Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০২৪, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

দুর্বল শাসনেই ব্যাংকে সঙ্কট

সিপিডি সংলাপে বক্তারা বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প দ্রুত শেষ করার তাগিদ ঢাকায় ৪ জনের একটি পরিবারের খাদ্য খেতে ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা লাগে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৫ এএম

দেশের ব্যাংক খাতের চলমান গভীর সঙ্কট কোভিড কিংবা যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা দুর্বল শাসন ও সংস্কারের অভাবে এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে সুশাসনের তাগিদ দিয়ে খেলাপি কমানোর দাবি জানানো হয়। যুদ্ধের প্রভাব নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা নাজুক হয়েছে মনে করে সিপিডি। ৬/৯ সুদহার ব্যাংকে টাকা রাখার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সুদহারের সীমা তুলে দিতে বলছে সিপিডি। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কোভিডের কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হয়নি। এই খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতার মুখোমুখি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, বিভিন্ন সূচকে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। দুর্বল সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমান্বয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এটার যদি উন্নতি না হয় তাহলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাস্তবে যা দেখানো হচ্ছে, তারচেয়ে অনেক বেশি উল্লেখ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক জানান, খেলাপি ঋণের এ বিষটি আইএমএফ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন। এর ভেতরে যদি আরো বেশ কিছু আনা হয়, ঋণের পরিমাণটা বেশি হবে। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট, লোন যেগুলো রয়েছে কোর্ট ইনজাকশনের মধ্যে এগুলো হিসাব দেয়া হলে সেটা দ্বিগুণের বেশি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক, আইন ও তথ্যগত দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)- আয়োজিত সংলাপে এসব বিষয় উঠে এসেছে। সঙ্কটে অর্থনীতি: কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?Ñ শীর্ষক এ সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন। সংলাপ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এছাড়াও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবিব মনসুর, বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরীও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণের মাধ্যমে বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প দ্রুত শেষ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ১০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি এমন প্রকল্পের কাজ নিরুৎসাহিত করা এবং শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয়নি এমন প্রকল্প আপাতত বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। বিলাসপণ্যের আমদানি হ্রাসের পদক্ষেপ কাজে লাগছে এবং আইএমএফের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা সঙ্কট নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেও আলোচনায় উঠে আসে।

সেমিনারে সিপিডির পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এতে বলা হয়, ডলার সঙ্কটের এ সময়ে বিদেশি অর্থায়নে চলমান ৩৪০টি প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার গতি বাড়ালে ডলার সরবরাহ বাড়বে। একই সময়ে ১০ শতাংশের কম বাস্তবায়ন হয়েছে এমন ৩০২টি প্রকল্প কম গুরুত্ব দেয়া দরকার। আর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৩০ শতাংশের কম কাজ হয়েছে এমন ৭০টি প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে বলছে সংস্থাটি। বিলাসপণ্যের আমদানি হ্রাস করায় সুফল মিলছে বলেও জানায় সিপিডি। তবে এতে সাময়িকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে বলেও জানায় তারা।

মূল্যস্ফীতির বিষয়ে সিপিডি বলছে, ঢাকায় চারজনের একটি পরিবারের মানসম্মত খাদ্য খেতে ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা লাগে। তবে টিসিবির মূল্য অনুযায়ী মাছ-গোশত না খেলেও ৯ হাজার ৫৫৭ টাকা লাগে। তবে অনেক শ্রমিক এ খাদ্যও জোগাতে পারছে না। তাই শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে সিপিডি। আর অত্যবশ্যকীয় পণ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলেও মনে করছে তারা।

এদিকে বিদেশে বেশি লোক গেলেও কম রেমিট্যান্স আসাকে চিন্তার বিষয় উল্লেখ করে হুন্ডি বিষয়গুলো জোর দিয়ে দেখতে বলছে সিপিডি। টাকার মান কমে যাওয়ায় প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়বে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বলা হয়। তবে এতে আবার আমদানি পন্যের দাম বাড়তে পারে বিধায় দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো তাগিদ দেয়া হয়।

জ্বালানি সঙ্কট মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে আহ্বান জানানো হয়। এতে ব্যয় সাশ্রয় হবে মনে করছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে সরকারে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়। যথাযথভাবে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা করতে পারলে সম্পদের সাশ্রয় হবে বলে জানানো হয়।

এদিকে রাজস্ব আয় বাড়লেও গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার কম বলে জানানো হয়। আর আমদানি শুল্ক থেকে এ বাড়তি রাজস্ব এসছে। তবে এডিপি বাস্তবায়নও গত ৫ বছরের সর্বনিন্ম হয়েছে। আর বিদেশি ঋণ ব্যবহার ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। ভর্তুকির চাহিদা সামনে আরো বাড়বে। আরো ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে জানিয়ে এ অর্থ কোথা হতে আসবে তা জানতে চায় সিপিডি। অর্থনৈতিক এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেয়া দরকার বলে মনে করে সিপিডি। অনেক ক্ষেত্রে তথ্য পাওয় যায়না বলেও অভিযোগ করে সংস্থাটি।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সুশীল সামজের চাহিদার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের চাহিদার বড় পার্থক্য রয়েছে। প্রতি সপ্তাতে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তারা এখনও খাবারের পানি চায়, স্কুল ভবন, কালভার্ট এবং ভাতার কার্ড দিতে বলে। আর আমাদের প্রধান লক্ষ্য ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত করা। আপনারা অনেক সমস্যার কথা বললেন, তবে ১৫ বছর আগের তুলনায় এখন অনেক দরিদ্রতা কমেছে। নিরক্ষরতা কমেছে, অন্ধকার দূর হয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে ঘরে ঘরে। আপনারা কালো মেঘ বেশি দেখছেন, তবে আমরা এতো কিছুর মধ্যেও সম্ভাবনা দেখছি।
অর্থমন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বের বিষয়ে সরকারের এ নীতিনির্ধারক বলেন, অর্থনীতি; পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল, বাই অর্ডার চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। তার থেকে এসব আইন মেনে আসে। আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না। আমি বলতে চাই আমরা জেনে শুনেই অর্থনীতি চালাচ্ছি। কিছু বিষয়ে ঘাটতি আছে স্বীকার করে নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এসব ঘাটতি পূরণ হয়ে গেলে আরো উন্নত জীবনযাপন করা যাবে। বিবিএস’র তথ্য নিয়ে জবাব দিগে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের হিসাব বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ সবাই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ঘাটতি খোঁজে বের করা গবেষকদের কাজ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসির দায়িত্বে থাকা রেজাউল ইসলাম বলেন, সামনে ডলারের বিপরীতে আলাদা রেট না রেখে একটি রেট নির্ধারণ করা হবে। কর্মসংস্থানের তথ্য প্রকাশের আহ্বান জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘমেয়াদে বড় দেশের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় বা কারেন্সি সোয়াপ সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এখন রেমিট্যান্স বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাই প্রণোদনার পাশাপাশি প্রবাসিদের অন্য সুবিধা বা অবসর ভাতা, পাসপোর্ট ফি মওকুফ অথবা বিদেশি দূতাবাসে তাদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এসময় তিনি দক্ষতা বৃদ্ধির মেগা প্রকল্প চালুর আহ্বান জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ