Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানব পাচার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ দায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৬ এএম

মানব পাচার আমাদের দেশে একটি সাধারণ ঘটনা, যদিও আইনে এটা গুরুতর অপরাধ। বছরের পর বছর ধরে এ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি বছর কত মানুষ পাচারের শিকার হয়, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। বিদেশে-বিভুয়ে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশীদের গ্রেফতার কিংবা জিম্মি হওয়াসহ মৃত্যুর খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এতে অনুমান করা যায়, পাচারের সংখ্যা মোটেই কম হবে না। ফি বছর এ সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। এটা নিঃসন্দেহে একটা উদ্বেগের বিষয় এবং লজ্জার বিষয়ও বটে। দেশে কর্মাভাব আছে সত্য, কিন্তু কারো না খেয়ে মরার অবস্থা নেই। জীবন বাজি রেখে, ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে হবে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। যারা পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হচ্ছে, তাদের একাংশ উন্নতজীবন ও কর্মের প্রত্যাশায় বেপরোয়া হয়েই হচ্ছে। অপরাংশ না বুঝে ঝাঁপ দিচ্ছে। এখানেও জীবনধারা বদলানের আশা প্ররোচক হিসাবে ভূমিকা রাখছে। আর পাচারকারী চক্রগুলো তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে এদের সংগ্রহ করছে। এ চক্রসংখ্যা কত হতে পারে, সেটা জানা না গেলেও পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, সারাদেশে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা ৩১ হাজার ১০১ জন। বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা পাচার হচ্ছে, তারা দেশের সক্ষম জনসংখ্যারই অংশ। তারা পাচারকারীদের কবলে পড়ে বিদেশের পথে পথে বা বিদেশে বিড়ম্বিত, লাঞ্ছিত, আটক ও জিম্মি হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কর্মসক্ষমতা বিনাশ করছে। প্রতারিত ও হতাশ হয়ে দেশে ফিরে আসছে। অনেকে মৃত্যুবরণও করছে। এটা দেশের কর্মশক্তির ক্ষয় ও অপচয়। মানব পাচার মানে শুধু মানুষই পাচার নয়, এই সঙ্গে টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে চাকরিতে যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে হয়। সঙ্গেও নগদ কিছু নিয়ে যেতে হয়। আর আটক কিংবা জিম্মিদশায় পড়লে দেশ থেকে লাখ লাখ টাকা গুনে তবে মুক্তি পেতে হয়।

দীর্ঘদিন ধরে এহেন অবস্থাই চলছে। এই ভয়াবহ অপরাধের যথাসময়ে তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না। একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক খবরে বলা হয়েছে, মানব পাচারের ৯৭ শতাংশ মামলা দেড় যুগে নিষ্পত্তি হয়নি। ওই খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ৯ বছর আগে ইরাকে যান মাসুদ রানা নামের টাঙ্গাইলের এক ব্যক্তি। সেখানে কাজ না পেয়ে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসেন তিনি। মরুভূমির একটি ক্যাম্পে অন্যান্যের সঙ্গে তাকে আটক রাখা হয়। দেশে এসে তিনি মামলা করেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এত বছরেও মামলার কোনো বিচার হয়নি। অনূরূপভাবে নওগাঁর মো. বাবু নামের এক ব্যক্তি ৯ বছর আগে মিশরে যান। কাজ না পেয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসেন। মামলা করেন জড়িতদের বিরুদ্ধে। সে মামলারও আজ অবধি বিচার হয়নি। পুলিশ সদর দফতরের হাল নাগাদ তথ্যে জানা যায়, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে গত ১৮ বছরে ৭ হাজার ৫১৭টি মামলা হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৭টির, মোট মামলার যা ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ মাত্র। মানব পাচার কেন রোখা যাচ্ছে না, এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিও তার জন্য কম দায়ী নয়। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহাদীন মালিক এ প্রসঙ্গে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষায় ‘সঠিকভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করে মামলার তদন্ত শেষ করার পর অভিযোগপত্র তৈরি করার দক্ষতা ও বা যোগ্যতা এখন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই বললেই চলে।’ এই যদি বাস্তব অবস্থা হয়, তবে দ্রুত বিচার কীভাবে সম্পন্ন হবে? আর বিচার যদি না হয় কিংবা বিলম্বিত হয়, তবে অপরাধীদের শাস্তি হবে কীভাবে? কীভাবেই বা অপরাধ কমবে? মানব পাচারের সঙ্গে বিদেশে জিম্মি করে টাকা আদায় এখন আর ব্যতিক্রম ঘটনা নয়। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যায়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশীরাই। তাদের এজেন্টরা দেশে ভিকটিমের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই টাকা জমিজিরাত বিক্রি করেই দেয়া হয়। মানবপাচারকারী চক্রগুলোর আরেক ঠিকানা যেহেতু দেশের বাইরে, তাই আইনের হাত আরো লম্বা করার বিকল্প নেই।

মানব পাচারের মত অপরাধ দমন বা নিরোধ করতে হলে প্রথমত, দেশব্যাপী মোটিভেশন কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনকে আরো কঠোর করতে হবে। তৃতীয়ত, এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তন কিংবা চাকরির জন্য বিদেশে যেতে হলে চোরাপথ বা অবৈধ পথ পরিহার করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেতে হবে। টাকা-পয়সা দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছতার আশ্রয় নিতে হবে। এই মর্মে দেশব্যাপী প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে কর্মের জন্য বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা সতর্ক-সাবধান হতে পারে। কে, কোথায়, কী কর্মে, কার মাধ্যমে যাচ্ছে তার যাবতীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা করার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে বিদেশে গমনকারী প্রত্যেকেই তার তথ্য জমা দিতে পারে। যে যে-দেশেই যাক, সেখানকার দূতাবাসে এই তথ্যের কপি পাঠানো যেতে পারে, যাতে দূতাবাস তার নিয়মিত খোঁজ খবর নিতে পারে। যেসব চক্র বিদেশে বসে মানব পাচার করছে, জিম্মি করছে, মুক্তিপণ আদায় করছে, তাদের খোঁজ-খবর বের করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অবহিত করার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। দেশগুলোর আইনে তাদের বিচার অথবা দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের ব্যবস্থা নেয়া হলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে। মানব পাচারকারীদের লক্ষ্য যেহেতু প্রতারণা করে টাকা আদায় করা, কাজেই তাদের পাকড়াও করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এই দৌরাত্ম্য স্বাভাবিকভাবেই কমবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন