Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইলিশসহ মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২০ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৪ এএম

প্রজনন মওসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এবারো অক্টোবর মাসের ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করার জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা মতে, এবার দেশের উপকূলীয় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাসহ অভ্যন্তরীণ নদনদীতে প্রায় ৮৪ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞাকালীন ২২ দিনে ৫২ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। আর পরবর্তী ৭ দিনে আরো ৩২ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। প্রজনন মওসুমে মা ইলিশের ডিম ছাড়ার এটা রেকর্ড। সঙ্গতকারণেই আশা করা হচ্ছে, জাটকা নিধন রহিত করা সম্ভব হলে এবার ইলিশ উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। গবেষকদের ধারণা, এবার ইলিশ উৎপাদন ৫ থেকে ৭ লাখ টন হতে পারে। মা ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করার ফলে ইলিশ উৎপাদন প্রতি বছরই বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সব নদনদীতে একই সময় মা ইলিশ ডিম ছাড়ে না। একেক নদীতে একেক সময় ডিম ছাড়ে। আরো গবেষণার মাধ্যমে কখন, কোন নদীতে ইলিশ ডিম ছাড়ে সেটা নিশ্চিত হওয়া গেলে ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব হবে। মৎস্য অধিদফতরের ভাষ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ইলিশ উৎপাদন হয় ৩.৮৮ লাখ টন। আর ২০২০-২১ অর্থ বছরে উৎপাদিত হয় ৫.৬৫ লাখ টন। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে খুব সহজেই অন্তত ১০ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইলিশ অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ। একে মাছের রাজাও বলা হয়। দেশে-বিদেশে এর চাহিদা ব্যাপক। দামও অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশি। আর্থিক কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না। উৎপাদন বেশি হলে দামও কিছুটা সস্তা হতে পারে এবং তখন সাধারণ মানুষেরও ইলিশ কেনার সৌভাগ্য হতে পারে। ইলিশ কিছু কিছু রফতানি হয়, বিশেষত ভারতে। উৎপাদন বেশি হলে ভারতসহ অন্যান্য দেশেও ইলিশ রফতানি বাড়তে পারে। আসতে পারে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কর্মরত আছে। তাদেরও প্রিয় মাছ ইলিশ। এই স্বাভাবিক বাজারটি কাজে লাগাতে পারলেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসতে পারে।

শুধু ইলিশ নয়, সামগ্রিকভাবে মাছ উৎপাদনে দেশ বড় রকমে সাফল্য লাভ করেছে। দেশি মিঠাপানির মাছ উৎপাদানে যেমন সাফল্য এসেছে, তেমনি সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনেও সাফল্য এসেছে। এমনকি বিভিন্ন বিদেশি মাছের জাতও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালে দেশে ১.২২ মিলিয়ন টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ১.২৫ মিলিয়ন টন। মাছ উৎপদানে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। আন্তর্জাতিকভাবে এই অবস্থান গর্বের হলেও এটা বলা বাহুল্য, মাছ উৎপাদনে আমরা এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। এখনো বিদেশ থেকে মাছ আমদানি হয়, যদিও ইলিশ ছাড়াও কিছু মাছ আমরা রফতানি করি। চিংড়ী ও সামুদ্রিক মাছ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। নদনদী, জলাভূমি, পুকুর, খাল-বিল, হাওর-বাওর আমাদের দেশে এখনো যা টিকে আছে, তাতে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ চাষ করা সম্ভব হলে এখনকার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি মাছ উৎপাদিত হতে পারে। সমুদ্র তো মাছের ভাণ্ডার। অথচ, সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের পরিমাণ মোটেই সন্তোষজনক নয়। দূষণ, নানামুখী অনাচার এবং বিদেশি মাছ-চোরদের দৌরাত্ম্যে সাগরে মাছের অবস্থান ও অবস্থিতি দিনকে দিন কমছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। ওদিকে গভীর সমুদ্রে মাছের যেসব ভাণ্ডার আছে, উপযুক্ত যান ও সরঞ্জামের অভাবে তা থেকে মাছ আহরণ সম্ভব হচ্ছে না। সামুদ্রিক মাছের ব্যাপক রফতানি সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যদি আমাদের সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্রগুলো নিরাপদ রেখে পুরোমাত্রায় মাছ ধরতে পারতাম, তাহলে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বাড়তো অনেক বেশি। এতে দেশের চাহিদা পূরণ হওয়ার পাশাপাশি রফতানি অনেক বাড়তো।

মিঠাপানি ও সাগরে মাছের যে সম্ভাবনা আছে, তাকে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। প্রসঙ্গত এখানে হালদার কথা উল্লেখ করা যায়। এটি কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। বছরের একটা বিশেষ সময়ে এখানে মা মাছেরা ডিম ছাড়তে আসে। জেলেরা এই ডিম সংগ্রহ করে। ডিম থেকে হওয়া পোনা দেশের মাছ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিতাপের বিষয়, দখল ও দূষণে হালদা এখন চরম দুঃসময় অতিক্রম করছে। মানববর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য ও বিষাক্ত কেমিক্যাল এর পানির প্রকৃতি, রং, স্বাদ এমনভাবে পাল্টে দিয়েছে যে, সেখানে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। মাছের ডিমের এই প্রাকৃতিক উৎসকে অবশ্যই দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে, নিরাপদ করতে হবে। একইভাবে সব নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে, যাতে প্রাকৃতিকভাবে সেসব মাছের ভাণ্ডারে পরিণত হয়। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ রাজধানীর আশেপাশের নদী, চট্টগ্রামের হালদা, কর্ণফুলি এবং অন্যান্য শহরের পার্শ্ববর্তী নদী ব্যাপকভাবে দখল ও দূষনের শিকার। দখল-দূষণ থেকে এদের উদ্ধার করতে হবে। এসব নদী একদা মাছের অফুরান ক্ষেত্র ছিল। এখন মাছের দেখা কমই মেলে। একইভাবে জলাভূমি, পুকুর, খাল-বিল, হাওর-বাওর সুরক্ষা করতে হবে, যাতে আগের মতো মাছের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। এভাবে মাছ উৎপাদনে ব্যাপকভিক্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা করা গেলে, আমিষের চাহিদা পূরণ হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি নির্ভরশীল ক্ষেত্রও তৈরি হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন