Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মেসির বিশ্বকাপ জয়

| প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

বিশ্বকাপ ট্রফি লিওনেল মেসির হাতে উঠুক, এটা ছিল অধিকাংশ ফুটবলপ্রেমিকের প্রত্যাশা ও প্রার্থনা। এর নানা কারণ ছিল। মেসি বিশ্বের সেরা ফুটবলার। সর্বকালের সেরা কিনা, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। সবাই একমত, তার স্থান পেলে ও ম্যারাডোনার পাশেই। বিশ্বফুটবলের এমন কোনো অর্জন নেই, যা তার ঝুলিতে নেই। বাকি ছিল বিশ্বকাপ ট্রফি। এবারের কাতার বিশ্বাকাপে সেটাও তার হাতের মুঠোয় এলো। মেসি এর আগে চারটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন। ট্রফির দেখা পাননি। পঞ্চম বারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে তিনি সব সময় চেয়েছেন, এবার যেন আর্জেন্টিনা শিরোপা জেতে। জেতার পর এখন আর কোনো অপূর্ণতা মেসির নেই। খেলা শেষে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি অকপটে বলেছেন: ‘আমি খুব করে এটা (ট্রফি) জিততে চেয়েছি। জানতাম, সৃষ্টিকর্তা আমার মনের আশা পূরণ করবেন। এই শিরোপাটা জিতে ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আর চাইতে পারতাম না। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এই শিরোপা পাইয়ে দিয়েছেন।’ তার চাওয়ার সঙ্গে তার ভক্ত-অনুরাগীদের চাওয়ারও মিল ছিল। তারাও চেয়েছে, মেসি যেন বিশ্বকাপ জিতে তার ফুটবল ক্যারিয়ারে পূর্ণতা আনতে পারে। শেষ পর্যন্ত সকলের প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে। বিশ্বকাপ জেতার জন্য আধুনিক ফুটবলের অন্যতম লালনক্ষেত্র আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর্জেন্টিনার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক সমর্থকও অপেক্ষা করেছে। সেই অপেক্ষারও ইতি ঘটেছে মেসির হাত দিয়ে। ফুটবলের জাদুকর বলে খ্যাত ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ৩৬ বছর আগে ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছিল। দেশটি তৃতীয়বার শিরোপা জিতলো আরেক কিংবদন্তি মেসির নেতৃত্বে।

এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলাটি দর্শকস্মৃতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্রিকেটকে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয়। ফুটবলও যে কখনো কখনো সে রকম হয়ে ওঠে, কাতারের রাজধানী দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে রোববার রাতে সেটা প্রত্যক্ষ করা গেছে। অনিশ্চয়তা ও নাটকীয়তায় ভরপুর ছিল গত বারের শিরোপাজয়ী ফ্রান্স ও মেসির আর্জেন্টিনার মধ্যে অনুষ্ঠিত ফাইনাল খেলাটি। স্টেডিয়ামের প্রায় ৮৯ লাখ প্রত্যক্ষ দর্শক এবং টেলিভিশনের কোটি কোটি দর্শক টাইব্রেকার শেষ হওয়া পর্যন্ত দোলাচলে দুলেছে। নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে সমতা, যদিও আর্জেন্টিনা এগিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। অতিরিক্ত সময়ে সমতা হয় ৩-৩ গোলে। টাইব্রেকারে প্রথম গোল করেন ফ্রান্সের বিশ্বখ্যাত কিলিয়ান এম্বাপ্পে, আর্জেন্টিনার পক্ষে মেসি গোল করে সমতা আনেন। এর পরই শুরু হয় ফ্রান্সের দুর্দিন। কোমানের করা দ্বিতীয় শটটি ফিরিয়ে দেন আর্জেন্টিনার গোলি লিয়ানো মার্তিনেজ। চুয়ামেনির তৃতীয় শটটি বাইরে চলে যায়। কোলো মুয়ানির চতুর্থ শটে গোল হলেও কোনো লাভ হয় না। মেসির পর তিনটি শটেই গোল করেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়রা। ফলে পঞ্চম শটের আর প্রয়োজন হয়নি। অনেকের মতে, ভাগ্যের আনুকূল্য পেয়েছে আর্জেন্টিনা। এটা একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু মাঠের খেলার মূল্যায়নেও দেখা গেছে, দুই দলের মধ্যে আর্জেন্টিনাই ছিল সেরা। খেলার পুরো সময়ের অন্তত ৬০ শতাংশে প্রাধান্য ছিল আর্জেন্টিনার। সেদিক থেকে যোগ্যতম দেশ হিসেবেই আর্জেন্টিনা ২০২২ বিশ্বকাপ জিতেছে। তার এই মহাবিজয়ের মহানায়ক অবশ্যই লিওনেল মেসি। মেসি নিজে খেলেছেন, খেলিয়েছেন, নিজে গোল করেছেন, অন্যদের দিয়ে গোল করিয়েছেন। তিনি সামনে থেকে টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সতীর্থদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। ক্রিকেটকে বলা হয় ক্যাপটেনের খেলা। ক্রিকেটে জেতার জন্য ক্যাপ্টেনের দক্ষতা, যোগ্যতা, নেতৃত্বগুণ ইত্যাদি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফুটবলের ক্ষেত্রেও এটা কখনো কখনো সত্য। মেসি সেরকমই একজন দলনেতা। সদাহাস্যময়, বিনয়ী, শালীন, সৌজন্যপ্রবণ, সুশৃঙ্খল এবং ক্রীড়াকৌশল ও নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে তিনি সেরাদের সেরা। বিজয় ও খ্যাতি তার ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তি।

ব্যক্তিগত জীবনেও মেসি অত্যন্ত সজ্জন, বন্ধুবৎসল, আকর্ষণীয় এবং বিরল মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। জানা যায়, তিনি বছরে ৯০০ লাখ ইউরো আয় করেন, যার অধিকাংশই ব্যয় করেন জনকল্যাণে। শিক্ষাবিস্তার ও শিশু উন্নয়নে তার বিশেষ আগ্রহ ও অবদান রয়েছে। ইউনেস্কোর চেরিটেবল ট্রাস্টের ৪৮ শতাংশ আয় আসে মেসির দান থেকে। মেসির অর্থানুকূল্যে ১৮৯টি দেশে ৯ হাজার ৮৪৭টি স্কুল তৈরি হয়েছে। ৪০ মিলিয়ন শিশুর স্কুলের খরচ তিনি বহন করেন। বার্সার যুব উন্নয়ন প্রকল্পের আয়ের একটি অংশ আসে তার দান থেকে। বিশ্বের ১৫ মিলিয়ন পথশিশুকে তিনি নিজের ট্রাস্ট থেকে সহায়তা করেন। তিনি এক সময় বলেছিলেন, তিনি ইসরাইলকে ঘৃণা করেন, তারা শিশুদের হত্যা করে বলে। ফোর্বসের জরিপ মতে, মেসি বিশ্বের ৫০ জন ডোনারের মধ্যে একজন। ফুটবলার হিসেবে তিনি যেমন অনন্য, অসাধারণ, মানবিক মানুষ হিসেবেও তেমনি তিনি অতুলনীয়। মেসি বিশ্বের তরুণদের আইকন ও অনুপ্রেরণা। বিশ্বব্যাপী তার অগণিত ভক্ত ও অনুরাগী আছে। তারা যদি সবাই মেসির মানবিক গুণাবলী অনুসরণ করে, তবে মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় রকমের অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে। বিশ্বকাপ জেতায় আমরা মেসিকে, তার নেতৃত্বাধীন দলকে এবং দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গকে অভিন্দন জানাই। এই সঙ্গে বলতে চাই, বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা দলের অসংখ্য সমর্থক আছে, যার মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তারা ফুটবলকে ভালোবাসে। ম্যারাডোনা ও মেসিকে ভালোবাসে। আর্জেন্টিনাকেও পছন্দ করে, ভালোবাসে। পরিশেষে আমরা আরো একবার বিশ্বকাপ জেতায় মেসিকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতার যে পারঙ্গমতা ও সক্ষমতা দেখিয়েছে তা বিশ্বব্যাপী প্রসংশিত হয়েছে। আমরা বন্ধুপ্রতীম কাতারকেও ধন্যবাদ জানাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন