Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিযোগিতা

ইলিয়াজ হোসেন রানা

| প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া এমনকি ইরান ও ভারত তাদের হাইপারসনিক অর্থাৎ শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে নয়গুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতার একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব চলছে এখন। এ মুহূর্তে প্রতিযোগিতাটা হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে। এতদিন ধরে বিভিন্ন দেশের হাতে যে সব দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, সেগুলো অনেকটা সেকেল হয়ে যাচ্ছে। তার শূন্যস্থান পূরণ করতেই এ প্রতিযোগিতা; কার আগে কে নতুন প্রজন্মের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারবে। তাছাড়া পরাশক্তিগুলোর হাতে এখন যেসব প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র আছে, এগুলো যেভাবে ঠেকাতে হবে তার কৌশল প্রতিপক্ষ দেশগুলো ইতোমধ্যে বের করে ফেলছে। তাই চেষ্টা চলছে এমন এক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি, যা প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে পারবে। আমরা জানি যে, শব্দের গতি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ১১২৫ ফুটের মতো। কিন্তু একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুটতে পারে শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে নয় গুণ বেশি গতিতে। রয়র্টাসের বিশ্লেষক বলেন, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে ঘণ্টায় ৩৮৫০ মাইল গতিতে ছুটতে পারে এই হাইপারসনিক মিসাইল। এটি উৎক্ষেপণের পর খুব দ্রুত ওপরে ওঠে আবার নেমে এসে আনুভূমিকভাবে বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই চলতে থাকে, গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। তার মানে, এটি কোন দিকে যাবে তা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। তাই তার মাঝপথে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।

বর্তমান আটটি দেশের কাছে এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এটির জনক বলা হয় রাশিয়াকে। রাশিয়া যখন সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করে তখন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এটি ব্যবহার করছে বলে ইউক্রেন সরকার দাবি করছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাশিয়ার কাছে এ ধরনের কয়েক প্রকার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিদ্যমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ডজনখানেক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে বলে পেন্টাগণ জানিয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের এই অস্ত্র প্রতিপক্ষকে প্রতিক্রিয়ার সময়টুকুও দেয় না, তার আগেই তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিরক্ষার সরঞ্জামগুলো ধ্বংস করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র গত জুলাই মাসে একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ছিল আরো একটু ভিন্ন ধরনের। এটি ছিল এয়ার ব্রিদিং হাইপারসনিক ওয়েপন, যা উৎক্ষেপণের পর একটা ইঞ্জিনচালিত ক্রজ মিসাইলের মতই বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে উড়ে গিয়ে তার লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

চীন যেভাবে তার ক্রমবর্ধমান সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রাংক কেন্ডাল বলেছেন, চীন এক নতুন অস্ত্র তৈরি করেছে এবং মহাশূন্য থেকে সারাবিশ্বে আঘাত হানতে পারে এমন অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ জেফরি লুইস বলেছেন, আমেরিকার ভেতরে আঘাত হানতে পারে এমন শ’খানেক পারমাণবিক আইসিবিএম চীনের হাতে এখনই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সদস্য মাইক গ্যালাহার সতর্ক করে বলেছেন, ওয়াশিংটন যদি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতেই আটকে থাকে, তাহলে চীনের সাথে এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক দশকের মধ্যে হেরে যাবে।

দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ‘সতর্ক ঝড়’ নামের ছয়দিনের বিমান মহড়া শুরু করার পর উত্তর কোরিয়া পরীক্ষামূলকভাবে সাগরে অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতশত কামানের গোলা ছুড়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। উত্তর কোরিয়া ঐ সময় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ঝড় বইয়ে দেয়। একদিনে সর্বোচ্চ নিক্ষেপণের রেকর্ডও গড়ে। পিয়ংইয়ং এ সময় একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। অন্যদিকে ইরান এবার হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। দেশটির আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম এমন দাবি করেছে। তাসনিমের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি শব্দের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ দ্রুত এবং এটি বায়ুমণ্ডলের মধ্যে এবং বাইরে কৌশলে চালানো সম্ভব। ক্ষেপণাস্ত্রটি শত্রুর উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিশানা করবে। আর ক্ষেপণাস্ত্রের জগতে এটি কয়েক প্রজন্ম এগিয়ে। ইরান তার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেই সৌদি আরবকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এখন পর্যন্ত ইরান দৃঢ় যৌক্তিকার সঙ্গে কৌশলগত ধৈর্য অবলম্বন করেছে। তবে শত্রুতা অব্যাহত থাকলে, এই ধৈর্য অব্যাহত রাখার আর কোনো পরিস্থিতির নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। ইরান যদি প্রতিশোধ নেয়ার এবং শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে কাচের প্রাসাদগুলো ভেঙ্গে যাবে এবং দুই দেশ আর স্থিতিশীল থাকার সুযোগ পাবে না।

প্রযুক্তির উৎকর্র্ষের সাথে সাথে উন্নত দেশগুলো নানান মরণঘাতি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। কৌশলগত ভূরাজনৈতিক কারণে উন্নত দেশগুলো এসকল অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আগামীর পৃথিবীকে সংঘাতময় করে তুলছে। সম্প্রতি নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ১ লাখ করে সেনা হতাহত হয়েছে। সংঘাতের কবলে পড়ে ৪০ হাজার বেসামরিক লোকজন নিহত হয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসনে ইউক্রেনের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ জনগণ বাস্তুচু্যুত হয়েছে। শীত আসার আগেই উভয় পক্ষকেই যুদ্ধ অবসানে আলোচনার বিষয়টি ভাবতে হবে। তীব্র শীতে দুই পক্ষের জন্যই লড়াই চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে; হতাহতের সংখ্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। হাইপারসনিক ক্ষমতাধর ৮টি রাষ্ট্র কেউ কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান, যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া, ইরান-সৌদিআরব, উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্কগুলো সাপ-বেজির সম্পর্কের মতো তিক্ত। ফলে এই তিক্ত সম্পর্কের কারণে পার্শ¦বর্তী বা স্বার্থের সম্পর্কজনিত দেশগুলো দিনদিন আরো বেশি হিংসাত্মক হয়ে উঠছে।

লেখক: প্রভাসক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন