Inqilab Logo

সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বৃক্ষ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পশু-পাখি, বন-জঙ্গল প্রভৃতির সঙ্গে মানুষের স¤পর্ক নিতান্তই আত্মিক, চিরন্তন। এতে একটা নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। একদা মাঠে কর্মরত মানুষের পাশাপাশি পাখির দঙ্গল ছিল সাধারণ দৃশ্য। নির্দিষ্ট ধারায় চলতো উভয়ের কাজ। আজ সে সুখদ পরিস্থিতি অনেকটা বিঘ্নিত, বিপর্যস্ত।

মানুষ প্রকৃতি ও পশুপক্ষীর তাত্ত্বিক স¤পর্কের কথা ছাড়াও জীবনের প্রয়োজনে এদের সংরক্ষণের প্রশ্ন আসে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ষোড়শ শতক থেকে উনিশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ইউরোপের বনাঞ্চলের একটি বৃহৎ অংশ নির্মূল হয়ে যায় মানুষের উৎপাদন কর্মের বিস্তৃতি ঘটার কারণে। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতবর্ষের এ মর্মে একটা চিত্র আমাদের চোখে পড়ে। সম্রাট অশোক সর্ব প্রথম বনসংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বন্যপ্রাণী শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

মানুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ী ধারণা সময়ের প্রবাহে অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছে। তবুও বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চলের বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কথা ছেড়ে দিলেও একটা নান্দনিক আকর্ষণ থাকবেই। তাই প্রকৃতির দান এ বনাঞ্চল ও বন্য পশুপক্ষী রক্ষার একটা তাগিদ মানুষের মধ্যে অনুভূত হচ্ছে। অথচ, মানুষের অবহেলায় ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক বনাঞ্চল। কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি জাতীয় পত্রিকায় একটি নিবিড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য মানুষের লোভলালসায় কীভাবে বিস্তৃর্ণ জলাভূমিতে পরিণত হলো তার একটা অনবদ্য চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ হারিয়ে যাওয়া বনটি হলো ২৩ হাজার একর জুড়ে অজস্র বৃক্ষ লতা গুল্মাচ্ছাদিত চকরিয়া সুন্দরবন, বিশেষজ্ঞদের ভাষায় দ্য লস্ট ফরেস্ট। ১৫ বছর আগেও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের মতোই ছিল সমৃদ্ধ। এর ভৌগোলিক অবস্থান ছিল কক্সবাজার জেলার মাতামুহুরী ও মহেষখালী চ্যানেল যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখানে, যা আজ স¤পূর্ণ বিলুপ্ত এবং অদৃশ্য।

এ বনাঞ্চলের সমূলে বিনষ্টির কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা দেখি, মানুষের অতি লোভলালসা এর জন্য দায়ী। চকরিয়া সুন্দরবনকে নিশ্চিহ্ন করে চিংড়ি ঘের আর ঘেরকেন্দ্রিক লোকালয় গড়ে তোলার সূচনা হয় আশির দশকে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে শত শত একর জমি লিজ দেয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠে চিংড়ী ঘের। ফলে ব্যষ্টি-সমষ্টি নয়, দেশও নিঃসন্দেহে উপকৃত হয়েছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে। কিন্তু পরিবেশ প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়েছে তা সত্যিই অপরিসীম এবং অপূরণীয়। বৃক্ষহীন এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে অনেকখানি। বিলম্বে হলেও আজ বনাঞ্চল ও বনজপ্রাণী রক্ষার গুরুত্ব আমরা উপলদ্ধি করতে শুরু করেছি। অন্য একটি জাতীয় পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, খুলনার শহীদ হাদিস পার্কের শহীদ বেদীমূলে বিশ্বের ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও রক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে গৃহীত ১৮টি সুপারিশের ভিত্তিতে বাস্তবতার মাপকাঠিতে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আগামীতে কোনো এক সময় চূড়ান্ত রূপরেখা গৃহীত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। এরপর তার কী হয়েছে জানা যায়নি।

বন্যপশু ও পাখী সংরক্ষণের বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভের খাতিরে আমাদের ধারাবাহিক আলোচনার প্রয়োজন আছে। ১৯৬৬ এবং ৬৭ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ড ফর ন্যাচার ইন্টারন্যশনালে’র একটি টিমের অভিযানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে দেওয়া হোক। এ সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪’র আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা সার্বিকভাবে দেশের বনজঙ্গলসহ পশুপাখির বিলুপ্তি ধারা রোধ এবং অতিথি পাখির আগমনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। পাখি ও বন্যপশু সংরক্ষণের জন্য পৃথক পৃথক এলাকাও নির্ধারিত হয়েছিল।

১৯৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘কনভেনশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজারড সিন্ডসিজ অব ওয়াইন্ড ফোনা অ্যান্ড ফ্লোরা’ গণনা চুক্তির মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায়, ৩২ প্রজাতি স্তন্যপায়ী, ১৭ প্রজাতি সরীসৃপ ১১ প্রজাতি বন্যপাখি এবং ২ প্রজাতি ব্যাঙ বিলুপ্তির পথে এবং গুঁইসাপ দ্রুত বিলুপ্তির কারণে, ১৯৮৬ সালে এর নিধন এবং রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৯১ সালে ‘দি ইন্টরন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ উদঘাটন করে ১.৭৮ মিলিয়ন গুঁইসাপের চামরা জাপানে রপ্তানি করা হয়েছে। এটি ভাবতেই অবাক লাগে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলা এ জন্য দায়ী। ১৯৯৬ সালে নভেম্বর মাসে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ৫ দিনের মধ্যে ৫টি বাঘের মৃত্যু ঘটে।

বৃক্ষনিধন স¤পর্কে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে ভোলার দৃষ্টান্তকে আমরা প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। জানা যায়, ভোলার ৩০টি ইটভাটায় প্রায় ৫ কোটি টাকার কাঠ পোড়ানো হয়েছে। বনরক্ষীরা পাচারকালে ২৫টি নৌকা ও কয়েকটি ট্রাক আটক করে। আটককৃত কাঠের মূল্য ৪০ লক্ষ টাকা। একে কেন্দ্র করে বেশ ক’জন পাচারকারীকে হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯) এর ৭ ধারা অনুযায়ী এহেন অপরাদের জন্য ৬ মাসের কারাদন্ড এবং অনধিক টাকা ৫০,০০০/- অর্থ দন্ড কিংবা উভয় দন্ডের বিধান আছে। অথচ, পাচারকারীরা এতে কোনো ভ্রক্ষেপ না করে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনকে বাঁচানো আজ কেবল বাংলাদেশের দাবি নয়, এটি আন্তর্জাতিক স্লোগানে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, বিশ্ব ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলাদেশের সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ ধ্বংসের মুখে, বিলুপ্তির পথে। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অজস্র সংবাদ যথা: সুন্দরবনের গাছে রোগ, প্রাণীবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, বনজস¤পদ ধ্বংস, বন্যপ্রাণীর নির্বিচার নিধন ও চোরা শিকারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা হ্রাস ইত্যাদি খুবই গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরেক ভয়াবহ তথ্য সেটি হলো, পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, যার পরিণতিতে সুন্দরবনের এক বিরাট অংশ আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ বিষেজ্ঞরা এ অতুলনীয় বনভূমির অস্তিত্বে আশংকা চিন্তিত।

সুন্দরবনের ধ্বংসের মূল কারণের দিকে যদি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে দেখতে পাই, এক বিরাট স^ার্থান্ধ গোষ্ঠী মনে করে, এ বনাঞ্চল স¤পদের উৎস। এর পেছনে সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স^ার্থ আছে। ইতোপূর্বে খুলনায় অনুষ্ঠিত এক স¤েমলনে অতিথিদের ভাষণ থেকে জানা গেছে যে, প্রায় ২৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপার্জনের জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। তাই একদিকে যেমন প্রণীত আইনের ভয় দেখিয়ে এ স^ার্থান্ধ লোভাতুর গোষ্ঠীকে নিরস্ত করার প্রয়াস পেতে হবে, তেমনি তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরবন ধ্বংসের অর্থই হবে, ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাসে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি। এতে সমূহ ক্ষতি হবে মানুষেরই।
এটিই উপযুক্ত সময় সুন্দরবনকে স¤পূর্ণ সংরক্ষিক্ষত বনাঞ্চলে পরিণত করার এবং একে কেন্দ্র করে কাঠের ব্যবসা, গোল পাতার ব্যবসা, বন্যপ্রাণীর চামড়া ও মাংসের ব্যবসা বন্ধ করার সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার। ব্যবসায়ীদের স^ার্থে আমরা এর সামাজিক আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারি না। উল্লেখিত সেমিনারে বিশেষজ্ঞদের ভাষণে এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ বনের সকল স¤পদ রক্ষা করে ও বিকল্প পথে কোটি কোটি টাকা আয়ের ব্যবস্থা করা যায়।


সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য এখনো যতটুকু আছে তা সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। এ পর্যটন সম্ভাবনাকে বিকশিত করলে একদিকে বন্যপ্রাণী ও বনভূমি রক্ষা পাবে, তেমনি একে কেন্দ্র করে অব কাঠামো গড়ে উঠবে এবং বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বন সংরক্ষণের আইন প্রণয়ন ছাড়া সরকার আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সংশ্লিষ্ট আইন যেমন: ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯, বন আইন ১৯২৭, বাংলাদেশ বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ ১৯৭৪।

১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশকে সবুজে সবুজময় করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট নার্সারি, চারা, কলম, শ্রম, উদ্যোগ, অর্থায়ন, আনুষ্ঠিকতা সবই আছে। তবে কেন আমাদের সর্বক্ষেত্রে বিপর্যয়। তার কারণ, আমাদের নেই যথোচিত আন্তরিকতা, সচেতনতা, ত্যাগী মনোভাব। আইন আছে, কিন্তু সেই আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা আইন প্রয়োগে ব্যর্থ। প্রকৃতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে প্রবৃত্তিকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে এ যেন মাথা কেটে চরণ সেবা করা।

আজ ভাবতে দুঃখ হয়, বাক সর্বস^তা আমাদের মননশক্তি হরণ করে নিয়েছে। বনসৃজন, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ স¤পর্কে বক্তৃতা-বিবৃতির অভাব এদেশে কখনও হয়নি। সরকারি পরিকল্পনা সংক্রান্ত প্রচার প্রপাগান্ডা আর পরিবেশবাদীদের হায়- হুতাশের মধ্যেও মিলিয়ে যাচ্ছে বন-পাহাড়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম) স্বর্ণপদক প্রাপ্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন