Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নগরে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে হবে

ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার

| প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৬ এএম


জনশুমারী ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬,৫১,৫৮,৬১৬। দ্রুত নগরায়ন, গ্রামে কাজের অপ্রতুলতা, কৃষি জমির স্বল্পতা, উন্নত জীবনের প্রত্যাশা ইত্যাদি নানা কারণে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। শহরের জনসংখ্যা এখন ৫২,০০৯,০৭২। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অন্যান্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবাও নিশ্চিত করতে হবে। শহরে তৃতীয় পর্যয়ের হাসপাতাল, প্রাইভেট কিøনিক এবং ডাক্তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারের অধিক্য রয়েছে। তবে প্রথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। শহরে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, তারা টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন। কিন্তু দরিদ্র জনসাধারণ, যারা মূলত বস্তিতে বসবাস করে তাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, যা সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে সকল নগরবাসীর পাবার কথা তা প্রাপ্তিতে বেগ পেতে হচ্ছে সকলকেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট দ্বারা পরিচালিত প্রযুক্তিগত গবেষণার ফলাফল, যা ‘পাথওয়েজ টু রিডিউস হাউজ হোল্ড ওওপি এক্সপেন্ডিচার’ নামে একটি ইভেন্টে ২১ নভেম্বর ২০২১ তারিখে শেয়ার করা হয়েছে, তাতে দেখানো হয়েছে ২০২০ সালে স্বাস্থ্যখাতে যত টাকা ব্যয় হয়েছে, তার ৬৮.৫% ব্যয় করেছে রোগী নিজে। ২০১৫ সালে এই ব্যয় ছিল ৬৭%। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৬,৮৬৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শতকরা মাত্র ৫.৪৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮,০০,৪৮৬ জন মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। আর ২২,১৮৫ জন রয়েছে ভাসমান। এই বিশাল জনগোষ্ঠী, যাদের প্রাইভেট কিøনিক বা ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারে যাবার মতো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকে না, তারা মূলত নির্ভর করে সরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা ব্যাবস্থাপনার উপর। নগরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ১৯৬০ সালের মিউনিসিপ্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৭ সালের পৌরসভা অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ সালের সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশ এবং স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ স্পষ্টভাবে সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভার দায়িত্ব হিসেবে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য এবং সীমিত নিরাময়মূলক যত্নের বিধান দিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ১৯৯৮ সাল থেকে ইউপিএইচসিপি-১, ইউপিএইচসিপি-২ এবং ইউপিএইচসিএসডিপি’র অধীনে শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে, যা ইউপিএইচসিএসডিপি-২ এর অধীনে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রদান করা হবে। কিন্তু তাদের সীমিত সম্পদ ও জনবলের কারণে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ করতে পারেনি বর্তমানে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা মিলে মোট ৪৫টি এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৫টি, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে তিনটি করে, রাজশাহী, খুলনা ও নারায়নগঞ্জে দুইটি করে এবং বাকি ১১টি শহরে একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে।

উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র আছে। তাদের মধ্যে ইউএসএইডের আর্থিক সহায়তায় ‘সূর্যের হাসি’ ১৯৯৭ সাল থেকে সারা দেশে স্বল্প খরচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে তাদের ১৩৪টি ক্লনিক আছে। ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় পিএইচডি, নারী মৈত্রী এবং সিএমইডি মিলে ঢাকা বিভাগের চারটি সিটি কর্পোরেশনে ছয়টি ‘আলো’ ক্লিনিক চালু করেছে। ডিজিটাল মডেলের এই হাসপাতালগুলোতে আলাদা করে প্রতিটি রোগীর তথ্য সংরক্ষিত থাকে। মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য, প্রতিবন্ধি ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের সেবা দেওয়া হয় এখানে। সেবার মধ্যে আছে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য শিক্ষা, পরামর্শ ও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। ডিজিটাল এ উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রসংশনীয়। বর্তমান প্রকল্পের সাফল্যে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এর আরো ব্যাপ্তি ঘটবে।

তারপরও প্রয়োজনের তুলনায় নগরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অপ্রতুলতা রয়েই গেছে। ফলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে নগরের মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা। গর্ভবতী মা বা প্রসূতি মাকে সাধারণ সেবা বা পরামর্শের জন্য ছুটতে হচ্ছে জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বিশেষায়িত হাসপাতালে। সে ক্ষেত্রে বিশেষায়িত রোগে আক্রন্ত রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীদের অতিরিক্ত চাপে হাসপাতালগুলোতে সেবার মান ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, সেবাপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রিতা, যাতায়ত সমস্যা ইত্যাদি কারণে অনেক সময় মায়েরা হাসপাতালে যেতে অনিহা দেখায়। সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ ও সেবার অভাবে অকালে ঝরে যায় অনেক প্রাণ।

বর্তমানে প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। এগুলো ৩১ থেকে ১০০ শয্যার হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ, অন্তর্বিভাগ ও পৃথক মা ও নবজাতক বিভাগ আছে। এসব হাসপাতালে টিকা দেওয়া হয়, শ্বাসতন্ত্রের তীব্র প্রদাহের চিকিৎসা আছে, পরিবার পরিকল্পনা সেবাও দেওয়া হয়। পুষ্টিসেবার জন্য আছে বিশেষ কর্নার। আছে এক্সরে সুবিধাসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ। অনেক বিশেষজ্ঞ এই ব্যাপারে মত দিয়েছেন যে, উপজেলা সদরে অবস্থিত উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলো যেহেতু শহর এলাকায় অবস্থিত তাই এগুলোকে নগর স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বহির্বিভাগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রেদান করা যেতে পারে। ঢাকা শহরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ১৭৩ শয্যার অজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এবং মোহম্মদপুর ফার্টিলিটি এন্ড ট্রেনিং সেন্টার মাতৃ ও শিশু সেবায় কাজ করছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত এবং সরকার প্রশাসিত বিএভিএস মেটারনিটি হাসপাতালটি মিরপুর এলাকায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছে। এ হাসপাতালগুলোর উপচে পড়া ভিড় বলে দেয়, এদের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা। নগরের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য নিশ্চিতে বিভিন্ন শহরে এ ধরনের হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।

আমরা যদি বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যের বর্তমান চিত্রটি দেখি তাহলে দেখতে পাবো, বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যু, রক্তক্ষরণ (৩১%) এবং একলাম্পসিয়া (২৪%) এর কারণে হয়। আর বাধাগ্রস্ত বা বিলম্বিত প্রসবে হয় ৩%। ৭৩% মাতৃমৃত্যু ঘটে প্রসব পরবর্তী সময়ে এবং ৫৬% মা প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। প্রসূতি ফিস্টুলায় ৭১,০০০ জন মহিলাকে প্রভাবিত করে। প্রজনন বয়সের ১৩% মহিলা গুরুতরভাবে দীর্ঘায়িত বা বাধাগ্রস্ত প্রসবের মতো সমস্যায় আক্রান্ত। প্রজনন বয়সের বিবাহিত মহিলাদের ৪২% (১৫-৪৯ বছর) রক্তশূন্যতায় ভোগে। দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ সমস্যার সমাধান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পরামর্শ ও সেবার মাধ্যমে দেয়া সম্ভব। কিন্তু শহরে মানুষের তুলনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের অপ্রতুলতার জন্য সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে সেবা ও পরামর্শ থেকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন শিশু জন্মগ্রহণ করে। পূর্বে বাড়িতে প্রসবের সংখ্যা বেশি থাকলেও বর্তমানে মোট প্রসবের প্রায় ৫০% প্রাতিষ্ঠানিক। তাদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ সেবা নেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে সিজারিয়ান সেকশনের হার ৮৩%। অপ্রয়জনীয় সিজার মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়। ২০১৩ সালে ঢাকা শহরের বস্তির মহিলাদের উপরে করা এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ৬৪% মহিলা প্রসব পূর্ব সেবা গ্রহণ করেছে।

অপর দিকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চালের বর্তমানে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বেশ প্রসংসনীয়। এটি পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কয়েকটি ধাপে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। প্রথম ধাপে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, এরপর ইউনিয়ন সাবসেন্টার, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং সবশেষে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য, পুষ্টি, দৈনন্দিন স্বাস্থ্য পরিচর্যা ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে নিয়োমিত পরামর্শ প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে পরামর্শ পাওয়া যায় বিনামূল্যে। শুধু মাঝে মাঝে ঔষধ বাবদ কিছু টাকা ব্যয় হয়। তবে প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতার ক্ষেত্রে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরামর্শ মায়েদের হাতের নাগালেই থাকে। সাধারণ স্বাস্থ্যসেবাও সহজেই পাওয়া যায়। তবে শহরের মতো বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো নাগালের মধ্যে না থাকাতে জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে কিছুটা বেগ পেতে হয়।

শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতের দায়িত্ব দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হাতে না থাকায় পিছিয়ে পড়েছে নগরের প্রথমিক স্বাস্থ্যসেবা এমনটা মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল। তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালকেও দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে করতে হবে আইনের সংশোধন। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, শুধু টারসিয়ারী পর্যায়ের হাসপাতাল বৃদ্ধি করলে হবে না। শহরে প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ও মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে গর্ভবতী ও প্রসূতি স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হতে পারে। সেই সাথে বাড়াতে হবে ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ তথা স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সংখ্যা। উভয় মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাক, সাথে সাথে নিরাপদ থাকুক মাতৃস্বাস্থ্য। সময় মতো সঠিক পরামর্শ ও স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো শহরের বিত্তহীন, অসহায় মায়েদের পাশে দাঁড়াবে, আর একজন মাকেও গর্ভকালীন সময়ে বা গর্ভ পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাহীন হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে না, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সিইও, এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভলাপমেন্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন