ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মহিউদ্দিন খান মোহন : অস্বীকার করা যাবে না, গত পঁয়তাল্লিশ বছরে সামাজিক অগ্রগতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি সন্তোষজনক। এসব ক্ষেত্রে আমরা হয়তো আরো এগিয়ে যেতে পারতাম, যদি দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা জাপটে না ধরতো। বাংলাদেশের আজ যে উন্নতি এটা এক দিনে হয়নি। বিগত দিনগুলোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলেন, গত ৮-১০ বছরে বাংলাদেশ উন্নতির এ শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু তারা হিসাব করে দেখেন না যে, অতীত সরকারগুলোর সময়ে উন্নয়ন-অগ্রগতির ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল বলেই তার ওপরে বহুতল ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।
তবে, আমাদের জাতীয় জীবনে যে কয়েকটি জিনিসের প্রচ- অভাব এখনো অনুভূত হচ্ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। তন্মধ্যে যে জিনিসটির অভাব এখনো তীব্রভাবে বোধ হচ্ছে সেটিই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। পাকিস্তানি শাসকরা আমাদেরকে কথা বলতে দিত না। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার তারা হরণ করে নিয়েছিল বলেই আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, বিদ্রোহ করেছিলাম। সর্বশেষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে ওদের পরাজিত করে গণতন্ত্রের সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করেছিলাম। কিন্তু গণতন্ত্রের সে দুয়ার কি আমাদের সামনে অবারিত হয়েছে? মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা- এসবের অবস্থাই বা কী? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলেই মনটা বিষণœ হয়ে পড়ে। আর তখনই স্বাধীনতার প্রত্যাশা প্রাপ্তির মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা, গণতন্ত্র এখনো আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে।
আমার এ কথায় কেউ কেউ আপত্তি তুলতে পারেন। বলতে পারেন, কেন, দেশে তো গণতন্ত্র আছে। বহুসংখ্যক রাজনৈতিক দল তাদের ক্রিয়াকলাপ চালাচ্ছে, নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, প্রতিবাদ করছে, সংবাদ সম্মেলন করছে, টিভি টক শো’তে আলোচকরা সরকারের সমালোচনা করে কথা বলছে। তাহলে গণতন্ত্রের অভাববোধটা আসে কোত্থেকে? এ প্রশ্নের সোজা সাপটা কোনো জবাব নেই। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা চব্বিশ বছর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সে গণতন্ত্রের ছবি-ছুরত কী খুব একটা তরতাজা বর্তমান বাংলাদেশে?
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য এদেশের মানুষ অভাবিত ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতার অল্পসময় পরেই দেশবাসীকে হতাশ হতে হয়েছে। চোখের সামনে গণতন্ত্রের মৃত্যু হতে দেখেছে তারা। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সে সমাধির ওপর একদলীয় স্বৈরশাসনের প্রাসাদ তৈরি হতে দেখে সবার হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হয়েছে। দুঃখজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে এক সময় সে অবস্থার অবসানও হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসার অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আবারও তার ওপর আঘাত এসেছে। ১৯৯০-এ স্বৈরশাসনের অবসানের পর অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন যে, আমাদের গণতন্ত্র হয়তো এবার সাবলীল গতিতে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণতা ও রাষ্ট্রক্ষমতার মোহ সে পথে অনাকাক্সিক্ষত বাধার সৃষ্টি করেছে। ফলে গণতন্ত্র এখনো হাঁটু সোজা করে দাঁড়াতেই পারছে না, পথ চলা শুরু করা তো দূরের কথা।
‘বাংলাদেশে পূর্ণ গণতন্ত্র বিদ্যমান’- এমন একটি শ্রুতিমধুর বাক্য আমরা মাঝেমধ্যেই শুনতে পাই। বিশেষত ক্ষমতাসীন মহল থেকেই কথাটি শোনা যায়। আবার তাদের গুণগ্রাহীরাও তাতে সমর্থনের করতালি দেন। কিন্তু কথিত সে গণতন্ত্রের উদাহরণটা কী? সেটা কি একটি বড় রাজনৈতিক দলকে সভা-সমাবেশ, মিছিল করতে না দেয়া? সেটা কি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা দায়ের এবং তাদের ধরে জেলখানা ভর্তি করে ফেলা? দেশে যদি গণতন্ত্রই থাকবে তাহলে রাজপথে বিরোধী দলকে কেন নামতে দেয়া হবে না? সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়- বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার আশঙ্কায় অমুক দলকে সভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। এ ধরনের ব্যাখ্যা কি গ্রহণযোগ্য? এ তো ‘বনের বাঘ খায় না, মনের বাঘে খায়’- অবস্থা। মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠানের আগেই সরকার নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে ওতে সহিংসতা ঘটবে, বিশৃঙ্খলা হবে। কেন এ ধরনের আশঙ্কা? বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়, বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার জন্য এটা একটা খোঁড়া যুক্তি। এসব বিষয়ে অনেক কথা বলাবলি হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। ফলে আমাদের গণতন্ত্র এখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছে।
সরকারি দলের নেতারা ইদানীং একটি কথা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন। তাহলো ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’। কোথা থেকে তারা এ অভিনব ফর্মূলাটা আবিষ্কার করলেন, কারোরই তা বোধে আসে না। উন্নয়ন করতে গেলে গণতন্ত্রকে কেটে ছেঁটে নিজেদের উপযোগী ‘সাইজ’ করে রাখতে হবে একথা কেউই মানতে নারাজ। গণতন্ত্র আর উন্নয়ন তো পরস্পরবিরোধী কোনো বিষয় নয় যে, দু’টো এক সঙ্গে চলতে পারে না। বরং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে গণতন্ত্রের দ্বারকে অবারিত করা দরকার এমনটিই বলে থাকেন অভিজ্ঞজনেরা। কিন্তু গণতন্ত্রের দ্বার এখন প্রায় রুদ্ধ এটাই বাস্তবতা।
এ গণতন্ত্রহীনতার জন্য এককভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর দায় চাপানোটা সুবিবেচনা প্রসূত হবে বলে মনে হয় না। অতীতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ভুলের কনিকা সৃষ্টি করে বড় ভুলের একটি পি-। আর সে পি-ের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্য কারণ। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি অতীত কার্যকলাপ, পদক্ষেপ-সিদ্ধান্ত ইত্যাদির নির্মোহ পর্যালোচনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, ভুলটা কোথায় হয়েছিল, এবং কী করে তা থেকে আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটল। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর উদগ্রতা ও অসহিষ্ণুতাই গণতন্ত্রের পথে বারবার কাঁটা ছড়িয়েছে। দুঃখজনক হলো, অতীতের সে সব তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বোধোদয় ঘটাতে পারেনি।
‘সুশাসন’ শব্দটি প্রায়ই শুনি আমরা। তবে এখনো যে তার দেখা মেলেনি সেটা না বললেও চলে। দুর্নীতি-দুঃশাসন এমনভাবে চেপে বসেছে যে, সুশাসন শব্দটি এখনো আমাদের কাছে ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ই রয়ে গেল। ঘুষ-দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, শিশু ও নারী নির্যাতন-খুন-গুম যেভাবে সমাজকে ঘিরে রেখেছে, সুশাসন বোধকরি ফাঁক খুঁজে পাচ্ছে না একটু স্থান করে নেয়ার। আইন-শৃঙ্খলার কথা না বলাই ভালো। এমন কোনো দিন নেই যে দিন ডজনখানেক খুন-ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশ হয় না। পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি শাসক দলের কর্মী-ক্যাডারদের তা-বের খবর দেশবাসীকে সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখছে। এসব সুশাসনের নমুনা নয়। বরং, সুশাসন নেই বলেই অপরাধ জেঁকে বসতে পারছে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, অপরাধ প্রবণতায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশের জড়িয়ে যাওয়া। শাসক দলের এমপির বিরুদ্ধে যখন মাদক ব্যবসায়ের অভিযোগ ওঠে, কিংবা তারা যখন খুনের দায়ে অভিযুক্ত হন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না সুশানের অন্তরায়টা কোথায়। ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে’- চীনা এ প্রবাদটি স্মরণে রেখে বলতে হয়, রাষ্ট্রের শীর্ষদেশ যখন অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত হবে, সুশাসন তখন আপনা আপনিই জায়গা করে নেবে। তার জন্য কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজন হবে না।
পাকিস্তান আমলে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়েই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকগণ তাদের অধিকার স্বাধীনভাবে প্রয়োগ ও ভোগ করবে এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। যদি প্রশ্ন করা হয়, এদেশের মানুষ তাদের সে অধিকার কতোটা ভোগ করছে তার জবাব কী হবে? বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭ক ধারা পর্যন্ত নাগরিকদের যেসব অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কতোটা বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ ভোগ করছে তা ভেবে দেখার বিষয়। বলা বাহুল্য যে, সংবিধানের ওইসব ধারার মধ্যেই নাগরিকদের মৌলিক ও মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেসব অধিকারের অধিকাংশই অনুপস্থিত। কখনো ব্যক্তি স্বার্থে প্রভাবশালীরা, কখনো রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিংবা অতিপ্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করছে। তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। সমাজের প্রভাবশালীদের অন্যায়-অবিচার কিংবা দুর্বৃত্তদের অত্যাচারের প্রতিকার পাবার রাস্তাটা পর্যন্ত খোলা থাকে না। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকে, সাহস পায় না প্রতিকার চাওয়ার। আবার যাদের কাছে প্রতিকার চাইবে সেই তারা, আইন প্রয়োগকারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী আর দুর্বৃত্ত দুরাচারদের পক্ষাবলম্বন করে থাকে। ফলে প্রতিক্ষণে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে হৈ চৈ কম হচ্ছে না। কিন্তু অবস্থার উন্নতির কোনো আভাস নেই।
আমাদের স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির তুলনামূলক আলোচনা ও ছোট্ট পরিসরে সম্ভব নয়। স্বাধীনতা আমাদেরকে দিয়েছে অনেক। আমরা জাতি হিসেবে এগিয়েছি বহু পথ। কিন্তু গণতন্ত্র, সুশাসন আর মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের যে অপূর্ণতা তা আমাদের স্বপ্নকে অনেকাংশেই ফিকে করে দিয়েছে। এখানে স্বাধীনতার কোনো দায় নেই। দায় তাদের, যাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল স্বাধীনতার সুফল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার। বলা প্রয়োজন, এ দায়িত্ব তারা নিজেরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু তা সঠিকভাবে পালন করেননি বা করতে পারেননি। উন্নয়ন-উৎপাদন যতোই হোক, অর্থনীতি যতই শক্তিশালী হোক, গণতন্ত্র যতদিন শক্ত ভিতের ওপর না দাঁড়াবে, মানবাধিকার যতদিন সুপ্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা, পাবে না, অর্থবহ হয়ে উঠবে না। ততদিন আমাদের মনে হতে থাকবে- ‘আমাদের কী যেন থেকেও নেই।’
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।