পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থের বেড়াজালে বন্দি সাধারণ মানুষ। সমঝোতার বিপরীতে সরকার ও বিরোধীদলের কর্মসূচি ও পাল্টা কর্মসূচি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে, যা কাম্য নয়। এর ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এ ধরনের উদ্বেগের অবসান হওয়া জরুরি বলে মনে করি।
বাস্তবতা হচ্ছে, এদেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না সংবিধান কী, সংবিধান সংশোধন কী? এসব বিষয় নিয়ে তাদের তেমন কোনো মাথাব্যথাও নেই। তারা কেউ ক্ষমতায় যেতে চায় না, শুধু চায়, একটু সুখ, শান্তি ও স্বস্তিতে কাজকর্ম করে বেঁচে থাকার স্বস্তিদায়ক সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের এই সুখ-শান্তি ও স্বস্তির বিষয়টি কতটা চিন্তা করে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জনগণের সেবক হিসেবে জাহির ও জনগণের জানমালের রক্ষার নিশ্চয়তার কথা বললেও পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলছে, যা কাম্য হতে পারে না। জানি না, সামনের দিনগুলোতে এহেন রাজনৈতিক সংঘাতে আর কত মানুষ প্রাণ হারাবে। এই ধরনের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির শিকার হয়ে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের দায়ভারই বা কে নেবে? সরকার না বিরোধী দল?
রাজনৈতিক সমঝোতার বিপরীতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার যে শঙ্কা করা হচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। নির্বাচনকালীন সরকার, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনসহ (ইভিএম) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ সংকট নিরসনে দুই দলের মধ্যে আলোচনা বা সংলাপ জরুরি হলেও এর কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, দল দুটির মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ছে। এ পরিস্থিতি রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে রাজপথ উত্তপ্ত হওয়ার পাশাপাশি রাজধানীসহ সারাদেশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে মানুষের জানমালের ক্ষতি ছাড়াও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা দেশ তথা জনগণ কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। এ প্রেক্ষিতে, দলগুলোকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
অতীতে বিভিন্ন বিষয় ও ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে দেশে সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি ও মাসের পরপর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণহানি ছাড়াও দেশজুড়ে যে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সম্পদহানি হয়েছিল, এ সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল অর্থনীতিতে। বর্তমানে নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সীমিত সম্পদের এই দেশে আবারও যদি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে তা হবে ভয়াবহ। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি মধ্যে যদি রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়, তবে দেশ ও জনগণ এর ধকল কতটা মোকাবিলা করতে পারবে, এ প্রশ্ন বিবেচনায় নিয়ে মানুষের জানমালসহ অর্থনীতির ক্ষতি এড়াতে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধের রাজনৈতিক নেতাদের সুস্থ রাজনীতি কর্মকাণ্ডে অধিক মনোনিবেশ করতে হবে। ভাবতে হবে, আমরা কি শুধু সাংবিধানিকভাবে বৈধ একটি সরকার চাই, নাকি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই, নাকি দেশ ও জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ চাই।
ইতঃপূর্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিরোধীদল, বিশেষ করে বিএনপির সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি এমন নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছিল, যাতে নির্বাচনে সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি না হয়। অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকেও সংলাপের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান ও সবার সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলের কর্মসূচিতে বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ অবশ্যই ইতিবাচক; তবে নির্দেশটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। বস্তুত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণই শ্রেয়। সমস্যাগুলো যদি আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা যায় এবং সেখানে সমাধানের পথ খোঁজা হয়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে সংঘাত, সংঘর্ষ ও নৈরাজ্য হ্রাস পাবে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ শুধুমাত্র রাজনৈতিক হানাহানির কারণে পিছিয়ে থাকবে, তা কারও জন্য কাম্য হতে পারে না। অনেকে মনে করেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার সম্পর্ক শত্রুতায় পর্যবসিত হওয়ায় গণতন্ত্র ও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা দেখেছি, গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে বৈরী সম্পর্ক চলছে, তা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে। দেশে সমঝোতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে এ অবস্থার অবসান ঘটবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশোধপরায়ণতার রাজনীতি পরিহার করে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশা জনগণের। সেই পথেই রাজনৈতিক দলগুলি হাঁটবে এমনটাই কাম্য।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩৮৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৪০০ জন। এ পরিসংখ্যান সঠিক হয়ে থাকলে তা উদ্বেগজনক। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কারণে দেশের প্রায় সব জেলায় এসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে বিশেষ করে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তেমনটি ঘটলে তা হবে দেশ ও জনগণের জন্য অশুভ ও অকল্যাণকর। ইতোমধ্যে এ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় উভয় দলের রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া জরুরি।
বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলার মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে, এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুভবুদ্ধি উদয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি হতাশাজনক ও দুঃখজনক।
এমন এক পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক দলগুলোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়া সময়ের দাবী। পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো যদি আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা গেলে সংকটের সমাধান হতে পারে। তবে আলোচনায় বসলে ‘বিচার মানি কিন্তু তাল গাছ আমার’ এমন মনোভাব পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতার রাজনীতি পরিহার করে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে উন্নয়ন আরও বেগবান হবে।
মনে রাখতে হবে, সংঘাত-সহিংসতার পথ ধরে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে। এতে কেবল সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাত ও রফতানিমুখী শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় এসব শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার শ্রমিকের ভাগ্য হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম না হলে বিনিয়োগ ও উন্নয়নে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসবে না। এসব বিষয় মাথায় রেখে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীলতার পরিচয় দেখাতে হবে, যা জনগণ প্রত্যাশা করে।
আমরা মনে করি, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ও উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজমান বিভাজন দূর করতে হবে। এজন্য আস্থা ও আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যমে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত সমঝোতার পথে এগিয়ে যাবে- এটাই অধিক প্রত্যাশা।
লেখকঃ কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।