পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে আছে সাধারণ মানুষ। প্রতিটি পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। মধ্যবিত্তরাও এখন দামের চাপে ব্যাগের তলানিতে পণ্য নিয়ে ফিরছে ঘরে। নিম্নবিত্তদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দাম বাড়ার কোনো কারণ না থাকলেও মোটা চাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসুর ডালসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছেই। এসব পণ্যের বাড়তি দামের চোটে ক্রেতারা যেমন চাহিদার তুলনায় পণ্য কম কিনছে, তেমনি বিক্রেতাদেরও কেনাবেচা কমেছে।
সবকিছুর দাম বাড়তি। দাম শুনে অনেকে পণ্য না নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। যেটা না নিলেই নয়, সেসব পণ্য এক কেজির জায়গায় আধা কেজি নিচ্ছে। আগে যারা পুরো প্যাকেট নিত, তারা খোলা কিনছে। দ্রব্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে স্বস্তি নেই কারোই। এ অবস্থায় ক্রেতারা নাজেহাল। পরিস্থিতি দিনদিন খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের বেঁচে থাকার অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চল ও বস্তিতে বসবাসকারী বিরাট জনগোষ্ঠী সুষম খাদ্যাভ্যাস থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে।
ভোজ্যতেলের দাম কমেছিল এক মাস আগে। এর মধ্যেই আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। এবার তারা লিটারে ১৫ টাকা বাড়াতে চায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়ার পর বাজারে তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে বেশির ভাগ দোকানে আগের নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল আর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৫৮ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও কিনতে হচ্ছে আরও বেশি দামে। সরকার ঘোষণা দেওয়ার আগেই ডিলাররা তেলের দাম বেশি নেওয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে বাজারে চিনির দাম এখনো কমেনি। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। আবার সরকারি চিনিকলের চিনিগুলো প্রতি কেজি ৮৫ টাকা দর নির্ধারিত থাকলেও তা বাজারে মিলছে না। সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও কারখানাগুলো আধুনিকায়ন না করে আমরা দেশের চিনিকলগুলোকে দিনদিন রুগ্ন করে ফেলেছি। ফলে চিনিতে স্বনির্ভর দেশ আজ আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে। অনিয়ম, অব্যস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে পাটশিল্পের ন্যায় আজ চিনি শিল্পও ধ্বংসপ্রায়।
এদিকে মোটা চাল প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। সে কারণে খুচরা বাজারে খোলা চালের দামও ২ থেকে ৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। খুচরা বাজারে বেড়েছে খোলা আটা-ময়দার দামও। প্রতি কেজি আটা বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়, যা আগে ৫ টাকা কম ছিল। একইভাবে ভালো মানের ময়দা ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডালের দামও কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৬০ টাকায় ঠেকেছে। আবার ভালোমানের বাছাই করা পেঁয়াজ কিনতে গেলে কোথাও কোথাও ৭০ টাকাও দিতে হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ডলার সঙ্কটে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। যাদের রপ্তানি আয় আছে এবং বড় ব্যবসায়ী ব্যাংক শুধু তাদের ঋণপত্র খুলছে। ফলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা পড়েছে মহাসংকটে। ডলারের উচ্চদাম ও সংকট চাপে ফেলেছে ব্যবসা বাণিজ্যেকে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবার কারণে অনেক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে তাঁদের ব্যবসা সংকুচিত করেছে। গত জুলাই- অক্টোবর সময়ে দেশে গম, চাল ও ডাল আমদানি কমেছে ৯ লাখ টন। এর ফলে বাজারে চাল-ডালের সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকার মান ধরে রাখা ও ডলারের দাম নির্ধারন করে দেবার নীতি অর্থনীতিতে কোন সুফল বয়ে আনেনি। খোলা বাজারে ডলারের বিক্রয়মূল্য বেশি হবার কারণে প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। এতে করে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয়প্রবাহ কমে গত অক্টোবর মাসে ১৫২ কোটি ডলারে নেমেছে, যা বিগত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি আয় নিম্নমুখী, রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি নিম্নমুখী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বাজেটে অনৈতিকভাবে সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসেনি। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। আর্থিক খাতের অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চরম সংকটে পড়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ মোটেই বাড়েনি। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন দারুণভাবে ব্যহত হয়েছে। লোডশেডিংয়ের ফলে একদিকে যেমন রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে অন্যদিকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধানে সহসা কোন সুখবর নেই। এদিকে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় অর্থনীতিকে সবল করতে কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দিতে হবে। সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা জরুরি। করোনা সংকট, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে দেশে দুর্ভোগ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বে নতুন করে দরিদ্র্যের কাতারে শামিল হবে সাত কোটির বেশি মানুষ। অনেক উন্নত দেশও নানা ধরনের সংকটে পড়বে। এজন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সে আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের সে পথেই হাঁটতে হবে।
আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে নিম্নমুখী ধারা দেখা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের পর অক্টোবরে ধারাবাহিকভাবে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে কমেছে আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মন্দা এবং ডলার সংকট কাটাতে নানান পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহী করার পাশাপাশি রপ্তানি কমে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর বছরে ৩০ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বন্দর। অথচ, মন্দার কারণে আমদানি-রপ্তানি কমে গেছে। করোনার পর গতবছর কল-কারখানা খোলার পর পণ্য আমদানি-রপ্তানি গতি পেয়েছিল বটে তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিয়েছে ও গত কয়েক মাস ধরে ডলারের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। ৮৩ টাকার ডলার ১১৮-২০ টাকা পর্যন্ত হয়ে গেছে। এতে আমদানিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যেহেতু ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমেছে, তাতে করে রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আমদানির চেয়ে রপ্তানি আয় কম হওয়ায় অর্থবছরের শুরু থেকে টানা তিন মাস বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার। গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ এক হাজার ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। এতে সব মিলে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৩ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৭৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, যখন রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হচ্ছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় আশানুরূপ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে দেশ। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে মাস শেষে সেবা খাতে দেশের আয় ২২৩ কোটি ডলার। অন্যদিকে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৩৩ কোটি ডলার। এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের (২০২১-২০২২) একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৬০ কোটি ডলার।
তবে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। প্রতিবেদন মতে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার, যা তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২০২২) একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ২৫৪ কোটি ডলার।
সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভারঅল ব্যালান্স) বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনেদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ সূচক গত অর্থবছরের একই সময়ে ৮১ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ চাপে পড়েছে কোনো সন্দেহ নেই। অবস্থার উন্নয়নে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা গেলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। দেশবাসীও সেটাই চায়।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র অধ্যাপক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।