Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষা পরিবর্তনের হাতিয়ার

ইলিয়াজ হোসেন রানা | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

শিক্ষা একটি গতিশীল ও সতত পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ইতোপূর্বে বহুবিস্তার আলোচনা হয়েছে। তারপরও বর্তমান সমাজে তার কোনো বাস্তব প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় নাই। স¦াধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ দেশে শিক্ষার প্রসার যেভাবে ঘটেছে, শিক্ষিত লোকের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সামাজিক অবস্থার কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সেভাবে ঘটেনি। ‘শিক্ষা’ শব্দটি দুটি অর্থে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একটি সংকীর্ণ অর্থে অন্যটি ব্যাপক অর্থে। সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষাকে সীমিত পরিবেশের মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ার সাথে এক করে দেখা হয়। এ অর্থে শিক্ষার লক্ষ্য হলো কিছু প্রয়োজনীয় কৌশল আয়ত্ত করা বা অপরিপক্ক মনকে প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতার চাপে ভারাক্রান্ত করে তোলা। অন্যদিকে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা জীবনের সঙ্গে সমব্যাপক। শিক্ষা ও জীবন এক্ষেত্রে সমার্থক, মানব জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই শিক্ষা বিরামহীন প্রক্রিয়ায় চালিত হয়। তাই শিক্ষা স্কুল-কলেজে সীমাবদ্ধ নয়। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মনীষিগণ বলেন, শিক্ষা হলো একটি সাধারণ প্রক্রিয়া, যার দ্বারা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে এবং যার দ্বারা মানুষ তাদের পারস্পারিক সর্ম্পক ও বিশ্বের সাথে তাদের সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারে। কাজেই বলা যায়, শিক্ষা একটি জটিল ও সামগ্রিক প্রক্রিয়া।

শিক্ষা কতগুলো গতিহীন নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব বা তথ্যের সঞ্চয় নয়, নির্ধারিত পাঠ্যবস্তুর অধ্যয়ন নয়, অতীতে পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত কতগুলো বিশ্বাস ও সত্যের পুনরাবৃত্তি নয়। শিক্ষা গতিশীল, পরিবর্তনশীল, বর্ধিষ্ণু জীবনের সমগোত্রীয়, চলমান বিশ্বের পরিবর্তনের সাথে সার্থক সংহতি সাধনই প্রগতি; আর শিক্ষা তারই নামান্তর। শিক্ষার অন্তর্নিহিত স্রোতধারায় থাকে সচেতনতা সৃষ্টির উপাদান। এই সচেতনতা যখন সম্প্রসারিত হয় তখন সমাজের প্রয়োজনেই শিক্ষার স্বভাব চরিত্র কাঠামো ও পঠন-পাঠনের উপাদান পরিবর্তিত হয়। নতুন করে শিক্ষাই তখন সমাজস্তরে সৃষ্টি করে সাম্যবোধের প্রবণতা। শিক্ষা সমাজের মূল্যবোধক উপাদানগুলির অথবা অবস্তুগত বিষয়াবলির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা হলো সংরক্ষণশীল এজেন্সি। সমাজ তার নিজের প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছে। তাই শিক্ষার কাজ হলো সমাজের চাহিদা পূরণ করা। কিন্তু সমাজ তার প্রাচীনতার অপসারণ করে নতুনের জন্য স্থান করে দেয় বা সমাজ যখনই পরিবর্তিত হয় তখই শিক্ষা সেই নতুনের সহায়ক হিসেবে ধাত্রীমাতার অথবা সেবকের কাজ করে। এভাবে শিক্ষা পরিবর্তিত সমাজকে সুসংহত করার কাজে সাহায্য করে। শিক্ষা উন্নততর সমাজজীবনের উপযুক্ত মানুষ তৈরি করে। জগতে যা কিছু ভালো তা যাতে সকল মানুষ অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে সহায়তা করে এবং এই প্রক্রিয়ার সামজিক উন্নতি সাধন করে। আত্মসংযমের মাধ্যমে চরিত্রকে দৃঢ় করতে না পারলে শিক্ষার কোন মূল্য থাকে না। শিক্ষা সকল মানুষকে উন্নতি, মানবীয় গুণে সমৃদ্ধ করে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদদের শিক্ষা ভাবনায় সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষার ক্রিয়াশীল ভূমিকা গুরুত্বের সাথে স্বীকৃত। আধুনিক সমাজ গঠনেও শিক্ষার এই ভূমিকা ধারাবাহিকতা বর্তমান।

পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার শক্তিপুঞ্জকে স্থায়িত্ব বিধানের জন্য শিক্ষা তার ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ও সংস্কার, সাং¯ৃ‹তিক উত্তরাধিকার এবং আচার-আচরণ ইত্যাদিকে বংশপরম্পারায় পরিবাহিত করে। সামাজিক আদর্শ ও জীবনযাত্রার গতিধারাকে নিশ্চিত করাই হলো শিক্ষার কাজ। অতীত ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে ও শিক্ষার্থীরা যাতে ব্যক্তিগত ও সামজ জীবনে যুক্তিবাদী ও সৃষ্টধর্মী হয়ে উঠতে পারে এবং আধুনিকতার ভিত্তিতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে তার জন্যও শিক্ষার গতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা জাতির ও প্রগতির মূল উৎস। আত্মসচেতন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির উত্তম হাতিয়ার শিক্ষা। সুদক্ষ মানব সম্পদ গঠন ও অগ্রগতি সাধনে শিক্ষা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। উন্নত বিশ্বে শিক্ষার উন্নতির ফলে সেখানে মানুষ শক্তিশালী মানব সম্পদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার সুযোগ তো কমই, আর জীবিকার সংস্থান করতে পারে এমন শিক্ষার সুযোগ আরও কম। এদেশে বিপুল জনসংখ্যা যে ধরনের শিক্ষার ফলে মানব সম্পদে পরিণত হতে পারে সে ধরনের শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে। নিরূপায় ছাত্র-ছাত্রীরা কর্মমুখী শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে বেকারত্ব বরণ করছে। সুতরাং উন্নয়নশীল এদেশে জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে বৃহত্তর ছাত্র সমাজকে কর্মমুখী করতে পারলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য যেমন দূর হবে, তেমনি বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আজ আর কোনো রকম দ্বিধা-দ¦ন্দ্ব নেই। নারীরা বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। এ অর্ধেক জনসংখ্যাকে বাদ দিয়ে জাতির উন্নতির আশা করা যায় না। নারীর যোগ্য স্থান লাভের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষার। শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার আলোকে নিজেদের জীবন আলোকিত করতে পারলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তাই তার নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে সামজিক মূল্যবোধেরও অবক্ষয় হয়। আর এ অবক্ষয় বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন, একটি শিশু যদি তার পরিবারে নৈতিক মূল্যবোধের অধঃপতন দেখতে পায়, তাহলে সে শিশুকাল থেকেই নৈতিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের পরিবর্তে অবক্ষয়ের পন্থা বেছে নেবে। আর যে শিশুর মধ্যে নৈতিকতার বিকাশ ঘটে না, তার মধ্যে সমাজের মানুষের জন্য মঙ্গল চিন্তার প্রশ্নই আসে না; সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের শাশ্বত ধারণার অবমূল্যায়নে বৃদ্ধি পায় অপরাধপ্রবণতা। এছাড়া অনুন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অসুস্থ ধারার সংস্কৃতি, নৈতিকতাবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ, বিদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, আভিজাত্য ও কুসংস্কারের ফলে মানুষ নৈতিকতাবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়। তাতে করে তাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধীরে ধীরে কলুষিত হয়ে পড়ে। অধঃপতনের কুটিল অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সমাজ। সাম্প্রতিক সমাজজীবনে বাংলাদেশের মানুষের যে সমস্যার সম্মুখীন তার মূলে মূল্যবোধের অবক্ষয় রয়েছে। জাতীয় জীবনে মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠানতার একান্ত প্রয়োজনে সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের, যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, তাদের চিত্তে, দেশপ্রেম, ধর্মনিষ্ঠা, নৈতিকতা, সততা, সত্যপ্রিয়তা, শৃঙ্খলাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, কর্তব্যসচেনতা এবং দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ সঞ্চার করতে হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাপরিবেশ, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি, পাঠোপকরণ ও পাঠদান পদ্ধতি শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় যাবতীয় পরিমণ্ডল ও পরিচালনা হবে উদ্দেশ্যভিত্তিক এবং প্রয়োগমূলক। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র যে আমাদের জীবনে সামগ্রিক কর্ম ও চিন্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, এ ধারণা শিক্ষার্থীর চিত্তে সঞ্চারিত করেই তাকে দেশের স¦ার্থক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, শ্রমের প্রতি অনিহা ইত্যাদি। এসব সমস্যার সমাধান হলেই দেশ ও জাতি সমৃদ্ধির অংশীদার হবে; সার্থক সমাজ পরিবর্তন হবে। মানুষের মাধ্যমে সংঘটিত সামাজিক পরিবর্তন কখনো কখনো মানব কল্যাণের সাথে সংশ্লিষ্ট নাও হতে পারে। এজন্য বলা হয়, সামাজিক পরিবর্তনের একটি গতিশীল উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষার দ্বারাই উন্মোচিত হবে ভবিষ্যতের সিংহদ্বার। শিক্ষাই আনবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে পরিপূর্ণতা। এককথায়, শিক্ষা ব্যক্তিক কল্যাণ ও সমাজ কল্যাণের পথে গড়ে তুলবে নতুন ও আর্দশ সমাজ ব্যবস্থা। কাজেই সমাজ পরিবর্তনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য।

লেখক: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন