পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অবশেষে বাধার বিশাল বিন্ধাচল পার হয়ে ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের ধারাবাহিকতায় ১০ম গণসমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এই সমাবেশ নিয়ে আগে এবং পরে অনেক কথা বলার আছে। সেগুলো স্থান সংকুলান হলে বলবো। তবে মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের নোটিশে সমাবেশটি যে কত বিশাল হয়েছে, সেটি আমরা সার্টিফাই না করে এতদসংগে সভার ছবি এখানে দিলাম। ইংরেজিতে বলে, অপঃরড়হ ংঢ়বধশং ষড়ঁফবৎ ঃযধহ ড়িৎফ. এখানে অ্যাকশনের পরিবর্তে ছবি বা পিকচার বললে আসল সত্যটি দেখা যাবে। এর আগে যে ৯টি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সেগুলোর প্রত্যেকটিতে লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। ঢাকার সভাতেও লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়েছিল। কিন্তু সরকার জনসভার পারমিশন এবং স্থান নির্বাচনে টালবাহানা করে এবং দরখাস্ত করার প্রায় ২১ দিন পর পারমিশন দেয়। তাও বিএনপির হাতে ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম সময়। এসম্পর্কে আমি আর বেশি কিছু বলবো না। শুধু এটুকু বলবো যে, যদি এই ২১ দিন আগে বিএনপির আবেদন মোতাবেক নয়াপল্টনে সভার অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে সেই সভার কলেবর যে কত বড় হতো, সেটা আপনারাই বিচার করবেন।
তবে আর একটি কথা বলবো। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী এবং সভানেত্রী আছেন বছরের পর বছর ধরে। তিনিই আওয়ামী লীগের সেন্ট্রাল ফিগার। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সভাপতি হিসাবেও তিনি প্রায় ৪০ বছর রয়েছেন। দেশের জনগোষ্ঠির একটি অংশের মধ্যে তার একটি ইমেজ বা ভাবমর্যাদা গড়ে উঠেছে। বিএনপিতেও বেগম খালেদা জিয়ার একটি ভাবমর্যাদা গড়ে উঠেছে। তারেক রহমানের ভাবমর্যাদা তার মায়ের সমান না হলেও তারও একটি ভাবমর্যাদা গড়ে উঠেছে। কিন্তু দলের এই দুই সেন্ট্রাল ফিগার বছরের পর বছর জনগণের মাঝ থেকে অনুপস্থিত। তাদের অনুপস্থিতিতে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে মহাসচিব হিসাবে কাজ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরও একটি ভাবমর্যাদা গড়ে উঠেছে। ১০ তারিখের সমাবেশের ৪০ ঘণ্টা আগে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। ঢাকার সমাবেশ আয়োজনের প্রধান দায়িত্ব ছিল মির্জা আব্বাসের। তিনি ঢাকার ছেলে। এছাড়া তিনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রও ছিলেন। সেই মির্জা আব্বাসকেও সভার ৪০ ঘণ্টা আগে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তথা সরকারের এই ড্র্যাসটিক অ্যাকশনের পর বিএনপি বলতে গেলে হাল ছাড়া বা নাবিক ছাড়া জাহাজে পরিণত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেছিলেন। কিন্তু ১০ তারিখের গোলাপবাগের সভার পর এখন সকলের ধারণা বদলে গেছে। এখন বলা যায়, বিএনপি যথার্থই একটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তাই ৩/৪ দিন আগে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সভাপতি আব্দুস সালাম এবং উত্তরের সভাপতি আমানুল্লাহ আমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, প্রচার সম্পাদক এবং ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহিদুদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ অন্তত ৫০ জন নেতা এবং আরো ৪০০ জন সক্রিয় কর্মীকে গ্রেফতারের পরেও সভার এই বিশাল কলেবর প্রমাণ করে যে, জনগণ বিএনপির দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ছেন। এর কারণ সম্ভবত এই যে, দ্রব্যমূল্য এবং অন্যান্য কারণে জনগণ অতিষ্ট হয়ে একটি বিকল্প খুঁজতে গিয়ে আর কোনো দল পাচ্ছে না। পাচ্ছে বিএনপিকে। তাই সেদিকেই ঝুঁকে পড়ছে।
আমি আর পেছনে যাবো না। কারণ, ঢাকার মিটিং সফলভাবে শেষ হওয়ার পর বিএনপির কাজ হবে সামনে এগিয়ে যাওয়া। সক্রিয় আন্দোলন বলতে যা বোঝায় ,এবার সেই কাজটিই করতে হবে বিএনপিকে। এইখানে বিএনপি এবং তার সমমনা দলসমূহকে বুঝতে হবে যে, আওয়ামী লীগ ও সরকারের গত আড়াই তিন মাসের কার্যকলাপে দেখা গেছে, তারা প্রধানত প্রশাসন, পুলিশ এবং দলের পেশী শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই বিষয়টি আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে যাবো না। গত ৭ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত বিএনপি অফিসের বাইরে এবং ভেতরে যা ঘটলো এবং তার সাথে যদি অতীত মেলানো যায় তাহলে আমার কথার সারবত্তা প্রমাণিত হবে।
॥দুই॥
যাই হোক, অনেক ঝড় ঝাপটা পার হয়ে ঢাকার জনসভার মাধ্যমে বিএনপির আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। এখন আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার কথা। শুধু আমি নই, যারা বিএনপির সমর্থক নন তারাও স্বীকার করেছেন যে, এপর্যন্ত বিএনপি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে গিয়েছে। তারা সরকারের পাতা ফাঁদেও পা দেয়নি, আবার নিজেরাও কোনো হঠকারী পদক্ষেপ নেয়নি। আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের প্রাক্কালে গত ১০ ডিসেম্বরের জনসভা থেকে আন্দোলনের ১০ দফা ঘোষিত হয়েছে। এই ১০ দফা আপনারা গত রবিবার পত্রপত্রিকায় পড়েছেন। তাই আর আমি ১০ দফার বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না। তবে এই সমাবেশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একটি হলো, জাতীয় সংসদে বিএনপির যে ৭ জন সদস্য রয়েছেন তারা ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। আন্দোলন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিএনপির এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ। ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগও কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় সংসদে সমস্ত বিরোধী দলসহ ১৪৭ জন এমপি পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর তারা রাজপথে আসেন। রাজপথে ১৭৩ দিন হরতাল পালিত হয়। এসব হরতালের অনেকগুলি ছিল সহিংস। বিহঙ্গ পরিবহন কোম্পানির একটি বাসে আগুন লাগার ফলে ৯ জন যাত্রী জীবন্ত দগ্ধ হন। এই ধরনের অনেক সহিংস ঘটনা ঘটে।
১০ তারিখের সভা থেকে যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম দাবি হলো, অবিলম্বে এই সরকারের পদত্যাগ। এই সরকারের পদত্যাগের পর সংবিধানের ৫৮ ধারার আলোকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার গঠন। ১৩ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজ মঙ্গলবার বিএনপির গণমিছিল ও বিক্ষোভ। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদের উচ্চকণ্ঠে বলছেন, এই সরকারের সাথে তাদের আর কোনো আপোষের সুযোগ নেই। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা প্রমাণ করার জন্য বিএনপির মত জাতীয় পার্টির এমপিদেরকেও ১০ ডিসেম্বরের সভা থেকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কর্মসূচির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, আমরা যাদের বিএপির মিত্র বলে মনে করি সেই সব সমমনা দলকে নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে গণমিছিল। এছাড়া ১০ দফায় আর যেসব দাবি রয়েছে, সেগুলো গত রবিবারের পত্র পত্রিকায় বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
॥তিন॥
ঠিক এই জায়গায় আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সেটি হলো, ১৩ ডিসেম্বর এবং ২৪ ডিসেম্বর। প্রথম দিন বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল। আর দ্বিতীয় দিন হলো সমমনাদের নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল। আমার ব্যক্তিগত মতে, এই দুই দিন হবে বিএনপির জন্য খরঃসঁং ঃবংঃ বা অগ্নিপরীক্ষা। এ পর্যন্ত বিএনপি যেভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে এসেছে, সেসব দেখে বিশ^াস করা যায় যে, বিএনপির তরফ থেকে অথবা তাদের সমমনা মিত্রদের তরফ থেকে কোনোরূপ সহিংস কাজ বা নাশকতামূলক কাজ করা হবে না। কিন্তু গণআন্দোলন যখন রাস্তায় গড়ায় তখন দেখা যায়, আন্দোলনের মধ্যে অনেক অমবহঃ ঢ়ৎড়াড়পধঃবঁৎ বা উস্কানিদাতা দালাল ঢুকে পড়ে। এদের থেকে বিএনপি এবং তার মিত্রদেরকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ, সকলের চোখের সামনে গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপি অফিসে সংঘঠিত ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করতে হবে। মির্জা ফখরুল এবং মির্জা আব্বাস বিএনপি অফিসে প্রাপ্ত ককটেল অথবা বোমা মজুদ করার নেপথ্যে ছিলেন, এটি বিশ^াস করা খুব সহজ নয়। তবে ভবিষ্যতের নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করবে। আরেকটি বিষয়। আমরা দেখেছি যে, পুলিশ বিএনপিকে লাঠিসোটা তো দূরের কথা, হাতে একটি ভারি বস্তুও রাখতে দেয়নি। কিন্তু ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের ঝটিকা বাহিনী লম্বা ও মোটা লাঠি হাতে বীর দর্পে রমনা ভবন এলাকা থেকে শুরু করে নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের সামনে মহড়া দিয়েছে। ইদানিং অনেকে তাদেরকে হেলমেট বাহিনী বলেন। ১৩ এবং ২৪ ডিসেম্বর বিএনপিকে একদিকে পুলিশ এবং অন্যদিকে এই ঝটিকা বাহিনী বা হেলমেট বাহিনী সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।
॥চার॥
এবার দুটি বাইরের ঘটনা নিয়ে এই লেখাটি শেষ করবো। ঢাকায় ৭ ও ৮ ডিসেম্বর বিএনপি অফিসে পুলিশের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও গুলিবর্ষণে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এসম্পর্কিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ঢাকায় নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে।’ ৯ ডিসেম্বর অপর এক খবরে প্রকাশ, ‘গুলশানে গত ৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ২৮টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের একটি বৈঠক হয়েছে।’ ১০ ডিসেম্বরের পূর্বাহ্নে এমন একটি বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর বিবিসি নয়াপল্টন অফিসের সামনে সংঘঠিত পুলিশী গুলিবর্ষণ সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক ভাষ্য প্রকাশ করেছে। এই ভাষ্যের শিরোনাম, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দমন পীড়ন।’
এক্সটার্নাল ফ্রন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্টের অফিস কাম সরকারি বাসবভন হোয়াইট হাউজ বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে পূর্ণ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। রয়টার্সের খবরে প্রকাশ, হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র জন কিরবি গত ১০ ডিসেম্বর বলেছেন যে, বড় একটি রাজনৈতিক বিক্ষোভের আগে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর সহিংসতার ঘটনার পূর্ণ তদন্ত বাংলাদেশ সরকার করবে বলে তারা আশা করেন। রয়টার্সের ঐ খবরে আরো বলা হয় যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি কর্মী সমর্থকদের ওপর গত বুধবার পুলিশ গুলি চালালে একজন নিহত হন এবং আহত হন ৬০ জনেরও বেশি।
একথা কেউ মানুন আর নাই মানুন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Confrontational. অর্থাৎ মোকাবিলার রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল। তখন তার নেতারা বলেছিলেন যে, দলীয় সরকার অর্থাৎ বিএনপি সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নিরপক্ষে নির্বাচনের জন্য তারা কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে প্রবল গণআন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন সব সময় নিয়মতান্ত্রিক থাকেনি। আজ বিএনপিও আওয়ামী লীগের ঐ দাবিরই প্রতিধ্বনি করছে। বলছে, দলীয় সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। সেদিন যেমন রাজপথের ভায়োলেন্ট আন্দোলনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়েছিল আজও তেমনি রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই এই নিষ্পত্তি হবে বলে মনে হচ্ছে। এখন শুধু এটুকু বলা যায় যে, এই ডিসেম্বর এবং তার পরের দিনগুলো হতে যাচ্ছে উত্তাল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।