Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সংবাদপত্রশিল্পের সমস্যা সমাধানে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সংবাদপত্রশিল্প অনেক দিন ধরেই সংকটে আছে। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সঙ্কট এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এই গুরুত্বপূর্ণ সেবাশিল্পটি এখন টিকিয়ে রাখাই অসম্ভবপর হয়ে পড়েছে। সঙ্কট দূর করে শিল্পের অস্তিত্ব নিরাপদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে বরাবরই। সংবাদপত্রের মালিক কর্তৃপক্ষ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের তরফে শিল্প সুরক্ষায় সরকারের কার্যকর সহযোগিতা দাবি করা হলেও যথোচিত সাড়া ও পদক্ষেপ এখনো লক্ষ করা যায়নি। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বা উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও উচ্চ কর-শুল্কের চাপে শিল্প কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর অস্তিত্ব চূড়ান্ত বিপন্নদশায় উপনীত হয়েছে। শিল্প উদ্ধারে যদি সরকার দ্রুত এগিয়ে না আসে, তবে দেশে সংবাদপত্র বলে কিছু থাকবে না। শত-সহস্র সাংবাদিক ও কর্মী বেকার হয়ে যাবে। সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) গত শনিবারে স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সংবাদপত্র শিল্পের হাল পরিস্থিতি উল্লেখ করে কর-শুল্ক হ্রাস বা রহিত করার এবং সরকারি বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধের ওপর জোর দিয়েছেন। এখানে বলা দরকার, করোনাকালে বিভিন্ন শিল্প সরকারি প্রণোদনা পেলেও সংবাদপত্রশিল্প পায়নি। শিল্প হিসেবে প্রণোদনা পাওয়ার হক সংবাদপত্রের থাকলেও কেন পায়নি, তার জবাব পাওয়া যায়নি। রুগ্ণশিল্প উদ্ধারে সব সময়ই সরকারের একটা দায়িত্ব থাকে। সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করে। সংবাদপত্রশিল্প, বলা বাহুল্য, রুগ্ণশিল্পের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অথচ, সরকারের এদিকে নজর নেই। সংবাদপত্রের ব্যাপারে সরকারের এহেন অনীহা ও উপেক্ষা মোটেই কাম্য হতে পারে না।

সংবাদপত্রকে বলা হয়, ‘দ্য ফোর্থ এস্টেট।’ একটি দেশে বা রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও ভূমিকার নিরিখেই তাকে এই অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। সংবাদপত্র তথ্যের নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী, যা সরকার ও জনগণের জন্য খুবই দরকারি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার্য। সংবাদপত্র কেবল তথ্য দেয় না, তথ্য বিশ্লেষণ ও গবেষণা পেশ করে। ইতি-নেতি তুলে ধরে। দিক নির্দেশনা দেয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংবাদপত্র সরকারের সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ, উন্নয়ন কাজের বিবরণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়। অন্যদিকে জনগণের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্খার কথা সরকারের গোচরে আনে। স্বাধীন সংবাদপত্র গণতন্ত্রের বাহন, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রহরী, গণশিক্ষার নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে আরো বহুবিধ ভূমিকা পালন করে সংবাদপত্র। এ কারণে সংবাদপত্রহীন রাষ্ট্রের কথা কেউ কল্পনা করতে পারে না। অস্বীকার করা যাবে না, সংবাদপত্রের কাজ বা দায়িত্ব কতকটা এখন রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, সোস্যাল মিডিয়া ইত্যাদি পালন করছে। কিন্তু কোনো কিছুই সংবাদপত্রের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। একটি দেশে ও সমাজে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আগে যেমন ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে বলে আশা করা যায়। অন্যান্য মিডিয়ার সঙ্গে সংবাদপত্রের যে প্রতিযোগিতা তাতে তার সক্ষমতার দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ সক্ষমতা বাড়াতে হবে, বাড়ানোর উপায় বের করতে হবে। এর প্রয়োজনীয় উপকরণাদির মূল্য ও উৎপাদন খরচ এমন একটা পর্যায়ে এনে স্থিতিশীল করতে হবে, যাতে এ শিল্প লাভজনক হয় গ্রাহক-ক্রেতা সুবিধাজনক দামে সংবাদপত্র কিনতে পারে। এটা ঠিক, আমাদের দেশেই কেবল নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সংবাদপত্র খুব ভালো অবস্থায় নেই। অসম প্রতিযোগিতা, পাঠকসংখ্যা হ্রাস, লোকসান ইত্যাদি কারণে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক সংবাদপত্রের মালিকানায় পরিবর্তন ঘটেছে। তারপরও সবদেশে সংবাদপত্র টিকে আছে, টিকে থাকবে।

আমাদের দেশেও সংবাদপত্র যাতে টিকে থাকে, তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে দেখা যায়। লোকসানের ভার অবহনযোগ্য হলেই মালিক তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এটা সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। কাজেই, সংবাদপত্রশিল্প যাতে লাভজনক পর্যায়ে থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য শিল্পের চেয়ে সংবাদপত্র আলাদা এই কারণে যে, এর রাষ্ট্রকল্যাণকামী, সামাজিক ও গণমুখী ভূমিকা আছে। এজন্য রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার, সমাজের পক্ষে বিত্তবান শ্রেণী, ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের পক্ষে সচেতন ব্যক্তিবর্গকে সংবাদপত্রের অস্তিত্ব সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। স্বতঃস্ফুর্ত অবদান রাখতে হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ সংবাদপত্র অলাভজনক বা লোকসানী। মালিকপক্ষ নানাভাবে চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে। ব্যয়সাশ্রয় করে, কম জনবল দিয়ে কাজ করছে। এতেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। সংবাদপত্র বেচে কিছু হয় না। এক কপি সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ ২২ টাকা। বিক্রয় মূল্য ১২ টাকা। এই ১২ টাকার ৩৫ শতাংশ দিতে হয় হকারদের। সংবাদপত্রের প্রধান আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন, বিশেষভাবে সরকারি বিজ্ঞাপন। সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টনে বৈষম্য বিদ্যমান। সরকার যাকে ইচ্ছে যত বিজ্ঞাপন দেয়। বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রাখার এটাই মূল উদ্দেশ্য। নোয়াব বলেছে, এখন অন্তত ১০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিল সরকারের কাছে বকেয়া পড়ে আছে। বিজ্ঞাপন বিল দ্রুত পরিশোধ করা হলে এই দুঃসময়ে সংবাদপত্রগুলোর মহা উপকার হতো। সংবাদপত্রে বিরাজমান সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে, আমরা আশা করবো, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে সংবাদপত্রের জন্য বিশেষ প্রণোদনা, বিজ্ঞাপনের সংখ্যা ও মূল্য বৃদ্ধি, উপকরণের কর-শুল্ক হ্রাস এবং বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল দ্রুত পরিশোধের কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জনগণের অধিকার, জাতীয় সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের সংবাদপত্রের রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান। সে কথা স্মরণ করে সংবাদপত্রের সুরক্ষা আমাদের জাতীয় কর্তব্যও বটে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন