Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আরবী ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

কাজী সিকান্দার | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৫ এএম

আরবী বিশ্ব প্রচলিত প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম ভাষা। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রচলিত মৌলিক ও উপভাষাসহ সব ভাষায় আরবী ভাষার প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য ভাষার সাথে আমাদের বাংলা ভাষায়ও আরবী ভাষা বিরাট একটি জায়গা করে নিয়েছে। আমরা নিত্যদিন পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসংখ্য আরবী শব্দ ব্যবহার করি। তার সাথে আরবী আমাদের ধর্মীয় ভাষা। জান্নাতের ভাষা। রাসূলে আরবী (সা.)-এর ভাষা হলো আরবী। কুরআন ও হাদীসের ভাষা আরবী। তাই ইসলাম ও মুসলমানের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষা আরবী। মুসলমানদের জীবন-যাপনের উৎসমূল হলো কুরআন; আর তা অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘এইভাবে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি বিধানরূপে আরবী ভাষায়।’ (সূরা রাদ: আয়াত ৩৭)।

‘এই রূপেই আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় এবং তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী, যাতে তারা ভয় করে অথবা এটা হয় তাদের জন্য উপদেশ।’ (সূরা তাহা: আয়াত ১১৩)।

‘আরবী ভাষায় এই কুরআন বক্রতা মুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে।’ (সূরা জুমার: আয়াত ২৮)।
‘আমিই আরবী ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি। যেন তোমরা উপলব্ধি করতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: আয়াত ২)।

‘সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ১৯৫)।
আল্লাহ তাআলা বার বার বলেছেন আরবী ভাষায় সতর্কবাণী হিসেবে, বিধান হিসেবে, উপদেশ হিসেবে, সাবধানতা অবলম্বনে স্পষ্টভাবে আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় মুসলিম জীবনে আরবী ভাষা কতটুকু গুরুত্ব বহন করে। সবাই আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা অতি প্রয়োজন এবং কর্তব্যও বটে।

আরবী ভাষা শেখার ক্ষেত্রে হযরত ওমর (রা.)-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) বলেন: ‘তোমরা আরবী ভাষা শেখো। তা তোমাদের দীনের অংশ।’ (মাসবুকুয যাহাব ফি ফাদলিল আরব ওয়া শারফুল ইলমি আলা শারফিন নাসবি: ১/৯)।

এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছেন। আর প্রিয় নবী (সা.)-কে আরবী ভাষায় কুরআন ও সুন্নাহ প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। দীনের প্রথম অনুসারীরা ছিল আরবীভাষী। তাই দীনের গভীর জ্ঞানার্জনের জন্য এই ভাষা অর্জন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অতএব আরবী চর্চা করা দীনেরই অংশ ও দীনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া: ৮/৩৪৩)। জাগতিক দিক থেকে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আরবদেশে বসবাস করে জীবিকার তাগিতে। তাই তাদেরকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় আরবী ভাষা শিখতে হয়। অপর দিকে একজন মানুষের আলেম হতে হলে আরবী ভাষা শিক্ষা করা অপরিহার্য। কারণ, দীনের বিষয়ে ফাতোয়া দিতে হলে তাকে অবশ্যই আরবী ভাষায় পণ্ডিত হতে হবে। না হলে সে দীনের বিষয়ে ফাতোয়া দিতে পারবে না। যদিও সে দীনের দিকে আহ্বান করতে পারবে। সবদিক থেকে আরবী ভাষা আমাদের জীবন চলার ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭৩ সালের এই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ সভার ২৮তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিন্ধান্তে আরবীকে ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ১৯০তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস পালন করা হয়।

আন্তর্জাতিক ভাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি। এ দিন বাংলাদেশের সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, যা ছিল বিশ্ব দরবারে একমাত্র ভাষার জন্য আত্মত্যাগ। বাংলাদেশিদের এ আত্মত্যাগকে বিশ্ব দরবার মূল্যায়ন করেছে আন্তর্জাতিক মতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা, ইউনোস্কোর ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ছটি ভাষার পৃথক পৃথক আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের ঘোষণা করা হয়। ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক ফরাসী ভাষা দিবস। ২০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক চীনা ভাষা দিবস। ২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষা দিবস, ৬ জুন আন্তর্জাতিক রুশ ভাষা দিবস, ২১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক স্প্যানিশ ভাষা দিবস ও ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস।

আরবী ভাষার সাথে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আত্মার সম্পর্ক। এ দেশের জনসাধরণ আরবী ভাষাকে পরম শ্রদ্ধা করে। মনে থেকে ভক্তি করে। হৃদয় দিয়ে ভালবাসে। আরবী ভাষার যেমন রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব তেমনি রয়েছে বৈষয়িক গুরুত্ব। পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আরবী। ২৫ কোটি মানুষ আরবীকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২৫টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবী। অপর দিকে অর্থনৈতিক বিবেচনায় আরবী ভাষা বাংলাদেশের জন্য অতি বেশি গুরত্ব রাখে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ধরা হয় রেমিটেন্সকে; আর এ রেমিটেন্সের সিংহভাগই অর্জিত হয় আরবী ভাষার দেশসমূহ থেকে। এদেশের জনগণ যখন আরব দেশে যায়, তখন তারা ভাষা না জানায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে। তারা যদি ভালভাবে আরবী ভাষা জানতো তবে আরবদেশে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারতো। তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা আরো বেশি আদায় করে নিতে পারতো। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করার লক্ষ্যে আরবী ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেয় দরকার।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো আরবী ভাষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের যে কোনো বিধান জানতে হলে আরবী ভাষা জানতে হবে। কুরআন ও হাদীসের সঠিক মূল মর্ম বের করতে হলেও আরবী ভাষা প্রয়োজন। আরবী ভাষা অধ্যয়ন বা আয়ত্ত করা ছাড়া কোনো লোক ইসলামের কোনো বিষয়ের উপর ফতোয়া দিতে পারবে না। তাফসীর বা কুরআনের ব্যাখ্যা অন্যকে শেখাতে হলে, বিধানাবলি বলতে হলে অবশ্যই তাকে আরবী ভাষা জানতে হবে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি আরবী ভাষা সবদিক থেকে আমাদের জন্য অতি প্রয়োজন। তাই আমাদের আরবী ভাষা শেখার প্রতি আরো উৎসাহী হতে হবে। এ ভাষা আরো বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও পদক্ষেপ নিতে হবে।

যে জাতি যে ভাষাকে কেন্দ্র করে জীবন পরিচালিত করে, ঐ জাতির সেই ভাষার মধ্যে তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচার প্রস্ফুটিত হয়। একটি জাতির সংস্কৃতি বহন করে সেই জাতির ভাষা। সে ভাষা যত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছবে সে জাতির সংস্কৃতিও তত তার কাছে পৌঁছে যাবে। ইসলামের ভাষা আরবী বলে আরবী ভাষা ইসলামের সংস্কৃতি বহন করছে। ইসলামী সংস্কৃতি বুঝতে হলে আরবী ভাষাকে বুঝতে হবে। এদেশে দীর্ঘদিন চলেছে মুসলিম শাসন। শত শত বছর ধরে মুসলমানরা বসবাস করছে এখানে কিন্তু কতজন মুসলিম আরবী জানে ও বুঝে? এক্ষেত্রে ইংরেজরা সফল হয়েছে। তাদের ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের অনেকে ইংরজি ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করছে নিত্য দিন। আমাদের আরবী ভাষা ব্যবহারিক দিককে আরো সহজ করে সবার মুখে মুখে করে দেয়া সময়ের দাবি। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে আরবী বলা, লেখা ও বুঝার ব্যাপারে আরো উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক: পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, আশরাফাবাদ, মাদবর বাজার, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা



 

Show all comments
  • hassan ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ১:০২ পিএম says : 1
    আমাদের দেশ যদি কোরান দিয়ে শাসন করা হতো তাহলে তো আমরা আরবি ভাষা জানতাম যেহেতু আমাদের দেশ অবিশ্বাসীরা চালায় সেই জন্যই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে অমানুষ করে তৈরি করে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন