Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা কাম্য নয়

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাজনীতির মাঠে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই এসব অস্থিরতা শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক নয়। বৈশ্বিক বাস্তবতায় এমনিতেই সময়টা খুবই সঙ্গীন। মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, তার ওপর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। এর মধ্যেই বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কোথায় সমাবেশ হবে তা নিয়ে চলছে বিএনপি ও সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন। সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬টি শর্তে সমাবেশের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনে পার্টি অফিসের সামনে সমাবেশ করার ক্ষেত্রে অনড় থাকলেও এখন সোহরাওয়ার্দী ছাড়া তার পছন্দ হয় এমন কোনো স্থান হলে সমাবেশ করবে বলে বলছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয়েছে, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে হবে। এ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। শেষ পর্যন্ত সমাবেশ কোথায় হয় তা দেখার বিষয়। এক সময় রাস্তাতে নামতে না দেয়া দলটি এখন সমাবেশ করতে পারছে, এটা এক অর্থে ইতিবাচক। সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপির ভিন্ন চিন্তায় আশা করা যায় পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সুস্থির থাকতে পারে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে বাংলাদেশসহ দেশে দেশে এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। মহামারী করোনার পর মানবসৃষ্ট রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে টালমাটাল করে দিয়েছে। এই যুদ্ধের কারণে তেল-গ্যাসের বিশ্ববাজার অস্থির। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। শ্রীলংকার মতো আলামত না থাকলেও অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ে সার্বিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর সরকার থেকে আশা করা হচ্ছিল, নানা ইস্যু হয়ত চাপা পড়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। হঠাৎ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্যভরা প্রচার থমকে গেছে। অর্থনীতির প্রায় সব শাখায় মন্দা দেখা দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। সিন্ডিকেটের দাপট, ডলার সংকট, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামনের দিনগুলোতে আরও প্রকট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। নতুন করে ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়েছে। অর্থ পাচারও থেমে নেই। প্রকৃত রিজার্ভ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বেকারত্ব বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সব মিলিয়ে ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের বিদ্যুৎসাশ্রয়ের পদক্ষেপ, ব্যয় সংকোচনসহ বিভিন্ন কৌশল খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। আগে সরকার ত্বরিৎ এ ধরনের অঘটন সামাল দিতে পারলেও এখন পারছে না। এর মধ্যে নানা ধরনের কথাবার্তা রটছে। বাংলাদেশ শ্রীলংকার মতো হয়ে গেছে, রিজার্ভ শেষ, ব্যাংকে টাকা নেই, গ্রাহকরা জমাকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছে না, কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি কথা ছড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩ নভেম্বর জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে কোনো ব্যাংক বন্ধের রেকর্ড নেই।’

বলা বাহুল্য, গুজবে সত্য-মিথ্যা থাকে, সঙ্গে থাকে বিনোদনও। তবে বিনোদিত করা আসল উদ্দেশ্য নয়, মূল মতলব মানুষকে আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত করা। কুশীলবরা গুজব-গুঞ্জন রটানোর সুযোগটা নেয় কোনো সংকটকে পুঁজি করে। হালে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে তা করছে বিদ্যমান অর্থনৈতিক টানাপড়েনের সুযোগে। ব্যাংক খাত অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের চেয়ে বেশি কথা বলছেন রাজনীতিকরা। তারা কেউ বাংলাদেশকে শ্রীলংকা বানিয়ে ফেলেন, কেউ সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলেন। বিদেশি নানা সংস্থা কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশ ‘চাপে আছে কিন্তু ঝুঁকিতে নেই’ বলছে।
মূল্যস্ফীতি, বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম, ব্যাংকে ডলার ঘাটতির ঘটনা সত্য। এখন আগের মতো ফ্রি স্টাইলে এলসি খোলা যাচ্ছে না। নিট হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঘরে। ১৩ মাস আগেও যে রিজার্ভের রমরমা অবস্থা ছিল, সেখানে এখন টান ধরেছে। ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অবস্থান জানিয়ে বলেছে, ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য আছে। ব্যাংকে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ আছে জানাতে গিয়ে বলেছে, কোনো ব্যাংক টাকা না দিতে পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে। এমন কথা বলার পরও মানুষের শঙ্কা-অবিশ্বাস কাটানো যাচ্ছে না।

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, জলাবদ্ধতা, নদীর নাব্য হ্রাস, পানির স্তর নেমে যাওয়া, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত হুমকিতে পড়ছে। এর মধ্যে ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ স্লোগান দিয়ে হুঙ্কার-পাল্টা হুঙ্কার চললেও বাস্তবে খেলা চলছে পুরোদমে। এ খেলার রেফারি-আম্পায়ার এখনো অচেনা। আন্দোলন-সমাবেশ-বিক্ষোভ ইত্যাদি কারও দান বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়। এক সময় তা করতে চাইলেই করা যেত। সারাবিশ্বে, এমনকি বাংলাদেশেও তার শত শত উদাহরণ রয়েছে। সমাবেশ বা মিছিল করা এক সময় ছিল পুলিশকে অবহিত করার বিষয়। সেই ‘অবহিতকরণ’ গত কয়েক বছরে ‘অনুমতি’ নির্ভর হয়ে পড়েছে। সভা-সমাবেশের অনুমতি নিয়ে চলছে রাজনৈতিক টানাপড়েন। বিএনপিকে এ মাসে আসল খেলা দেখিয়ে ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরবিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, বাড়াবাড়ি করছে সরকার। এ জন্য সরকারকে পালাতে হবে। পাল্টাপাল্টি এই হুমকি শঙ্কার বিষয়। বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাজনীতির এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি কাম্য নয়।

তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই যুগে জনগণ ভালো করেই জানে, চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে তারা কতটা স্বস্তিতে রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই সঙ্কট পুঁজি করে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তার অবনতি ঘটলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলকে উপলব্ধি করতে হবে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন