Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এ লজ্জা রাখব কোথায়

| প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অত্যন্ত পরিতাপ ও লজ্জার বিষয়, আর্থিক লেনদেন, দলীয়করণ, বিজ্ঞপ্তির বাইরে মাত্রাতিরিক্ত নিয়োগ, পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করাসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক নিয়োগে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদে নিয়োগে ৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইনটারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, যোগ্যতায় ঘাটতি থাকা প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়ায় শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে। এসংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, আমার অভিজ্ঞতা বলছে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বাস্তব। তিনি মনে করেন,উচ্চ মেধাসম্পন্ন একজনকে বাদ দিয়ে নিম্ন মেধার একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি ৪০ বছর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেয়া থেকে বঞ্চিত করবেন। তাই এ ধরনের একটি ঘটনাও মানতে চাইনা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম একটি পত্রিকাকে বলেছেন, টিআইবি যদি অভিযোগগুলো মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় এবং মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলে ইউজিসি বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে পারে। দেশের বিশিষ্ট জনেরা এই ঘটনাকে জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা এই প্রবণতাকে দেশের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন। তারা সংগত বিবেচনা থেকেই মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর উচ্চ শিক্ষা বলতে আর কিছুই থাকবে না।
টিআইবি প্রতিবেদনে দেশের ৩৭ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আলোচ্য গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলেই যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, নিয়োগের আগেই ইচ্ছামাফিক চাহিদা তৈরি করা হয়। কোন কোন শিক্ষক পছন্দের  শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করেন এবং পরবর্তী সময়ে তারাই নিয়োগ পান। বাজারকরাসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার বিনিময়ে আগে থেকেই একাডেমিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষ নারী  শিক্ষার্থীর একাংশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন জানানো হয়। বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই না করেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী বা ভোটার বাড়াতে নতুন বিভাগ বা ইনস্টিটিউট ও এক বিভাগ ভেঙে একাধিক বিভাগ খোলা হয়। নিয়োগে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী শিক্ষক, ছাত্রনেতা ও স্থানীয় নেতা ভিসি, প্রো-ভিসিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। বলা হয়েছে, একজন ভিসির সন্তানকে নিয়োগ দিতে দু’জনের স্থলে পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। প্রতিবেদনে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করেই বলা হয়েছে এবং এর সাথে ভিসি শিক্ষক নেতা, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের একাংশের জড়িত থাকার অভিযোগের কথা বলা হয়েছে। যেচিত্র টিআইবি’র রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে তা রিপোর্ট আকারে এই প্রথমবার হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম নতুন কিছু নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে যাই হোক শিক্ষক নিয়োগে গুরুতর অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছে তা কার্যত শিক্ষার মূল আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মারাত্মক সাংঘর্ষিক। কারণ, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে মেধার লালন করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। সেক্ষেত্রে আলোচ্য ক্ষেত্রে যে ধরনের সততার ন্যূনতম প্রয়োজন তা রয়েছে এটা কোন বিবেচনাতেই বলা যাবে না। বরং তদস্থলে বলতে গেলে অসততাই স্থান করে নিয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এসব অপকর্ম তথা দুর্নীতির সাথে প্রভাবশালী মহলও সম্পৃক্ত রয়েছে। বলা যায়, যাদের দিয়ে ভূত তাড়াবার কথা তাদের মধ্যেই রয়েছে ভূতের বাসা। অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্র মেধা-মননের চেয়ে ভোটের  বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবার পরিণতিতেই কার্যত স্থান করে নিয়েছে বিকৃত মানসিকতা। ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আগে শুনিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলেছেন, সব জায়গাতেই দুর্নীতি হচ্ছে। কাজেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যতিক্রম হবে, এটা আশা করা যায় না।
অনেকদিন ধরেই দেশে শিক্ষার মান নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথা উঠেছে। দেশের পাবলিক এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই মান নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এদেশের কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে উচ্চতর আদালত কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন পর্যন্ত যতটা আস্থার সাথে বিবেচনা করা হতো আলোচ্য প্রতিবেদনে তাতে গভীর চিড় ধরেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হবার জন্য শিক্ষার মান নয় বরং বাসা-বাড়িতে কাজকর্ম, ফুট-ফরমায়েশ খাটা, হাট-বাজার করা, এমনকি অনৈতিক সম্পর্কই যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাব? এটা সত্যিই উদ্বেগের যাদের দেখভাল করার কথা তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে। এটা যে দেশে মূলত দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহিতার অভাবেই ঘটতে পারছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের বিশিষ্টজন ও শিক্ষাবিদেরা এ ধরনের ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তারা এর তদন্তের দাবি করেছেন। আমরাও মনে করি, জাতীয় স্বার্থেই নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এসবের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সরকারের নানামহল থেকে উন্নয়নের কথা প্রায়শঃই শোনা যাচ্ছে। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদ-- সেখানে যেভাবে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে বোধকরি তা রোধ করা না গেলে সব উন্নয়নই অর্থহীন হয়ে যাবে। যদি প্রকৃতই দেখার কেউ থেকে থাকেন তাহলে এবিষয়ে দ্রুত নজর দেবেন- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন