পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, আমার মরহুম আব্বাজান হাজী ইলাহী বখশ (রহ.) আমাকে চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসায় এনে ভর্তি করিয়েছিলেন। যে মাদরাসার মাটির সাথে মিশে আছে অগণিত ওলী-বুযুর্গের রূহানিয়তের স্রোতধারা এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.) এর খলিফা গাজীয়ে বালাকোট মওলানা আব্দুল হাকীম (রহ.) এর সূত্রে জিহাদী চেতনার তরঙ্গমালা। এর ফলে এই মাদরাসার প্রতিটি ছাত্রের চিন্তা ও চেতনায় রূহানী ও জিহাদী উভয় স্রোতধারা প্রবহমান থাকে।
বলা হয়, ইউসুফ (্আ.) যত বুড়ো হয়েছিলেন, তার সৌন্দর্য তত বৃদ্ধি পেয়েছিল। যুলায়খারও যৌবনকাল বিকশিত হয়েছিল বার্ধ্যক্যে। আমাদের যিনি ইউসুফ, যার তিনটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে এতবড় আয়োজন, তিনি আল্লামা ফযলুল্লাহ (রহ.), তার যৌবনকাল দেখিনি। বার্ধক্যে তার যৌবনের সৌন্দর্য দেখেছি নাজেমে আলা হিসেবে চুনতি মাদরাসার পরিচালনা ও নেতৃত্বদানে। ১৯ দিনব্যাপী পবিত্র সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলকে বিষয় নির্বাচন ও বিন্যাসের মাধ্যমে যেভাবে চিরদিনের জন্য উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে পরিণত করে গেছেন, তার মাঝে তার দেদীপ্যমান যৌবন দেখেছি।
আমার বড় সৌভাগ্য যে, তিনি আমাকে নিজের সন্তান (ফোয়া) বলে ডাকতেন। একবার হুজুরের কাছে দোয়ার আর্জি জানালে বললেন, ‘ফোয়ারে ওয়া মুখে দোযা গরা ন লাগে, দোয়া অন্তরত্তুন বাইর অয়।’ (সন্তানের জন্য মুখে দোয়া করা লাগে না। দোয়া অন্তর থেকে বের হয়।) আলহামদু লিল্লাহ। হুযুর তার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি ‘যুক্তির কষ্টিপাথরে ইসলাম’ আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এ বই তোমাকে দিলাম। কোনোদিন তোমার সামর্থ্য হলে ছাপাবে। হুযুরের সন্তানরা উপযুক্ত হওয়ার পর পান্ডুলিপিখানি আমি ড. হোসাম উদ্দীন ভাইয়ের হাতে গছিয়ে দিয়েছি।
ফাযিলের পরীক্ষা দেয়ার পর আরবী ব্যাকরণ নাহু ও সরফ পড়েছিলাম হুজুরের কাছে। তখন সবাই মনে করত, একজন উস্তাদের একটি মাত্র ছাত্রই আছে। ’৭৪ সাল ছিল দেশে দুর্ভিক্ষের বছর। কামিল পড়ার জন্য চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হতে হবে। শহরে একটি লজিংয়ের খোঁজ পাওয়ার পর বিদায় নিতে এলে বলেছিলেন, তুমি চলে যাবা। তোমাকে তো ফারসি শিখিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। হুযুরের সেই ইচ্ছার বরকতে ইরান গিয়ে ফারসি শেখার সৌভাগ্য হয়েছে এবং মওলানা রূমী (রহ.) এর মসনবী শরীফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতে পারছি। আলহামদু লিল্লাহ।
১৮১০ সালে প্রতিষ্ঠিত আলিয়া নেসাবের ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার আজকের সমাবেশে কওমী অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় দুজন ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফের প্রতিষ্ঠাতা আমার উস্তাদ মওলানা সুলতান যওক এবং কওমী মাদরাসা বোর্ডের মহাপরিচালক মওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী এবং আলিয়া ও কওমী উভয় ঘরানার ড. আবু রেজা নদভী এমপিসহ অনেকে উপস্থিত আছেন। এতবড় সমাবেশে আমি মাদরাসা শিক্ষার গভীর সংকট সম্পর্কে দুটি কথা আরজ করতে চাই।
ভারত বর্ষে মুসলমানদের ৭শ’ বছরের শাসনামলে উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মাদরাসা শিক্ষা। উইলিয়াম হান্টারের বর্ণনা অনুযায়ী, ইংরেজ আসার আগে সমগ্র বাংলায় ৮০ হাজার মাদরাসা ছিল। তখন কোনো মুসলমান অশিক্ষিত থাকা অকল্পনীয় ছিল। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে বাংলার রাজত্ব দখল করার পর মসজিদ মাদরাসার জন্য বরাদ্দ লাখারাজ ও ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে নিলে মুসলমানরা পথের ভিখারিতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা হারানোর কঠিন দিনগুলোতে কলিকাতার গণ্যমান্য লোকেরা ইংরেজ গভর্নরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মোল্লা মজদুদ্দিনকে কেন্দ্র করে ১৭৮০ সালে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজদের শর্ত ছিল, প্রিন্সিপ্যাল হতে হবে ইংরেজ। শিক্ষা ও সিলেবাসের দায়িত্বে যিনি থাকবেন তার নাম হবে হেড মওলানা।
কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৬৬ সালে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পর দিল্লির ক্ষমতাহারা মুলসলমানদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে তার মোকাবিলায় সশস্ত্র আন্দোলনের পরিবর্তে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে দেওবন্দ মাদরাসা। তবে উভয় মাদরাসার সিলেবাস ছিল দরসে নিজামী। দুই ধারার মাদরাসাতেই এখনো মৌলিক কিতাবগুলো এক। সেহাহ সিত্তা, কাশশাফ, বয়যাবী, মিশকাত, হেদায়া, শরহে বেকায় প্রভৃতি কিতাব উভয় ধারার মাদরাসার পাঠ্য। কাজেই উভয় ধারার মাদরাসার মধ্যে কোনো বৈপরিত্য নেই।
আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দর্শন ছিল, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে দ্বীনি শিক্ষার বিস্তার সাধন। আর দেওবন্দের ফলসফায়ে ওজুদী বা অস্তিত্বের দর্শন ছিল, সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে দ্বীনি শিক্ষা ও চেতনার পরিচর্যা। এখন যদি কেউ অস্তিত্বের দর্শনকে অস্বীকার করে বা এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়, যা অস্তিত্বের দর্শনের পরিপন্থী তাহলে তার পরিণতি হবে আস্তিত্বের বিলুপ্তি।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর হিন্দুরা যখন ইংরেজদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, তখন স্যার সৈয়দ আহমদের মতো আলেমদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা গড়ে উঠে। তারা আন্দোলনে নামেন যে, মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ইংরেজদের আনুকূল্য গ্রহণ না করলে হিন্দু পণ্ডিতদের মোকাবিলায় মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। সেই চেতনা থেকে তিনি ১৮৭৫ সালে আলীগড় স্কুল ও পরে কলেজ এবং আরো পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এরপর আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাকে ইংরেজি বা আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে পুনর্গঠন ও আধুনিকীকরণের চিন্তা চেতনার উদ্ভব হয়। এই চেতনা জোরদার হলে ১৯১৫ সালে আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাকে নিউ স্কিম ও ওল্ড স্কিম এই দুই ধারায় বিভক্ত করা হয়। এই বিভক্তিতে শর্ষীনা আলিয়া, সিলেট আলিয়া ও কলকাতা আলিয়ার একটি অংশ নিউ স্কিম পদ্ধতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। বাকি সব মাদরাসা নিউ স্কিম পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং আত্মাহুতি দেয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের মহসিন কলেজ অতীতে ছিল মুহসেনিয়া মাদরাসা। আমাদের হুজুর মওলানা ফযলুল্লাহ (রহ.) নিজেও সেই মুহসেনিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। অথচ, সেই মাদরাসা এখন বিলুপ্ত এবং কলেজে রূপান্তরিত।
পাকিস্তান আমলে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ১৯৫৭ সালে এক সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ১০৯৪টি নিউ স্কিম মাদরাসা রাতারাতি স্কুল-কলেজে পরিণত হলে প্রতিবাদ করার লোকও পাওয়া যায়নি।
যে বিষয়টির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তাহলো, আলিয়া নেসাবের সকল মাদরাসায়, আগে তিনটি বাদ থাকলেও এখন সবগুলোতে নিউ স্কিম, এমনকি তার চেয়েও মারাত্মক সিলেবাস চালু হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অতীতের এমন অভিজ্ঞতা থাকার পরও কওমী মাদরাসাগুলো তাদের অস্তিত্বের দর্শন ভুলে গিয়ে সেই বড়শি গিলার জন্য লোভাতুর হয়ে পড়েছে। আমি যদিও কিছুদিন যওক সাহেব হুজুরের কাছে আধুনিক আরবি সাহিত্য পড়েছিলাম এবং তিনি আজকের মজলিসে উপস্থিত আছেন, আসলে আমি আলিয়ার ছাত্র। কাজেই কওমী অঙ্গনের লোকেরা আমার সতর্কবাণী হয়ত সহজে গ্রহণ করবেন না। অনুরোধ করব, আপনারা আমার কথা বাদ দেন, সদর সাহেব হুজুর মওলানা শমসুল হক ফরিদপুরি সাহেব হুজুরের একটি বই পড়ে দেখুন। অবশ্য বইটি তার নিজের লেখা নয়। অনুবাদ। ফিলিস্তিনের গ্রান্ড মুফতি আমীনুল হুসাইনী করাচি দারুল উলুম মাদরাসায় একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই বক্তৃতা মওলানা শমসুল হক ফরিদপুরি (রহ.) ‘শত্রু থেকে হুঁশিয়ার’ নামে তরজমা করেন। ইংরেজরা মিশর দখল করার পর কীভাবে সে দেশ থেকে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছিল, তার বিবরণ ছিল সেই বক্তৃতা। ইংরেজরা প্রথমে নানা প্রলোভন দিয়ে নানা যুক্তিতে প্রথমে অংক, ইতিহাস, ভূগোল, ইংরেজি প্রভৃতি সাবজেক্ট চালু করে, তারপর নানা কৌশলে ইসলামী সাবজেক্ট কমাতে কমাতে ২৫ বছর সময়ের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে, তারই বিবরণ আছে সেই বক্তৃতা ও বইতে। যাইহোক আমার মনের ব্যথাগুলো আপনাদের সামনে অতি সংক্ষেপে ব্যক্ত করলাম। ওয়াসসালাম।
(১৯ নভেম্বর ২০২২ চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্র সমিতি তোলাবায়ে সাবেকীনের সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতা।)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।