Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বেচ্ছাচারের নাম স্বাধীনতা নয়

মো. হাসিম আলী | প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৪ এএম

ইংরেজি ‘ফ্রিডম’ শব্দের অর্থ স্বাধীনতা। আর ‘চয়েস’ অর্থ পছন্দ। সুতরাং ফ্রিডম অব চয়েস অর্থ পছন্দের স্বাধীনতা। কর্মের স্বাধীনতা অর্থেও শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়। ফ্রিডম অব চয়েস বুঝতে হলে তার আগে স্বাধীনতার অর্থ জানা প্রয়োজন। স্বাধীনতা হলো, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো কাজ করা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বলতে এ ধরনের অবাধ স্বাধীনতাকে বোঝায় না। কারণ, সীমাহীন স্বাধীনতা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে ইচ্ছামত সবকিছু করার স্বাধীনতা দিলে সমাজে অন্যদের ক্ষতি হতে পারে, যা অশান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, স্বাধীনতা বলতে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কাজ করাকে বুঝানো হয়। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান ফ্রিডম অব চয়েস বলতে কর্মের স্বাধীনতা বুঝিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তি যা করতে চায় সেটা স্বাধীনভাবে করার সামর্থ্য থাকা হলো ফ্রিডম অব চয়েস।

এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, কোনো কিছু করা বা না করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি কি আসলেই স্বাধীন? এ ক্ষেত্রে জ্যাঁ জ্যাক রুশোর উক্তিই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: ‘মানুষ এ পৃথিবীতে মুক্তভাবে জন্মগ্রহণ করলেও প্রতিটি পদেই সে শৃঙ্খলিত। হাজারো নিয়মে বাঁধা তার জীবন।’ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় কিছু নিয়মনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি তাকে অনুগত থাকতেই হয়। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হয় পরিবারের নিয়ম-কানুনের প্রতি, মেনে চলতে হয় সামাজিক রীতি-নীতি, আনুগত্য করতে হয় রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি-বিধানের প্রতি।

প্রকৃত অর্থে ব্যক্তি শর্তসাপেক্ষ কিছু ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে মাত্র। যেমন, ইচ্ছে করলেই কোনো ব্যক্তি তার পছন্দ মতো কিছু খেতে পারে না। খাওয়ার আগে তাকে চিন্তা করতে হয়ে সেটি বৈধ নাকি অবৈধ। ব্যক্তি যা ইচ্ছে তা-ই বলতে পারে না। বলার আগে উচিত কিংবা অনুুচিত সম্পর্কে তাকে ভাবতে হয়। সে ইচ্চামাফিক সব জায়গাতে যেতেও পারে না। তার আগে তার প্রবেশাধিকার সম্পর্কে ভাবতে হয়, অনুমতি নিতে হয়। সে ইচ্ছা মতো কোনো পোশাক পরতেও পারে না। পোশাকটি তার আদর্শ, আবহাওয়া এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। ঠিক এমনিভাবে সে ইচ্ছা করলেই নিজেকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে না। নিজের জীবনকে শেষ করে ফেলতে পারে না। ইচ্ছে করলেই নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারে না। নিজের সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে না। সমাজের প্রচলিত নিয়ম-রীতি ভঙ্গ করে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বল্গাহীন জীবন যাপন করতে পারে না। অবৈধ পেশায় জড়িত হতে কিংবা অবৈধ পণ্যের কারবার করতে পারে না। ইচ্ছামাফিক কারো জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে না। কোনো প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ ও মূল্যবোধকে অবজ্ঞা বা কটাক্ষ করতে পারে না। কারো বোধ-বিশ্বাসের দেয়ালে আঘাত করতে পারে না। অন্যায়, অবাধ্যতা কিংবা অশ্লীল কাজে উস্কানি দিতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন-কানুনকে অবহেলা কিংবা অস্বীকার করতে পারে না। পারে না আন্তর্জাতিক আইন-কানুনকে অমান্য করতে । কারণ, এসবের অধিকার তাকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই দেয়নি। তাহলে কীভাবে একজন ব্যক্তি বলতে পারে যে, দেহ আমার সিদ্ধান্তও আমার, আমি যেমন খুশি তেমন চলবো! যেমন খুশি তেমন সাজবো! যেমন খুশি তেমন পরবো! যখন যা খুশি তা-ই করবো! আমাকে কিছু বলার অধিকার কারো নেই! নেই বাধা দেয়ার অধিকার! এ জাতীয় গর্হিত বক্তব্য ও আচরণ নিঃসন্দেহে মূল্যবোধকে ধ্বংস করে, নৈতিক মানদণ্ডকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে, অপরাধপ্রবণতাকে উৎসাহিত করে এবং নিজের ক্ষতিকেই বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে তথা সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে। কারণ, প্রথমত: ব্যক্তি একটি পরিবারের সদস্য। তাকে পরিবারের মান-সম্মান, ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের প্রতি আনুগত্য করতে হয়। পরিবারের সম্মানহানি হয় এমন কাজ সে করতে পারে না। দ্বিতীয়ত: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে তাকে বসবাস করতে হয়, সমাজের রীতি-নীতি, সংস্কৃতি তাকে মান্য করতে হয়। সমাজবিরোধী কাজের অর্থই হলো গণদুশমনে পরিণত হওয়া, গণধিক্কৃত হওয়া, লাঞ্ছিত হওয়া। তৃতীয়ত: ব্যক্তি রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা তথা অধিকার-স্বাধীনতা ভোগ করে। ফলে সে রাষ্ট্রের প্রচলিত রীতি-নীতি, বিধি-বিধান, আইন-কানুন মেনে চলতেও বাধ্য। কেউ কি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পেরেছে কখনো, না কি ভবিষ্যতে কখনো পারবে?

এছাড়া, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের রয়েছে অপরিসীম প্রভাব। ধর্মই মানুষকে প্রকৃত সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথ নির্দেশ করে। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতাতেই সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে ছিল ধর্ম। বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। পৃথিবীর মানুষের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধর্ম-আদর্শকে বিশ্বাস করে। ধর্মকে কোনো আস্তিক ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না। কারণ সে তো ধর্মকে ধারণ করেই বেঁচে থাকে এবং তার জীবনের সকল চিন্তা এবং কর্ম আবর্তিত হয় ধর্মকে কেন্দ্র করেই। আবার, প্রত্যেক ধর্মেরই রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান। একজন আস্তিক ব্যক্তি তার নিজের ধর্মীয় বিধান মেনে চলে এবং তা মানতে সে বাধ্য।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের ইদানিং কিছু অপরিণামদর্শী, অকালপক্ক, রুচিহীন, অসভ্য, বর্বর ব্যক্তিকে তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান, মূল্যবোধ-বিশ্বাস, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ বস্ত্রের ওজন কমাতে চাচ্ছে, কেউ নিজের শরীরকে পণ্য হিসেবে বিক্রির অধিকার চাচ্ছে, কেউ জন্তু-জানোয়ারের মতো উলঙ্গপনায় মেতে উঠতে চাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ আবার অর্থ সাশ্রয় এবং জাতীয় অর্থনীতির উপর চাপ কমাতে ছোট ছোট পোশাকের পক্ষে সাফাই গাচ্ছে। এসবই করা হচ্ছে অধিকারের নামে, স্বাধীনতার নামে। অথচ, তারা ভুলে যাচ্ছে যে, স্বাধীনতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা এক বিষয় নয়। তারা আসলে বিষ বাষ্পে গোটা সমাজকে কলুষিত করতে চাচ্ছে। পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা এসব বেহায়াপনা, অশ্লীলতার ফেরিওয়ালা কথিত নারীবাদীদের এখনই থামাতে হবে। এজন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে যথাযথ দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর... ’ (সূরা তাহরীম: ৬)। ‘আপনি তাদেরকে আপনার প্রতিপালকে পথে ডাকুন প্রজ্ঞা, সদুপদেশের মাধ্যমে। আর (প্রয়োজনে) তাদের সাথে তর্ক (যুক্তি বিনিময়) করুন উত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহল: ১২৫) ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হওয়া উঠিত, যারা মানুষকে কল্যাণকর কাজের দিকে আহবান জানাবে, মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আর তারাই হবে সফলকাম।’ (সূরা আলো ইমরান: ১০৪)। ‘তারা এমন যাদেরকে আমি জমিনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করবে।’ (সূরা হজ্জ: ৪১)

মহানবি সা. বলেন: ‘সাবধান, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (বুখারী ও মুসলিম)। মহানবি সা. আরো বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোনো প্রকার খারাপ কাজ হতে দেখে সে যেনো তার হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগে) তা প্রতিরোধ করে। যদি এ শক্তি তার না থাকে তাহলে মুখের কথা দিয়ে (জনমত তৈরি করে) তা প্রতিহত করে। এতেও যদি সে সক্ষম না হয় তাহলে মন দিয়ে (পরিকল্পিত উপায়ে) তা প্রতিহত করার প্রচেষ্টা করে। আর অন্তর দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করা ঈমানের দুর্বলতম এবং সর্বনিম্ন স্তর (এর নীচে ঈমানের আর কোনো স্তর নেই)।’ (মুসলিম)

এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোরআনেই দিয়েছে সর্বোত্তম ব্যবস্থাপত্র। যেমন আল্লাহ বলেন: ১. ‘হে আদম সন্তান! তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে পরিচ্ছদ দিয়েছি এবং সাবধানতার পোশাক, এটিই সর্বোৎকৃষ্ট। এটি আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা আ’রাফ: ২৬)। ২. ‘ঈমানদার পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গ সংযত করে, এটিই তাদের জন্য উত্তম। ওরা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে... তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা নূর: ৩০-৩১) ৩. ‘তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে, প্রাচীন জাহেলী যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িও না।’ (সূরা আহযাব: ৩৩)। ৪. ‘হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার কন্যাদেরকে, আর বিশ্বাসীদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের মুখমন্ডলের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আহযাব: ৫৯)

এই ব্যবস্থাপত্রে যদি কাজ না হয় তাহলে তাদেরকে তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতার উপরই ছেড়ে দেয়া হোক, যা তাদেরকে সীমাহীন এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিতে নিপতিত করবে। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: ‘আর আমি তাকে (ভালো এবং মন্দ) দুইটি পথই দেখিয়েছে’ (সূরা বালাদ: ১০)। ‘আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে। আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শৃঙ্খল বেড়ি ও লেলিহান অগ্নি।’ (সূরা দাহর: ৩-৪)।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের নারীদেরকে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা অশ্লীল, বস্তাপচা নগ্ন অপসংস্কৃতির বিষবাষ্প থেকে আত্মরক্ষা করে প্রকৃত সত্য ও সৌন্দর্যের আধার ইসলামের আলোয় আলোকিত হওয়ার এবং স্বীয় স্রষ্টা, সমাজ এবং স্বজাতির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করার তাওফিক দান করুন।

লেখক: সহকারি শিক্ষক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল এন্ড কলেজ, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, বগুড়া



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন