Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাসযোগ্য রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন রুখতে হবে

জামালউদ্দিন বারী

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

দেশের উন্নয়ন ও প্রগতিশীলতা মানদণ্ড শুধু রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার দ্বারা নির্ধারিত হয় না। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাহ্যিক চাকচিক্যও এখন আর উন্নয়নের মানদণ্ড নয়। পুঁজিবাদের মুক্তবাজার অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, ভোগবাদী জীবন দর্শন এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতানুগতিক হিসাব বিশ্বকে এক অনিবার্য বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি শিল্পায়ন ও ফসিল জ্বালানি ব্যহার করলেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার দেশগুলো উদীয়মান অর্থনীতির অথবা অতি দরিদ্র। জাতিসংঘের মানদণ্ডে বাংলাদেশ এলডিসির তালিকা থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কথা বলা হলেও করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেকটা থমকে দাঁড়িয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি পরিসংখ্যানের হিসাবে, মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হওয়ার যে তথ্য আমরা পাচ্ছি, তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থনৈতিক ও জীবনমান উন্নয়নের ফলাফল নির্দেশ করছে না। দেশে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হলেও বছরে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে গেছে। ভেতর থেকে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উন্নয়ন খাতে যে পরিমান অর্থ গত ১৪ বছরে খরচ করা হয়েছে, আগের ৪০ বছরেও তা করা হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানির সক্ষমতা না থাকায় এখন অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের সাফল্য উদযাপনের পর গড়ে ৮-১০ ঘন্টা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে দেশ। উন্নয়নের রাজনৈতিক বোলচাল যেন শুভঙ্করের ফাঁকিতে পরিনত হয়েছে। একদিকে দেশের বেশিরভাগ মানুষ খাদ্য-পুষ্টি, চিকিৎসা, শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছেনা, অন্যদিকে বিচারহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা, বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা অনিশ্চয়তা এবং সর্বব্যাপী দূষণের শিকার হয়ে নগর ও জনপদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে ঢাকা বিশ্বের নিকৃষ্ট নগরীর তালিকায় স্থান পাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর, সবচেয়ে যানজটের শহর, নদী ও পানিদূষণের শহর, শব্দদূষণের শহর এবং ফুটপাথ দখল, চাঁদাবাজি ও পরিবহন মাফিয়াদের কাছে সাধারণ নাগরিকদের জিম্মি হয়ে পড়া শহর হিসেবে ঢাকার পরিচিতি লাভ করে চলেছে। লাখ লাখ মানুষ ঘিঞ্জি বস্তিতে বাস করছে। একশ্রেণীর পুলিশ, রাজনৈতিক গডফাদারদের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্য, কিশোর গ্যাং, ভাড়াটিয়া খুনী ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের ত্রাস ও দখলবাজির অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে।

সর্বক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকা একটি পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নগর পরিকল্পনাবিদরা ঢাকার পুর্নগঠন ও বাসযোগ্যতা রক্ষা করতে যেসব পরামর্শ দিয়েছেন তার মূল নির্দেশনা হচ্ছে, ঢাকার পুরনো অংশগুলো সংস্কারের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়ায় শহরটিকে পূর্বদিকে সরিয়ে নেয়া। সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে ঢাকার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে সপ্তদশ শতকে যে ঢাকার গোড়াপত্তন হয়েছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে তার অগ্রযাত্রা দেড়শ’ বছর ধরে থমকে থাকার পর ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ঢাকার যে নতুন অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু রাজনীতিবিদ ও সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ আন্দোলনের মুখে মাত্র ৬ বছরের মাথায় ইংরেজের বঙ্গভঙ্গ রদ করে তা রুদ্ধ করে দেয়া হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতারা তাদের পুরনো মতবাদ পাল্টে ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা গেছে। যারা ১৯০৫ সালে নতুন প্রদেশ গঠনকে বঙ্গমায়ের অঙ্গচ্ছেদ বলে কুম্বিরাশ্রু বর্ষণ করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তারা এবং তাদের উত্তরসুরিরা ১৯৪৭ সালে এসে বাংলাভাগের দাবিতে অটল অবস্থান গ্রহণ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে নতুন পরিকল্পনায় গড়ে তুলতে ষাটের দশকের শুরুতে ডিআইটি বা ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ১৯৬২-৬৩ সালে আইয়ুব খানের আমলে সৃষ্ট ঢাকার প্রথম নগর পরিকল্পনার আংশিক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আজকের ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে। প্রাদেশিক রাজধানী ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার অবস্থান এক কথা নয়। তেষট্টি সালে সূচিত ঢাকার প্রথম নগর পরিকল্পনা অনুসরণ করার পাশাপাশি তার সময়োপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে ঢাকা শহর আজকের এই বিপর্যয় এবং বসবাসের অযোগ্য নগরীর অপবাদের সম্মুখীন হতো না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকায় ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের দূতাবাস ও কনস্যুলেট অফিসের কার্যক্রম সীমিত করে লোকবল অন্যন্ত্র স্থানান্তর করতে দেখা গেছে। বৃটেনের ভিসা সেন্টার ঢাকা থেকে ভারতে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। পরে আবার ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলেও তাদের এমন সিদ্ধান্ত ঢাকার জন্য অবমাননাকর। গত সপ্তাহে জার্মান দূতাবাসের উপ-রাষ্ট্রদূত জা জেনোস্কি অভিজাত এলাকা গুলশানের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগের সপ্তাহে ঢাকায় মিট দ্য রিপোটার্স প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে বাংলাদেশে ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে গ্রহণ এবং পুলিশ সদস্যরা ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরার কাহিনী উল্লেখ করে জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, বিশ্বের আর কোথাও এ ধরণের ঘটনার কথা তিনি শোনেননি। একটি দেশ এবং তার সমৃদ্ধ জনপদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার পেছনে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ, সুশিক্ষা ও সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে তার অনুপস্থিতি দেশকে অকার্যকর ও বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে।

কোনো শহরের বাসযোগ্যতার মানদণ্ড ঠিক করতে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে ৫টি বিষয়কে বিবেচনায় রাখে তা হচ্ছে, সামগ্রিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। তিনদিকে নদীবেষ্টিত ঢাকা নগরী বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব, মনোমুগ্ধকর ও আধুনিক নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন মেগাসিটি হওয়ার সব রকম যোগ্যতা ও সম্ভাবনা ঢাকা শহরের ছিল। পরিকল্পনাহীনতা, অদক্ষতা ও দর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের কারণে তা সম্ভব হয়নি। একেকটি পরিকল্পিত নগরী শত বছরের ডেমোগ্রাফি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, নতুন প্রযুক্তি ও মানুষের পরিবর্তনশীল প্রবণতাকে সামনে রেখে গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পরিবেশগত নিরাপত্তা, বাস্তু পরিকল্পনা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখে নগরীর সুয়্যারেজ সিস্টেম, ইউটিলিটি সার্ভিস ও যোগাযোগ অবকাঠামোগুলোর সর্বোচ্চ উপযোগীতা নিশ্চিত করা। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই যত্রতত্র হাইরাইজ ভবন নির্মান করা হলেও সে অনুসারে রাস্তা, ফুটপাত, সুয়্যারেজ ও বর্জ্যব্যবস্থা গড়ে না ওঠা এবং বর্ষা-বৃষ্টির পানি অবাধ চলাচলের জন্য খাল, পুকুর-ডোবা জলাভূমি ও নিম্নস্থানগুলো রক্ষার বদলে প্রাকৃতিক কারণে গুরুত্ববহ শহরের এসব পশ্চাৎভূমিগুলো ভূমিদস্যুদের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অপরিকল্পিত আবাসন, শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে পুরনো শহরকে একদিকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে, অন্যদিকে ভূমিদস্যুতার মধ্য দিয়ে আবাসন কোম্পানিগুলো নতুন শহরের প্রান্তে নতুন নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্পোরেট কোম্পানিতে পরিনত হয়েছে। এদের টাকায় দেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বিপুলভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। গত দুই দশকে দেশের রাজনীতিতে প্রথাগত আদর্শিক রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে কালোটাকার মালিকরাই বেশি প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে কালোটাকার মালিকদের এমপি-মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে মুনাফাবাজির আশ্রয়স্থলে পরিনত করেছে। এরা শেয়ারবাজারে কারসাজি করে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিকে পথে বসায়। এরা ব্যাংকের মালিক-ডিরেক্টর হয়ে পারস্পরিক যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে দিয়েছে। এদেরই কেউ কেউ শহরের যানজট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকায় ফ্লাইওভারসহ মেগা প্রকল্পের নামে টাকা লোপাট করছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পরিকল্পিত সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুন সময় ও বাজেট বাড়িয়ে একদিনে জনগণের ট্যাক্সের টাকার বেহিসাবি লোপাট করা হচ্ছে, অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে নির্মীয়মান প্রকল্পের কারণে লাখ লাখ মানুষকে প্রতিদিন রাস্তায় ৪-৫ ঘন্টার যানজটসহ অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব করেও শহরের যানজট ও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা নিরসনের কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। টঙ্গি থেকে মতিঝিল-কমলাপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প চার বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১০ বছরের মাথায় আগারগাঁওয়ে আংশিক খুলে দেয়ার পর সেখানে যানজট নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
শহরের বাণিজ্যিক এলাকা এবং একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নাগরিকদের নির্বিঘ্ন স্বাচ্ছন্দ চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেকোনো আধুনিক শহরের কর্তৃপক্ষ ও ট্রাফিক বিভাগের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। টেম্স, রাইন নদী ও গ্রান্ড ক্যানেলকে ঘিরে লন্ডন, প্যারিস ও ভেনিসের মত শহরগুলো বিশ্বের কাছে আকর্ষনীয় স্থান হয়ে উঠলেও মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে চারপাশে চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত ঢাকা নগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে, সেই সঙ্গে হাজার বছর ধরে বয়ে চলা সুপেয় স্রোতস্বী নদীগুলোকেও বায়োলজিক্যালি মৃত, বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত নদীতে পরিনত করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণের জন্য প্রধানত হাজারিবাগের টেনারি থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্যকে দায়ি করে এখান থেকে টেনারিশিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে পরিকল্পিত, সিইটিপি সমৃদ্ধ আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণের পর কারখানা স্থানান্তর করতে ১৫ বছর ধরে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অবশেষে চামড়াশিল্প সাভারে স্থানান্তর হলেও বুড়িঙ্গার পর মাত্র ৫ বছরের মধ্যে সাভারের ধলেশ্বরী নদী এখন দূষণের চরমসীমায় পৌঁছে গেছে। একইভাবে চামড়াশিল্প এলাকার আশপাসের জনপদের মানুষ পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ দেশের সবগুলো বিভাগীয় শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোও প্রায় একই রকম দূষণ-দখলের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা শুধু জনগণের ট্যাক্সের টাকাই লোপাট করেনা, তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অপরিনামদর্শি কর্মকান্ডের দ্বারা নাগরিকদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মনোজাগতিক বিকাশের ধারাকে রুদ্ধ ও বিনষ্ট করা হয়েছে। ঢাকার আমলা, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা সামান্য অসুখ-বিসুখে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক কিংবা কলকাতা, মুম্বাই-চেন্নাইয়ের হাসপাতালগুলোতে পাড়ি জমায়। এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডের চিত্র হতাশাজনক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ টাকায় চপ, সিঙ্গারা, চা-সমুচা খাওয়ার সুযোগ নিয়েই বেশি গর্ববোধ করেন। রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গণ্ডি পার হলেই লন্ডন, টরেন্টো, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, ম্যাসাসুসেট্স, দিল্লী কিংবা কুয়ালালামপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে রাস্তায় চলাচল করেন। আকাশপথ তাদের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম-যশোর, কিংবা সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ঢাকা শহর পরিত্যাক্ত হলে পূর্ব-পািশ্চম, উত্তর-দক্ষিণে যে নতুন শহর গড়ে উঠবে সেখানে ভূমি অধিগ্রহণ, নামে-বেনামে প্লট বাগিয়ে নেয়া, কমিশন বাণিজ্য ও কনস্ট্রাকশন ঠিকাদারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফাবাজির পরিকল্পনাও তাদের। ভূমিদস্যুদের মুনাফাবাজি খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বাস্তবায়ন নিয়ে ছল-চাতুরি চলছে। ঢাকার রাস্তায় যানজট, পানিজট, জনজট, বাতাসের দূষণ, নদী দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, সারাদেশে পরিবহন মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য, শিক্ষায় বৈষম্য, শিক্ষাবাণিজ্য, অবক্ষয়, মানহীনতা, সামাজিক অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতার কারণে বেশিরভাগ মানুষের কাছে দেশটি অনিরাপদ হয়ে পড়ায় সাধারণ তরুণ-তরুণীরাও এখন দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রভাবশালীরা যখন অবৈধ পথে অপ্রদর্শিত হাজার হাজার কোটি কালো টাকার ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দেউলিয়া হয়ে পড়ে তখন দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের হাত ধরে যখন দেশের রাজধানী শহর থেকে পুরো দেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। তখন হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প দিয়ে রাজধানী শহরকে বাসযোগ্য বা যানজটমুক্ত করা সম্ভব নয়। সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন নিশ্চিত করা।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন