনাকে স্বীকার করে নিয়েই আধুনিক মানুষের জীবনে স্বদেশ প্রেম ও স্বাদেশিকতার বীজ উপ্ত হয়েছে।

স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে সমাজ চেতনা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। সমাজ সম্পর্কে সহানুভূতিশীল না হলে স্বদেশের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রক্ষা করা যায় না, কারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজকে নিয়ে স্বদেশের বিশাল ধারণাটি রূপলাভ করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সিলেট থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিশ্লেষণ করলে সমাজ চেতনার ধারণাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আমাদের এই বাংলাদেশে নানা ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠি, সম্প্রদায় জাতি-উপজাতি অধিবাসী ও প্রত্যন্তবাসীদের অধিষ্ঠান। বিচিত্র তাদের সংস্কার, আচার অনুষ্ঠান। তথাপি এই বৈচিত্র্যময় সমাজের মধ্যে একটি ঐক্য সূত্র রয়েছে। সেই ঐক্য সূত্রটি হলো বাংলাদেশি অর্থাৎ বিচিত্র ধর্ম ও বর্ণের মানুষ হলেও আমরা একই বাংলাদেশের অধিবাসী এই সত্যটি সর্বদা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। এই সত্য ধারণাকে আমরা বলতে পারি স্বদেশ ভাবনা। অনুরূপভাবে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা ও ঐক্যবোধের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

স্বাদেশিকতা ভালো কিন্তু উগ্রস্বাদেশিকতা ভালো নয়। স্বাদেশিকতা তথা স্বদেশপ্রেমের মূলে আছে মানবপ্রেম। অন্যান্য রাষ্ট্রে যেসব মানুষ বাস করে তাদের প্রতি যদি আমাদের যথোচিত শ্রদ্ধা থাকে তবে উগ্র স্বাদেশিকতাকে আমরা অনায়াসে বর্জন করতে পারি। এই উগ্র স্বাদেশিকতার ফলে আমাদের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, আমাদের দেশ ও জাতি পৃথিবীর অন্য দেশ ও জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তার ফলে অন্যান্য দেশে আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতা দেখা যায়। মানব সমাজে এই বোধটি উপ্ত হয়েছে সেই দিনই, যে-দিন গুহাবাসী মানুষ আধুনিক দৃষ্টিতে ‘অসভ্য’ অবস্থাতেই গুহার মধ্য থেকে বেরিয়ে গাছের ফল মূলকে দ্বিতীয় খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে শিখল।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই ওই মানুষ ঝুঝতে শিখেছে একক বিক্রম নয়, গোষ্ঠিবদ্ধতা, বিদ্বেষ নয়, সখ্যের পথেই তাদের জীবন সংগ্রাম সিদ্ধ হতে পারে। এইভাবে পরনির্ভরশীলতার প্রেমময় পথেই মনুষ্যবোধ নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছে আপন গোষ্ঠির মধ্যকার অন্যান্যকে। তারপর সভ্যতার অগ্রগতিতে কখন যে তাদের এই সংকীর্ণ গোষ্ঠি সীমার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে তা কি তারা নিজেরা জানে? কিন্তু যেহেতু মানুষের আদিম প্রবৃত্তিতে মিশ্রিত রয়েছে হিংসা আর বিশ্বজুড়ে ‘নাগিনীরা ফেলেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’ তাই কখনো কখনো অবিশ্বাস ও সহনশীলতার অভাব কোথাও কোথাও প্রকট হয়ে পড়েছে। মানব সমাজের ফুলের ডালি ভরে উঠেছে ব্যথিতের কান্নায়, অপমানে, অত্যাচারে। তিল তিল পরিশ্রমে গড়া সভ্যতার চূড়ায় বসে আমরা হঠাৎ একদিন লক্ষ করেছি, মানবপ্রীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি।

আবার পঙ্কের মধ্যেই পঙ্কজের মতো পৃথিবীর এখানে-ওখানে মহামনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে, যাঁদের কল্যাণে অত্যাচারিত বিধ্বস্ত সমাজে আবার শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এসেছে। অজন্মা, কি মানুষের গড়া, দুর্ভিক্ষ রাষ্ট্রবিপ্লবে কিংবা খরা-বন্যায় যখন সংখ্যাতীত আর্ত-ব্যথিত-পীড়িতজনের অবর্ণনীয় দুর্দশার সৃষ্টি হয়, তখন সেবা নামক মঙ্গলবারি নিয়ে আর্তজনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর নামই মনুষ্যত্ব।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন