Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে তৃতীয় ধাপের উদ্যোগ গ্রহণের সময় এসেছে

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

| প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:১৪ এএম

২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখটি আবেগের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের দিকে থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একটি চুক্তি হয়েছিলো। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পিস অ্যাকর্ড। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বরে এই চুক্তি নিয়ে এবং যে সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে চুক্তি করা হয়েছিলো সেটি নিয়ে কিছু কথা অবশ্যই আলোচনা করা যায়। চুক্তিটি কতটা প্রাসঙ্গিক তখন ছিলো, এখনই বা কতটা প্রাসঙ্গিক আছে, এটিই আমাদের আলোচ্য বিষয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান এবং তার ইতিবৃত্ত দিতে গেলে ইতিহাসে ফেরত যেতে হবে। এ ব্যাপারে আমার নিজের লেখা প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার একটি বই আছে। বহুল প্রচারিত ও পরিচিত বইটির নাম, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। যাদের পক্ষে সম্ভব, তারা পড়বেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক এলাকা হচ্ছে বর্তমানের তিনটি প্রশাসনিক জেলার সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসনিক ভূখণ্ড। বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড নিয়েই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।

এখানে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি বসবাস করে। বাংলাদেশ সরকারের মতে, তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি। আবার এই জনগোষ্ঠিগুলোর মতে, তারা আদিবাসী। এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিলো। ১৯০১ সাল থেকে এখানে তিনটি সার্কেল ছিলো। কাগজে-কলমে সার্কেল মানে বৃত্ত। আর এখানে সার্কেল মানে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূখণ্ডের উপর তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের নিমিত্তে যে বন্দোবস্তনিয়ে ছিলো সেই বন্দোবস্তটা তারা জেলা, উপজেলা, মহকুমাÑ এই রকম কোনো নাম না দিয়ে নাম দিয়েছিলো সার্কেল।

কেন্দ্রস্থলে ছিলো চাকমা সার্কেল। উত্তরদিকে মানিকছড়িতে ছিলো মং সার্কেল। আর দক্ষিণে বান্দরবানকে কেন্দ্র করে ছিলো বোমাং সার্কেল। সার্কেল প্রধানদের বলা হতো রাজা। কিন্তু ইংরেজিতে তাদের ‘কিং’ বলা হয় নাই। ইংরেজিতে বলা হয়েছে ‘সার্কেল চিফ’। তাদের ওখানে ব্রিটিশ সরকারের আইন-আদালত চলতো না। সেখানে লেখাপড়ার সুযোগ ছিলো কম। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, খাজনা আদায়, খাজনা নির্ধারণ ইত্যাদি ছিলো নিজেদের মতো। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান উপজাতি চাকমা নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠির নেতৃবর্গ চেয়েছিলেন ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হতে। ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হলে তারা বর্তমান ভারতের মিজোরাম অথবা ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যুক্ত হতেন। কিন্তু সেসময়ের ভারতীয় কংগ্রেস নেতারা তাদের গ্রহণ করেননি। ব্রিটিশ সরকারও তাদের দাবি গ্রহণ করেনি।

আর ১৯৪৭ সালে ভারতীয় মুসলিম লীগ অথবা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ চেয়েছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন পাকিস্তানের সঙ্গে থাকে। ভৌগোলিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা অথবা পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক কাছে। অপরপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিজোরাম হয়ে বা ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে আসাম হয়ে শিলিগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গ কলকাতা এবং ভারতের রাজধানী দিল্লির দূরত্ব ছিল বিশাল। যাক, যা হবার ১৯৪৭ সালে হয়েছে।

১৯৪৭ সালের পরবর্তী পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠি উপযুক্ত ন্যায়বিচার, সুশাসন কিংবা স্নেহ-মায়া পায় নাই। গত শতকের ষাটের দশকে যখন কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং বাস্তবায়ন শুরু করা হয় তখন সেখানে একটি মানবিক বিপর্যয় ঘটে। তবে সেই মানবিক বিপর্যয়ের জন্য কোনো মতেই শুধু পূর্ব পাকিস্তানের সরকার দায়ী ছিলো না বা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকার তো কোনো মতে বা কোনো প্রশ্নেই দায়ী থাকার কথা নয়। বিশ্বব্যাপী তখন পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করার প্রবণতা ছিলো। কাপ্তাই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বা উদ্বাস্তু হয়। তারা সবাই রাঙামাটি জেলায় রাঙামাটি শহর থেকে উত্তর-দক্ষিণ দিকের কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অধিবাসী ছিল। তারা উদ্বাস্তু হয়ে চলে যায় খাগড়াছড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে, যেখানে আগে মানুষ ছিলো না। অল্প কিছু যায় বান্দরবান জেলায় এবং বিরাট একটা অংশ চলে যায় বর্তমান ভারতের অরুণাচল প্রদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে, যেখানে কোনো জনবসতিই ছিলো না। সেই সময় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করা হয় নাই। আর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় নাই। দেওয়া হলেও সঠিক ব্যক্তি সঠিক সময়ে তা পায় নাই। একথাটা বলার পিছনে কারণ হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তির মূলে যতগুলি কারণ, তার মধ্যে এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

গত শতাব্দির ষাটের দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক জাগরণ শুরু হয়েছিল, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণও একটু একটু করে জেগে উঠছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবর্গ বিশেষভাবে চাকমা সম্প্রদায়ভুক্ত নেতৃবৃন্দ বুঝেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান যেমন পাকিস্তানের কেন্দ্র থেকে অবহেলিত, আমারা পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীও পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্র থেকে অবহেলিত। তাহলে আমাদের নিজেদের কিছু বিহিত করা উচিত। এই প্রসঙ্গেই তারা ১৯৭০ সালে একটি রাজনৈতিক দল করেছিলেন। কিন্তু সেটা বেশি অগ্রগতি লাভ করার আগেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

মুক্তি যুদ্ধ শুরু হলে আবারও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের নেতারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একভাগ পাকিস্তানের পক্ষে থাকে, পাকিস্তানকে সহায়তা করে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। আরেক ভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে এবং তাদের অনুসারীদের নিয়ে কিছু কিছু মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে।

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেমন ঘটনাবলি ঘটেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামেও ঘটেছে। সবকিছু মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিলো। তাদের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করে সমাধান চেয়েছিলেন, প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেদিকে আগান নাই। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু রাঙামাটি সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি এমন একটা বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, যে বাক্যটি (এখন পিছনের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়) অত্যন্ত ক্ষতিকারক ছিলো। এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ১৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবর্গ চিন্তা করলেন, এখন তারা কী করবেন? অবশ্য এর আগেই তারা একটা কাজ করে ফেলেছিলেন। একটা রাজনৈতিক দল করেছিলেন। ১৯৭০ সালে গঠন করা দলটিকে তারা রূপান্তর করেছিলেন। ১৯৭০ সালের দলটির নাম ছিল রাঙামাটি কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭২ সালে এসে দলটির নাম হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। আবার ১৯৭৩ সালে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একটি শাখা খুললো অস্ত্রধারীদের শাখা। সে শাখাটি পরিচিতি পেয়েছিলো শান্তি বাহিনী নামে। ১৯৭২ সাল থেকে পরের প্রায় একদশক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির প্রধান ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হওয়ার পর এর দায়িত নেন তার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমা, যিনি সংক্ষেপে সন্তু লারমা নামে পরিচিত। তিনি ২০২২ সালের নভেম্বরেও (গত ২৫ বছর যাবত) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অনির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে শান্তি বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তারা সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে। সেই সশস্ত্র সংগ্রাম তারা শুরু করে ১৯৭৫ এর ডিসেম্বর থেকে। তারা সকলেই ছিল বামপন্থি। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্তবাদী শাসন ব্যবস্থা বদলে ফেলা। আমি সামন্তবাদী শব্দটা ব্যবহার করলাম এই জন্য যে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে যে রাজাপ্রথা, হেডম্যান-কারবারিপ্রথা, এই প্রথা উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষকে নিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

একটা গোষ্ঠি যখন সশস্ত্র বিদ্রোহ করে তখন সরকার কী করে? সরকার সেই বিদ্রোহ দমনের জন্য পদক্ষেপ নেয়। সেই পদক্ষেপগুলি একাধিকমুখী বা একাধিক আঙ্গিকের হয়। যেমন মানুষের মনের কষ্ট লাঘব করার জন্য মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থা, মানুষের অভাব-অনটন দূর করার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানুষের জীবনযাপনকে স্বচ্ছল করার জন্য ভৌত কাঠামো ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি করে। বাংলাদেশ সরকারও ঠিক তাই করে। সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র ব্যক্তিদের দমন করার জন্য বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে মোতায়েন করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ হয়ে পড়ে শিল এবং পাটার মাঝখানের মরিচের মতো। কারণ, বিদ্রোহীরা বলতো, তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যই এই আন্দোলন এবং সশস্ত্র যুদ্ধ। বাংলাদেশ সরকারও বলেন, তাদের শান্তি রক্ষার জন্যই সেনাবাহিনীকে এখানে প্রয়োজন। শান্তি বাহিনীর মধ্যে সব সময় সকল ব্যক্তি যে একই মত পোষণ করতো তার কোনো গ্যারান্টি তখনও ছিলো না, এখনও নাই। মাঝে-মধ্যে তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিতো। সবচেয়ে বড় বিভেদ দেখা দেয় আশির দশকের শুরুতে। এটাকে তাদের ভাষায় বলা হয় গৃহযুদ্ধ। সেই গৃহযুদ্ধ ছিলো দুইটা গ্রুপের মধ্যে। একটা হলো সন্তু লারমার গ্রুপ, অপরটি প্রীতি গ্রুপ। লারমা গ্রুপের বক্তব্য ছিলো, আমরা দীর্ঘমেয়াদি বা লম্বা সংগ্রাম করে আমাদের দাবি আদায় করবো। আর প্রীতি গ্রুপের বক্তব্য, আমরা সংক্ষিপ্ত মেয়াদে সংগ্রাম করে অধিকার আদায় করবো। তাদের এই মতপার্থক্য দেখা দেয়ার একপর্যায়ে যুদ্ধ হয় পরস্পরের মধ্যে। এতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ অনেক নেতা নিহত হন। এর পর প্রীতি গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে এবং শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে আসে। লারমা গ্রুপ তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়।

একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, শান্তি বাহিনী তথা পিসিজেএসএস আসলে রাজনৈতিকভাবে কী চায়? এই চাওয়াটা তারা সর্বপ্রথম দেয় ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখে। সেদিন তারা ৫ দফা দাবি দিয়েছিলো সরকারপক্ষের প্রতিনিধি দলের হাতে। সেই প্রতিনিধি দলে আমি উপনেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। পরবর্তী তিনটি আলোচনাতে আমি নিজেই নেতা ছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির জেলার পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী ইউনিয়নে জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত চেঙ্গী ইউনিয়ন কমিউনিটি সেন্টারে আমাদের বৈঠক হতো।

আজকের পাঠকরা শুনে আর্শ্চয হবেন যে, সেই সময় আমরা নিরস্ত্র অবস্থায় সিভিল কাপড়ে কোনো ওয়্যারলেস, কোনো টেলিফোন সেট ছাড়াই শান্তি বাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের কাছে আলোচনায় যেতাম। আমরা যেকোন সময় গুম হতে পারতাম, যেকোন সময় নিহত হতে পারতাম। কিন্তু দেশের স্বার্থে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা এবং আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা সেই রিস্ক নিয়েছিলাম। আলোচনার জন্য তারা যেন বাংলাদেশে নিরাপদ বোধ করে, সেজন্য আমাদের খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি অঞ্চলের প্রায় ২০-২৫টি আর্মি এবং বিডিআর ক্যাম্পকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হতো ৭ দিনের জন্য। আলোচনার তিনদিন আগ থেকে আলোচনার তিনদিন পর পর্যন্ত।

শান্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে যে দাবিনামাটা দিয়েছিলো সরকারি প্রতিনিধি দলের হাতে সেখানে ১নং দাবি ছিলো, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা বদলের দাবি। সেই দাবি মোতাবেক, বাংলাদেশ হবে একটি ফেডারেশন। একটা প্রদেশের নাম হবে জুম্ম ল্যান্ড, যার রাজধানী হবে রাঙামাটি এবং অঞ্চল হবে পুরো পাবর্ত্য চট্টগ্রাম। আর একটি প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ, রাজধানী হবে ঢাকা। জুম্ম ল্যান্ড এবং বাংলাদেশ নামক দুইটি প্রদেশ মিলে একটি ফেডারেশন করবে, সেই ফেডারেশনের নাম হবে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ। ফেডারেল রাজধানী হবে ঢাকা। ফেডারেল তথা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চারটি মাত্র বিষয় থাকবে। যথা: অর্থ, ভারী শিল্প, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি। আর অন্যান্য সকল বিষয় (৪০টির ঊর্ধ্বে সেগুলো) থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। এটা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিলো। বাংলাদেশ সরকার দাবিটাকে গ্রহণ করতে পারেনি। তখন সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শান্তি বাহিনী চায় তাদের দাবিনামা গৃহীত হোক এবং বাস্তবায়ন হোক। বাংলাদেশ সরকার চায়, এই দাবি গ্রহণ করা যাবে না। বাংলাদেশ বিকল্প দাবি চায়। সংবিধানের অধীনে যতটুকু সম্ভব দিতে চায়।

শান্তি বাহিনী বিকল্প প্রস্তাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তখন বাংলাদেশ সরকার নতুনভাবে শুরু করে, শান্তি বাহিনীর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠির মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয়, তাদের সাথে আলাপ করে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। সেই শান্তি প্রক্রিয়াতে আমি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম এবং আমার অঞ্চলে আমি নিজেই চালিকাশক্তি ছিলাম। আমাকে অবশ্যই সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুল সালাম এবং রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এই প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলার জন্য আলাদা আলাদা পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছিলো।
১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে এ ব্যাপারে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের পার্লামেন্ট আইন পাশ করে। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন ওই আইনগুলোর অধীনে সকলের ভোটে তিনটি পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচিত হয়। সেই নির্বাচনের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলো শান্তি বাহিনী, যেন নির্বাচনে অনুষ্ঠিত করা না যায়। কিন্তু নির্বাচন আমরা করেছি। সেই সময় যুদ্ধক্ষেত্রের প্রধান অঞ্চল ছিলো খাগড়াছড়ি এবং সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রের প্রধান চালিকাশক্তি ছিলাম আমি। তবে আমার অন্তর ছিলো শতভাগ কল্যাণমুখী। বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পুরো খাগড়াছড়ি অঞ্চলের সকল সামরিক, আধাসামরিক শক্তি এবং প্রশাসন আমরা সকলে মিলে ২৫ জুন ১৯৮৯ নির্বাচনটি সম্পন্ন করেছিলাম। সেই নির্বাচিত পরিষদগুলি তিন বছর মেয়াদের ছিলো। আজকে শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পর এবং সেই স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের ৩৬ বছর পর পিছনের দিকে তাকিয়ে আমরা বলতে পারি, এটা ইতিবাচক ছিলো। কোনো গাছে একদিনে ফল ধরে না। কোনো বাচ্চা একদিনে এসএসসি পাশ করে না। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় বলতেই হয় যে, সেদিনের উদ্যোগটি একটি সফল উদ্যোগ ছিল।

নির্বাচনের তিন বছর পর পার্বত্য জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নতুন নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়নি। বিএনপি সেই সময় নির্বাচন দিয়ে সাফল্য নিজেদের ঘরে তুলতে পারতো। কিন্তু সেও সেটি করেনি। বিএনপি জেলা পরিষদের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। তিন বছরের জেলা পরিষদ ৮-৯ বছর দায়িত্ব পালন করে। এরপর থেকে সরকার মনোনীত তিন বা চার সদস্য বিশিষ্ট পরিষদ দিয়ে কাজ চালানো শুরু হলো। আজ অবধি সেখানে নির্বাচনের কোনো রাস্তা নেই। ১৯৮৭-১৯৮৯ সালে রচিত ভিত্তির ওপর আওয়ামী লীগ সরকার একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করায়। ১৯৯৬ ক্ষমতায় আসার পর শান্তি বাহিনী চাপ দিলো এবং আওয়ামী লীগ সরকারও বুঝে নিলো যে, শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে সরকারের একটি বড় রাজনৈতিক অর্জন সম্ভব। তাই তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আমি সেই সকল অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিত ছিলাম না। কেননা, আওয়ামী লীগ সরকারের একটি ত্রুটি হলো, তারা উপযুক্ত ব্যক্তিকে ক্রেডিট দিতে অপারগ, অনীহা প্রকাশ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রক্রিয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান যতটুকু তার থেকে বেশি অবদান তার আগের আমলের। এই স্বীকৃতিটা আওয়ামী লীগ সরকার দেয় না। না দিলেও কোনো আপত্তি নেই। মানুষ উপকৃত হলেই আমরা খুশি। যাহোক, ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতেও ত্রুটি আছে। এর প্রধান ত্রুটি হলো, এটা ভূমি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। দ্বিতীয় ত্রুটি হলো, বাঙালিদের সমঅধিকার বা সম স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারেনি।

১৯৭৭-১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। তিনি শান্তি বাহিনীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আপনার আলোচনায় আসুন, আমরা চেষ্টা করি সমাধান বের করতে। কিন্তু শান্তি বাহিনীর মনের মধ্যে ছিল অন্য চিন্তা। তাদের স্বপ্ন ছিল, তারা লম্বা যুদ্ধ করবে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করবে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সাথে আলোচনায় গেলে তো সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে, তাদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। অতএব, তারা আলোচনা করতে অস্বীকার করেন। তখন জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, আপনারা যদি আলোচনায় না আসেন, তাহলেও সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে আমাকে একটা রাস্তা বের করতে হবে। সেই রাস্তা বের করার একটা ব্যবস্থা নেন জিয়াউর রহমান। তিনি চিন্তা করলেন যে, পাহাড়ে অনেক জমি। এটাকে আবাদ করতে হবে, এখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে হবে মানে যেহেতু সেখানে স্কুল নাই, রাস্তা নাই, ঘাট নাই, হাসপাতালসহ অনেক কিছু নাই। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করার কাজ দিলেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানোর অন্যতম অনুষঙ্গ হলো শ্রমিক। পাহাড়ি ভাইয়েরাতো রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ কাজ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে অনভিজ্ঞ ছিলো। তাদের একমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল বাঁশ কাটা। তারপরও কিছু কিছু পাহাড়ি শ্রমিক চেষ্টা করলেও শান্তি বাহিনী তাদের গুলি করে হত্যা করত, কোনো পাহাড়ি ভাই শ্রমিক হিসেবে দায়িত্ব নিতে চাইলে তাদের গ্রামসহ জ্বালিয়ে দিত শান্তি বাহিনী। অতএব, উন্নয়ন কাজের জন্য বাঙালিদের শ্রমিক হিসেবে আনা হলো। বাঙালিদের এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন খাস জমিতে বসবাস করার জন্য বন্দোবস্ত দেয়া হলো। সেই সময় বাঙালিদের পুনর্বাসন করতে গিয়েও কিছু ভুলত্রুটি তখনকার কর্মকর্তারা করেছেন। অনেক সময় পাহাড়িদের জমিকে খাস জমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। অনেক সময় খাস জমিকে পাহাড়িদের দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পাহাড়িরা জানে না যে, এটা খাস জমি। এক বাঙালির নামে আরেক বাঙালিকে জমি দেয়া হয়েছে ইত্যাদি। বাঙালিদের পুনর্বাসন করায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি অসন্তুষ্ট হয়। আর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এই বাঙালিরা যাওয়ার কারণেই সেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্ভব হয়েছে। সেখানে আবাদ সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশে প্রশাসনের সঙ্গে যোগসূত্র শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এটাও বাস্তবতা, জিয়াউর রহমানের আমল থেকে পাহাড়ি ভাইদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা ছিলো বা এখনো আছে, সেগুলো কিন্তু বাঙালিরা পায় না। যেমন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি, প্রকৌশল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বিদেশে স্কলারশিপের জন্য এবং চাকরির জন্য যেসকল কোটা আছে, সে কোটা কেবল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ব্যক্তিদের জন্যই বরাদ্দ আছে। অতএব, বাঙালিরাও এখন অসন্তুষ্ট।

তাছাড়া ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে যে সকল বাঙালিকে তাদের স্থান থেকে উঠিয়ে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিল; ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের একটি করে ঘর তাদের দেয়া হয়েছিল। কথা ছিল ৩/৪ বছরের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে করে ভূমির পরিমাণ ও ঠিকানা বের করে পাহাড়ি ভাইদের জমি বুঝিয়ে দেয়া হবে, অবশিষ্ট খাস জমি বাঙালিদের দেয়া হবে, যেন ভুলভ্রান্তির অবসান হয়। কিন্তু পাহাড়ি ভাইদের বিরোধিতার মুখে, শান্তি বাহিনীর বিরোধিতার মুখে আর সে কেডাস্ট্রাল সার্ভে আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ১৯৯৭ সালের চুক্তিতে যে ধারাটি আছে বাঙালিদের নিয়ে তাতেও সমস্যা আছে। যদিও সেটি প্রত্যক্ষভাবে লেখা হয়নি। সেখানে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুটি ভোটার তালিকা হবে। একটা ভোটার তালিকা হবে সংসদীয় নির্বাচনের জন্য, যেখানে সবাই ভোট দিতে পারবে। আরেকটা ভোটার তালিকা হবে আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য। যেখানে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণ ভোট দিতে পারবে। আবার সেখানে অধিবাসী হতে হলে শর্ত দেয়া হয়েছে নিজের নামে জায়গা-জমি থাকতে হবে। তারা যে সেখানকার অধিবাসী তার সার্টিফিকেট দেবেন সার্কেল চিফ, হেডম্যান বা কার্বারি। তাই জিনিসটা একপেশে হয়ে গিয়েছে। বাঙালিদের সেখান থেকে স্থানচ্যুতির একটা বন্দোবস্ত বলেও এটাকে ধরে নেওয়া যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। সেটার বয়স ৪৭ বছর। প্রথম যে সংবিধানের আওতায় চুক্তি হয়েছে, সেটা ৩৬ বছর আগে এবং শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পর আমাদের সকলেরই উচিত পিছনের দিকে তাকানো, নির্মোহভাবে চিন্তা করা, কী করলে ভালো হয়। আমি মনে করি, ১৯৮৭-৮৮ সালে যে কাজগুলো করা হয়েছিল সেই প্রক্রিয়ার ভুল-ত্রুটিগুলো বের করা হোক এবং সেটাকে উন্নত করা হোক। ১৯৯৭ সালে যে চুক্তি করা হয়েছিল সেটির ভুলত্রুটিগুলো গবেষণা করা হোক, মূল্যায়ন করা হোক এবং উন্নতি করা হোক এবং ২০২২ সালে ডিসেম্বরের পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের তৃতীয় ধাপের শুভ সূচনা হোক। প্রথম ধাপ ১৯৮৭-৮৮-৮৯ সালকে যদি মনে করি বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায়, আইনানুগ প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অধিবাসীকে শাসন ব্যবস্থায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত করা। দ্বিতীয় ধাপ ১৯৯৭ সালের চুক্তি, সংশ্লিষ্ট আইনগুলো এবং তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। এর পর তৃতীয় ধাপ বলতে বুঝাচ্ছি ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পরের বাস্তবতাকে। বাংলাদেশের যে সরকার প্রধান ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনিই এখন সরকার প্রধান। আমার আবেদন থাকবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি বা পাহাড়ি ভাইবোনদের থেকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নেন এবং বাঙালিদের থেকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নেন। বিচার বিভাগীয় ব্যক্তিদের নেন , চাকরিরত বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের থেকে নেন। এরকম ৮ থেকে ১০ জনের একটা প্যানেল করেন। প্যানেল করে পার্বত্য অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করেন। মূল্যায়ন করে ক্রুটিগুলি বের করেন, দুর্বলতাগুলি বের করেন। কোথায় কোথায় আমাদের অগ্রগতি কম হয়েছে তা বের করে সেগুলোর সমাধানের নিমিত্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করেন। কারণ, বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বা তার প্রতিবেশী অঞ্চল নিয়ে কোনমতেই শুভ নয়। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারে সীমান্ত অতি দুর্গম পাহাড়। সেখানে অনেক ঘটনা ২০২২ সালের শেষ ৫-৬ মাসে ঘটেছে। এই সীমান্ত নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ, মিয়ানমার নিজেই একটি অস্থিতিশীল, অশান্ত রাষ্ট্র। তাদের অশান্ত পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা যে ব্যবস্থা নেয়, তার প্রতিক্রিয়া আমাদের ভূখণ্ডে এসে পড়ে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামেও সাম্প্রতিক সময়ে বড় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও অন্য শক্তিকে নিয়ে। নতুন কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠির আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা আবার যে জেগে উঠবে না, তার তো গ্যারান্টি নাই। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম বিদ্রোহী রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠির নাম ছিল জেএসএস এবং তাদের সশস্ত্র বাহিনীর নাম ছিল শান্তি বাহিনী। তাদের কাছ থেকে বিদ্রোহ করে এখন থেকে প্রায় ২৪-২৫ বছর আগে নতুন দল গড়ে উঠেছিলো ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর গত ৯-১০ বছর পর সন্তু লারমার জেএসএস এর একটি সংস্কারবাদী অংশ বের হয়ে গঠন করে জেএসএস (সংস্কার)। আবার ইউপিডিএফ থেকে গত ৩-৪ বছর আগে একটা অংশ বের হয়ে গিয়ে নিজেরেদর পরিচয় দেয় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। আরো দুটি গোষ্ঠির নাম শোনা যায়, মারমা ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) এবং কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এইগুলো সবই এমন এমন জনগোষ্ঠি, যাদের কিছু অংশ বার্মায় পড়ে, কিছু অংশ বাংলাদেশে পড়ে। তাদের পক্ষে সেই দুর্গম অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করা খুবই সহজ। তাই আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান রাখবো, শুধুমাত্র সামরিক বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশের মূল ধারা থেকে কিঞ্চিৎ ভিন্নতা আছে। সেটাকে আমাদের মাথার রাখতে হবে। আমরা বাংলাদেশের মূল ধারার সঙ্গে তাদের একাত্মতায় আনতে চাইলে, তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই আনতে হবে। আমার আবেদন, এই সংঘাত, বৈরী পরিবেশ ও বৈরী ব্যবস্থা আর চলতে দেওয়া উচিত না। সেখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠি এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠি যেন মিলেমিশে থাকতে পারে, সেখানে যেন সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধ হয় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অশান্ত পরিবেশ যেন সেখানে না আসে তার জন্যই সকলকে নিয়ে একটি উদ্যোগ নিতে হবে। আর সেই উদ্যোগটি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি, বাঙালি সকলে মিলে মিশে থাকার পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও প্রয়োজন।

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি



 

Show all comments
  • MD Biplob Uddin ২ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:৫৫ এএম says : 0
    পাহাড়িরা বাংলাদেশের নাগরিক আমাদের ভাই। কিন্তু বিদেশিদের চক্রান্তের নীলনকশার বাস্তবায়নের। শাম্ভ নারমার কিছুই করতে পারবে না
    Total Reply(0) Reply
  • M Abdullah Khan ২ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:৫৬ এএম says : 0
    পাহাড়ি-বাঙালী ভাই ভাই, সংঘাত নয়, শান্তি চাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Tipu Sultan ২ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:৫৭ এএম says : 0
    পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি হয়েছে ঠিক, কিন্তু এটা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির জন্য কালো অধ্যায়। কারণ বাঙালিরা আজ সবকিছু থেকে বঞ্চিত, এমপি,মন্ত্রী, জেলাপরিষদ, উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা, প্রশাসনের আইন সবকিছু থেকে বাঙালিরা বঞ্চিত। বাঙালিরা আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে অ-উপজাতি হিসেবে বসবাস করতেছে। বাঙালিদের জন্য আছে শুরু পাহাড়ি শান্তিবাহিনী ও পাহাড়ি জম্মু জঙ্গিদের দ্বারা বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ।
    Total Reply(0) Reply
  • Sheikh Jamal ২ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:৫৮ এএম says : 0
    স্বাধীন সার্বভৌম সীমানার ভেতরে গড়ে ওঠা কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে শান্তিচুক্তি করা,জাতির দুর্বলতাই প্রকাশ করে।অথচ খুব অল্প সময়ে নিয়মিত বাহিনী দিয়েই এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে শেকড়বাকড় সহ গুড়িয়ে দেয়া সম্ভব। অদূরদর্শিতায় করা শান্তিচুক্তি আজ আবারও পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে, বাংলাদেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছে। পার্বত্য সন্ত্রাসীদের সাথে শান্তিচুক্তি আমাদের জন্য অসম্মানজনক। এটা বাতিল করা হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন