Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির অভিঘাত থেকে বিশ্ব যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তখনও বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়ছে অনেক উন্নত দেশ। এর মধ্যেই অশনি সংকেত হয়ে আসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে, পুরো বিশ্বে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, সার সংগ্রহ করতে দেশে দেশে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ে। বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকেও সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর মধ্যে এ বছরের ৫ আগস্ট সব ধরনের জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। বিশ্ব বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জ্বালানির দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সবধরণের পণ্যমূল্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। উল্লেখ্য, ২৯ আগস্ট আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৫টাকা কমিয়েছে। তা সত্ত্বেও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির রাস টেনে ধরা সম্ভব হয়নি।

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে জনজীবন যখন কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তখনই চাল, গম (আটা, ময়দা), ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, এমএস রড ও সিমেন্ট-এর মতো ৯টি পণ্যের দাম ঠিক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তখন বিটিটিসির পক্ষ থেকে এসব পণ্যের ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনা করা হয়। সেখানে দেখানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে যতটুকু বাড়ছে, দেশের বাজারে বাড়ছে তার চেয়েও অনেক বেশি। এ বিষয়টিই পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। সে সময় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে নির্ধারণ করে দেয়া দামের বাইরে কেউ পণ্য বিক্রি করলে শুধু জরিমানা নয়, মামলাও করা হবে বলে হুশিয়ারি দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কিছুদিন পর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে চাল, আটা ও ডিমসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা হবে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। সে সময় তিনি বলেছেন, ভোজ্যতেল ও চিনি ছাড়া অন্য পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। তাই ডাল, রড ও সিমেন্টসহ বাকি সাতটি পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। তাই পণ্যগুলোর দাম নির্ধারণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা হবে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব জিনিসেরই দাম বেড়ে যায়। এতে গরীব মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এটা স্বাভাবিক। তবে, সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। গরীব ও সীমিত আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার পরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে জনসাধারণকে অতিরিক্ত মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে এরকম বিভিন্ন প্রতিবেদন উঠে আসে। প্রতিবেদনগুলোতে বিভিন্ন মানুষের বেশি দামের পণ্য কেনার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাজারে ময়দা সংকট থাকার কারণে ময়দা প্রতি কেজিতে ২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন ময়দা মিলের মালিকদের সাথে কথা বলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে, আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ গম আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই বিশ্বব্যাপী গমের দাম বৃদ্ধি দেশে ময়দার দাম বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, চাল, আটা, ময়দা, ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও টয়লেট্রিজ পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সঙ্কটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে দেশের ৪৪ ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উল্লেখিত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ মামলা করে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই সরকারের বেঁধে দেয়া নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

কয়েক দিন ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম পড়তির দিকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ বাজারে পণ্যের এক ধরনের সংকট বা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা। জোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য না থাকার কারণে একটি সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। পণ্যের দাম আরও বাড়বে, এমন ধারণা থেকে কেউ কেউ পণ্য মজুত করে রেখেছেন। সঠিক পরিসংখ্যানের কারণেও পণ্যের জোগান ও চাহিদায় সমস্যা হচ্ছে। দেশে কোন পণ্যের চাহিদা কত, উৎপাদন কত হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমরা কেবল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলেই আত্মতৃপ্তি লাভ করছি। অন্যদিকে লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এই বিপরীতধর্মী চিত্রের মাঝে প্রকৃত চিত্র ঢাকা পড়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের আয় বৃদ্ধি দূরে থাক, তা কমে গেছে। যা আয় করছে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। অনেকে খাদ্য তালিকা থেকে মাছ-গোশতসহ অনেক পণ্য বাদ দিয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এর ফলে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে, যা দেশের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। শুধু খাদ্য জোগাড় করতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে না, চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে গিয়েও অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সন্তানের শিক্ষা ব্যয় ও চাহিদা পূরণ করা অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সরকারের উচিৎ, সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বমুখীর লাগাম টেনে ধরা। অন্তত তারা যাতে স্বাভাবিক খাদ্যগ্রহণ করতে পারে, ব্যবস্থা করা। বলা বাহুল্য, শুধু বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিই পণ্যমূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয়। বাজার ব্যবস্থাপনার সংকট ও সিন্ডিকেটও এক্ষেত্রে দায়ী। তাদের কারসাজিতে পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে যেসব সিন্ডিকেট জড়িয়ে রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন জরুরি।

লেখকঃ সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন