পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বহু আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছিল ১০ ডিসেম্বর। সারা দেশ মনে হয় ভয়ের চাদরে ঢেকে গিয়েছিল। বিশেষ করে ঢেকে গিয়েছিল ঢাকা মহানগর। সেজন্য ঢাকার দুই কোটি মানুষ সেদিন দেখেছে, রাস্তাঘাটে বলতে গেলে কোনো বাস নাই। সিএনজির সংখ্যা হাতেগোনা। রিক্সা ছিল, তাও অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক অনেক কম। শুধু কি তাই, বড় বড় দোকান পাট বা শপিংমল তো দূরের কথা, অনেক মুদি দোকানও বন্ধ ছিল। আমি যেখানে থাকি সেটিকে লেন বলা হলেও দুইটি মটর গাড়ি স্বচ্ছন্দে পাশাপাশি চলতে পারে। সেই লেনে মুদি দোকানও বন্ধ। আমি খোঁজ নিলাম। অনেকে বলল, কি জানি কি হয়, খামখা কোনো রিস্ক নিচ্ছি না। আমার কাছে এই ভয় বা শঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক মনে হলো। তাই আমি একটু বের হলাম। আমার প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল, পত্রপত্রিকায় যতই বলা হোক না কেন, বিরাট একটা কিছু ঘটে যাবে ১০ ডিসেম্বর, আমার কিন্তু একেবারেই তা মনে হচ্ছিল না। সারাটা দিন পার হলো। দেখলাম, আমার ধারণাই সঠিক। ঢাকায় কিছুই হলো না। আর ৯টি বিভাগীয় জনসভা যেভাবে শেষ হয়েছে ঢাকার জনসভাও সেভাবেই শেষ হয়েছে। একটুও ব্যতিক্রম নাই। বরং ঢাকার জনসভার আগে সরকারই বিএনপির ওপর হেভি ক্র্যাক ডাউন করেছিল। সভা তো হবে ১০ তারিখে। কিন্তু তার ৩ দিন আগে অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর সরকার এবং সরকারি দলই প্রিএম্পটিভ স্ট্রাইক করলো। পরের দিনও বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস অর্থাৎ নয়াপল্টন অফিস এবং আশে-পাশের এলাকা পুলিশ ঘিরে রাখলো।
প্রশ্ন হতে পারে, আমি কেন এমন ধারণা করেছিলাম, যে ১০ ডিসেম্বর কিছুই হবে না। পাঠকদের হয়তো স্মরণ আছে যে, এর আগে আমি অপর একটি কলামে হেডিং দিয়েছিলাম, বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। তখনও কিন্তু কিছু কিছু পত্রপত্রিকা এবং কিছু কিছু ভাষ্যকার লিখছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নয়াপল্টনেই জনসভা করবে। আমি কিন্তু দেখলাম, বিএনপি বলছে, ‘ঢাকায়’ জনসভা করবোই। ‘নয়াপল্টনে’ করবোই, এমন কথা জোর দিয়ে বলছে না। আরেকটি বিষয় আমার কাছে খুব সম্মানজনক মনে হয়নি। একটি জনসভার অনুমতি নেওয়ার জন্য বিএনপির সিনিয়র নেতাদের একবার নয়, দুইবার নয়, তিন তিন বার পুলিশের অফিসে দৌড়া দৌড়ি করতে হয়েছে কেন? আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন আওয়ামী লীগ বলতো, দরখাস্ত করে রাজনীতি করবো না (নিবন্ধন নিয়ে)। আরো বলতো, পারমিশন নিয়ে মিটিং করবো না। তারা রমনা ভবনের সামনে মিটিং করেছে, রাস্তা বন্ধ করেছে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ব্লক করেছে। কোনো পারমিশন নেয়নি। যখন তখন মিছিল করেছে। কোনো পারমিশন নেয়নি।
বিএনপি তো প্রথম থেকেই এ পর্যন্ত বছরের পর বছর গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক এবং অহিংস আন্দোলন করেছে। এতে ভদ্রলোকদের প্রশংসা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রতিদান কী? খালেদা জিয়া জেলে, তারেক রহমান নির্বাসনে। আর সবশেষে এইবার মিটিংয়ের আগেই মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবির খোকন, আব্দুস সালাম প্রমুখ নেতা জেলখানায়। মির্জা ফখরুলকে যে সে অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়নি। অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি নাকি বোমাবাজি এবং অন্যান্য নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। সেজন্যই দেখা যাচ্ছে, তিনবার আদালতে আবেদন করা সত্ত্বেও তিন বারই তার এবং আরো ৪০০ জনের জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। মির্জা ফখরুলকে সর্ব শ্রেণীর মানুষ একজন নিখাদ ভদ্র লোক হিসাবে জানে। তার পক্ষে কি বোমাবাজির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া সম্ভব? একথা কে বিশ^াস করবে?
বিএনপি এখনও সম্পূর্ণ নিয়মনীতি এবং শিষ্টাচার মেনে চলছে। ২৪ ডিসেম্বর সমমনা বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে বিএনপির গণমিছিল বের করার কথা ছিল। ওবায়দুল কাদের বললেন যে, ২৪ তারিখে আওয়ামী লীগের কনফারেন্স আছে। তাই বিএনপি যেন তাদের গণমিছিলের তারিখটি পিছিয়ে দেয়। বিএনপি ওবায়দুল কাদেরকে সম্মান করেছে। তারা গণমিছিলের তারিখ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করেছে। কিন্তু ১০ তারিখ বিএনপি যে এত শান্তিপূর্ণ কিন্তু বিশাল সমাবেশ করলো, তারপর কি হলো? দেখা গেল, ঢাকা থেকে শুরু করে মফস্বলের বিভিন্ন জেলা এবং উপ-জেলায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই খবরের কাগজে বিএনপি নেতাকর্মীদের এই ধরপাকড়ের সংবাদ ছাপা হচ্ছে। কই, এখানে তো আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কোনো কনসেশন দেয়নি।
॥দুই॥
এসব কাহিনী লম্বা করে লাভ নাই। অতীতে একটি শব্দ ব্যবহার করা হতো। সেটি হলো, ‘মোখতাসার বাত’ অর্থাৎ সংক্ষেপে কথা হলো এই যে শুধুমাত্র বিএনপিই যে অবস্থান পরিবর্তন করেছে তাই নয়, আওয়ামী লীগও অবস্থান পরিবর্তন করেছে। ২০১১ সাল থেকে শুরু করে এই ৪/৫ মাস আগে পর্যন্ত বিএনপিসহ অন্যান্য দলকে সভা ও মিছিল করা তো দূরের কথা, রাস্তাতেই দাঁড়াতে দেওয়া হতো না। হঠাৎ দেখা গেল, প্রায় ৯ বছর পর সরকার ‘উদার’ হয়েছে। বলা হলো, বিএনপি মিছিল মিটিং করতে চাইলে বাধা দেওয়া হবে না। তারা যদি গণভবন ঘেরাও করে তাহলেও বাধা দেওয়া হবে না। বরং তাদেরকে চা খাওয়ার জন্য ভেতরে বসতে বলা হবে। ৫ মাসও অতিক্রান্ত হয়নি। এখন মির্জা ফখরুল এবং মির্জা আব্বাস গণভবনে চা খাওয়ার পরিবর্তে জেলের ভাত খাচ্ছেন।
আমার ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী, এই পরিস্থিতির সহসা কোনো উন্নতি হচ্ছে না। লিখতে গিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে যায়। সব কথা লেখা সম্ভব হয় না। কারণ স্পেসে কুলায় না। কিন্তু দেখুন, ১৯৯৪ সালে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ যখন আন্দোলন করছিল তখন আন্দোলনের এক পর্যায়ে সমস্ত বিরোধী দলের ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। বিএনপি সরকার তখন এক বছর পর্যন্ত সেই সব পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না করে সেগুলো ঝুলিয়ে রাখে। আর এখন কী হলো? বিএনপির যে ৬ জন দল বেঁধে স্পিকারের কাছে গিয়ে পদত্যাগ করলেন সেই পদত্যাগপত্রসমূহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গৃহীত হলো। হারুন সাহেব অস্ট্রেলিয়া আছেন। ২০ তারিখের মধ্যে তিনি ফিরবেন। ফিরলেই পদত্যাগ করবেন এবং সেটি গৃহীত হবে।
॥তিন॥
এখন মোখতাসার কথা হলো, বিএনপি আন্দোলনের যে ১০ দফা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র সংস্কারের যে ২৭ দফা দেবে সেগুলি বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? ১০ দফার প্রথম দফায় হলো এই সরকারের পদত্যাগ এবং এই জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া। তারপর একটি অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। অন্তর্বর্তী বা কেয়ারটেকার সরকার হবে সংবিধানের বিলুপ্ত ৫৮ অনুচ্ছেদের বিভিন্ন উপ অনুচ্ছেদ মোতাবেক। তারপর সেই সরকার একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে, যাদের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ গঠিত হবে।
এসব দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ সমস্ত প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু ইলেকশনের আগেই সংসদের মেজরিটি আসন অর্থাৎ ১৫৩টি আসন আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেল। কই, কিছুই তো হলো না। আবার ২০১৮ সালে তারা ইলেকশনে অংশগ্রহণ করলো। এবার বিস্ময়ের পর বিস্ময়। দিনের ভোট রাতে হয়ে গেলো। বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছিল নেতা ড. কামাল হোসেনকে। তিনি দিয়েছিলেন দুইজনকে নমিনেশন। এরা হলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবং মোকাব্বির হোসেন। অ্যাসেম্বলিতে গিয়েই তারা ডিগবাজি মারলেন। বিএনপির এমপিরা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু কামাল হোসেনের নমিনীরা আসন ছাড়তে রাজি নন।
আমার সোজাসুজি প্রশ্ন হলো, বিএনপি তথা ৩৫ দল তাদের প্রথম দফা, অর্থাৎ এই সরকারের পদত্যাগ দাবি আদায় করবে কীভাবে? আওয়ামী লীগের অবস্থান এখন অত্যন্ত পরিষ্কার। র্যাবের ওপর স্যাংশন দেওয়ার পরেও আওয়ামী লীগকে টলানো যায়নি। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে মোহাম্মদপুরে বদিউল আলম মজুমদারের বাসা থেকে ডিনার খেয়ে বেরনোর পর আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে তাড়া করে। তার গাড়িতে ঢিল মারে। তাড়াহুড়ো করে বার্নিকাট গাড়িতে উঠে হামলা থেকে বেঁচে যান। এবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে মায়ের ডাকের সমন্বয়কের বাসায় ২৫ মিনিটও বসতে দেওয়া হয়নি। বেরিয়ে গেলে একদল আওয়ামী সমর্থক তেড়ে যেতে চাইলে পুলিশ এসকর্টে তাকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়।
ক্রুদ্ধ পিটার হাস সেখান থেকে সোজা সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সাথে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন এবং তার চরম অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। মনে হচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য তার মনপুত হয়নি। তাই ওয়াশিংটনে তিনি এসম্পর্কে একটি রিপোর্ট দেন। পরদিন হোয়াইট হাউজের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান মি. কিরবি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন যে, এ ব্যাপারে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে বলা হয়েছে। মানুষ জানে না, কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অন্যান্য মন্ত্রী পর্যায়ে যেসব উক্তি করা হচ্ছে সেগুলো থেকে মনে হচ্ছে যে, মার্কিন সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বিএনপি বা বিরোধী দলসমূহ যদি মনে করে যে, মার্কিন চাপে সরকার পদত্যাগ করবে তাহলে ভুল করা হচ্ছে। ভেনিজুয়েলা, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকা যে কঠোর বৈরী মনোভাব গ্রহণ করেছিল, বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে মার্কিন মনোভাব ততখানি কঠোর বা ততখানি বৈরী বলে আমার মনে হচ্ছে না। বরং উভয় পক্ষের মধ্যে মধুর বাক্য বিনিময় না হলেও আমেরিকা এখনও বাংলাদেশের সাথে একটি ভালো ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ বজায় রাখতে চায়। এই সরকারের ব্যাপারে ভারত এবং চীনের মনোভাব মিত্র সুলভ নাকি অমিত্র সুলভ, সেটি পরিষ্কার নয়।
এই পটভূমিতে আমার ধারণা হলো, বাইরের দুনিয়ার দিকে না চেয়ে বাংলাদেশের ভেতরে বিএনপি এবং বিরোধী দলগুলিকে বেশি করে নজর দিতে হবে। এই সরকারের পতন বলুন বা বিরোধী দলের ক্ষমতায় আরোহণ বলুন, সব কিছুর অনুঘটক হলেন এই দেশের জনগণ। ১০ দফা দাবি আদায় করতে হলে হাজার হাজার নয়, শান্তিপূর্ণভাবে অযুত জনগণকে রাস্তায় নামাতে হবে। বিএনপিকে সংগ্রাম করতে হবে। গণতান্ত্রিক পথে সংগ্রাম করতে হবে অবিরাম। এই সংগ্রাম করতে গিয়ে বিএনপি তথা সমস্ত বিরোধী দলকে কবি সিকান্দার আবু জাফরের সেই কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান বার বার স্মরেণে আনতে হবে। সেই গানের কয়েকটি লাইন নিচে তুলে দিলাম।
হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে পাহাড় টলবেই
চলবেই চলবেই
জনতার সংগ্রাম চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।