Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসরাইলের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এখন সময়ের দাবি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক সাধারণ অধিবেশনে আবারো বিশ্বের প্রায় সবজাতি ইসরাইলের পারমানবিক অস্ত্রের বিষয়ে স্বচ্ছতা ও ইসরাইলকে পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত করার প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিশরের উত্থাপিত এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ,বাহরাইন জর্দান, মরোক্কো ও আরব আমিরাতসহ ১৯টি দেশ স্পন্সর করেছে। প্রস্তাবের পক্ষে ১৫২টি দেশ ভোট দিয়েছে বিপক্ষে মোট ৫টি দেশ ভোট দিলেও ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ছাড়া বাকি দুটি দেশ হচ্ছে মাইক্রোনেশিয়া, পালাও। অর্থাৎ বিশ্ব সম্প্রদায়ের দাবি ও আবেগ উৎকণ্ঠাকে অগ্রাহ্য করে ইসরাইলের পারমানবিক সমরাস্ত্রের একমাত্র সমর্থক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্রের মূল প্রস্তাবক ও অনুঘটক গ্রেট বৃটেনও নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটদানে বিরত ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের মুখোমুখি অবস্থানে বিশ্বের এক বিশেষ ক্রান্তিকালে জাতিসংঘের এই ভোটাভুটিতে এবার এটাই প্রমানিত হল, ইসরাইল প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা একা ও একঘরে হয়ে পড়েছে। উত্তর আমেরিকার সীমান্তবর্তী দেশ কানাডা ছাড়া তার আর কোনো সমর্থন নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ২৪টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে ইসরাইলের পারমানবিক অস্ত্রের প্রশ্নে তাদের অস্বচ্ছতা ও নেপথ্য ভ’মিকা এবং কৌশলগত অবস্থান নির্দেশ করেছে। জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে খুব অল্প কয়েকটি দেশ পারমানবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বা এনপিটিতে সই করেনি। তাদের মধ্যে ইসরাইল একটি এবং মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসি সামরিক পরাশক্তি রাষ্ট্রের অবস্থান বা অপতৎপরতা নেই। ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ও জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ঈথকেই রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যের সব প্রকিবেশির জন্য হুমকি ও পশ্চিমা বশংবদ শিখন্ডী বা লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করে চলেছে। জাতিসংঘের রেজুলেশন অনুসারে ফিলিস্তিনকে দুইভাগ করে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন পাশাপাশি দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হলেও গত ৭৫ বছরেও সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মূল বাঁধা হয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসরাইলের সাথে প্রতিবেশি দেশগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করার বদলে তারা ইসরাইলকে একটি আগ্রাসি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সামরিক প্রযুক্তি, সমরাস্ত্রসহ প্রতি বছর শত শত কোটি ডলারের সামরিক বাজেট দিয়ে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পেন্টাগনের সেটেলাইট ইনস্টলমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরপরও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরাইলের সাথে পাল্লা দিয়ে পারমানবিক অস্ত্র অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়নি। মূলত পশ্চিমাদের ইন্ধনে মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো সামরিক-রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে কঠোরভাবে দমন করতে ইসরাইলের গোয়েন্দা সমরশক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। ইরানে পঞ্চাশের দশকে প্রথমবারের মত আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচিত সরকার হিসেবে মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ইঙ্গ-মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতায় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ইরানে আবারো পাহলভি রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যর্থ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে মূলত ইঙ্গ-মার্কিনীরাই ইরানী জনগণের মধ্যে ইসলামি বিপ্লবের স্পৃহা বাড়িয়ে তুলেছিল।

মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিরোধ উস্কে দেয়ার পাশাপাশি সামরিক-অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরানের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করতে সর্বাত্মক প্রয়াস চারদশক ধরেই অব্যহত রয়েছে। এতে করে ইরানের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করা যায়নি। শাত-ইল আরবের সীমারেখাকে কেন্দ্র করে ইরাককে ইরানে হামলার উস্কানি দিয়ে আট বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছিল। সার্বক্ষণিক হুমকি-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বশংবদ, পেট্রোডলারে সমৃদ্ধ যে কোনো দেশের চেয়ে ইরানের বর্তমান অবস্থান সব দিক থেকেই শক্তিশালী ও স্থিতিশীল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্ন দেশের সাথে ইরানও এনপিটি বা পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে সই করেছে। সে অনুসারে ইরানের পারমানবিক স্থাপনাগুলোতে আন্তর্জাতিক পরমানু পরিদর্শকরা পরিদর্শন ও রির্পোট করার সুযোগ লাভ করছে। তবে সে সব পারমানবিক পরিদর্শকরা ইরানের পরমানু স্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দিয়ে ইসরাইলী আক্রমনের পথ সুগম করছে বলে ইরানের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। পারমানবিক প্রযুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে ইরানের গবেষণা ও সক্ষমতাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও সরাসরি সামরিক আগ্রাসনের হুমকি কয়েক দশক ধরেই জারি রয়েছে। পক্ষান্তরে ইসরাইলের পারমানবিক উচ্চাভিলাষ এবং গ্রেটার ইসরাইল গঠনে আগ্রাসি জায়নবাদি তৎপরতা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে অস্বস্তি ও নিরাপত্তাহীনতা থাকলেও পশ্চিমা দেশগুলো পরোক্ষ হুমকি ও গোপণ কূটনৈতিক তৎপরতায় এক ধরণের আপস সমঝোতায় বাধ্য করছে। সেখানে শিয়া-সুন্নী বিরোধকে ম্যাগনিফাই করার সাথে সাথে ইরানের বিপ্লবকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলোর জন্য বড় হুমকি বা জুজু হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে ইসরাইলের পরমানু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ প্রস্তাবে ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবদেশ এক কাতারে সামিল হয়ে পক্ষে ভোট দিলেও ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে ইরানের সাথে এসব রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনে মূল বাঁধা আরব রাজপরিবারগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের গোপণ সমঝোতা। সেই প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তুর্কি খেলাফতের পতনের ধারাবাহিকতায় আজকের ইরানকে সমীকরণেরই একই কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা, বাইতুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেমের মুক্তি, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেনের কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসের হোলিখেলায় মত্ত পশ্চিমা ওয়ার মেশিনারিজের চেয়েও ইরানের কথিত পারমানবিক প্রকল্প বড় হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজারা গত ৭ দশক ধরে সবকিছু যেন পশ্চিমা প্রোপাগান্ডার চোখেই দেখে আসছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিশরের নেতৃত্বে ইসরাইলের পরমানু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ প্রস্তাব সাম্প্রতিক কালের একটি মাইলফলক উদ্যোগ। আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে গত ৫ দশকে জাতিসংঘে ইসরাইলের ঔদ্ধত্বের বিরুদ্ধে গৃহিত সব প্রস্তাবই ব্যর্থ হয়ে গেছে। জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো এই ব্যর্থ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের শান্তির প্রত্যাশা ও সমন্বিত প্রয়াসকেই ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। এভাবেই ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে পরিনত করা হয়েছে।

আল জাজিরা অনলাইনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে ১৯৭২ সাল থেকে জাতিংসংঘে পাস হওয়া অন্তত ৫৩টি রেজ্যুলেশন মার্কিন ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়ে গেছে। পারমানবিক অস্ত্র সম্পর্কে তথ্য দিতে জাতিসংঘের অব্যাহত প্রয়াসে সাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৮১ সালের ১৯ জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৪৮৭ নম্বর রেজ্যুলেশনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সর্বসম্মত নিন্দা প্রস্তাব পাস করা হয়। এর দুই বছর পর ১৯৮৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের ৩৮/৬৪ নম্বর রেজ্যুলেশনে মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশ একটি পরমানু অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবদেশে আইএইএ’র তদারকির সুযোগ নিশ্চিত করতে সম্মত হলেও একমাত্র ইসরাইল প্রস্তাবে সাঁড়া দেয়নি। এরপর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসি তৎপরতা, হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একের পর এক নিন্দা প্রস্তাব পাস হলেও মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এবং ভেটো প্রয়োগের কারণেই তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১০২তম প্লেনারি মিটিংয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আগের ৪ বছরে গৃহিত ৮টি প্রস্তাব ও নিন্দা প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা শেষে কমিটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪০তম অধিবেশনে ‘ইসরাইলের পারমানবিক অস্ত্র’ একটি আলোচনার এজেন্ডা হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং জাতিংঘ মহাসচিবকে এ প্রসঙ্গে আগের রেজ্যুলেশনগুলোর উল্লেখপূর্বক একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করতে অনুরোধ জানানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গড়ার উদ্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর পাশাপাশি ইসরাইল বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে গোপণে পারমানবিক সহযোগিতামূলক তৎপরতা এবং জাতিসংঘ চার্টার লঙ্ঘন করে এনপিটি স্বাক্ষরকারী ইরাকের পারমানবিক স্থাপনায় বিমান হামলা করে ধ্বংস করার ঘটনার বিরুদ্ধেও নিরাপত্তা পরিষদ নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে সামরিক শক্তির জোরে গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখা ইসরাইলকে পারমানবিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলার সুযোগ দিয়ে ইরানসহ অন্য দেশগুলোকে অস্ত্রমুক্ত রাখার পশ্চিমা তৎপরতা ব্যর্থ হয়নি। তবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বার্থেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পারমানবিক সমরাস্ত্রের উচ্চাভিলাস পরিহার করেছে। এরপরও ইরানের উপর পশ্চিমা চাপ অব্যাহত রয়েছে। তবে ইসরাইলের পারমানবিক সমরাস্ত্রকে জবাবদিহিতার বাইরে রেখে ইরান বা অন্যকোনো দেশের উপর এ বিষয়ে মনগড়া জুজু দেখিয়ে হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা জারি করার নৈতিক বৈধতা বিশ্ব সম্প্রদায়ের আছে কিনা সে প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে।

নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে স্বাধীন ইউক্রেন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউক্রেন ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমানবিক শক্তিসমৃদ্ধ দেশ। এর আগে ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমানবিক কেন্দ্রের রি-অ্যাক্টরের দুর্ঘটনাটি বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পারমানবিক দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। স্বাধীনতার শর্ত অনুসারে ইউক্রেনের সমরাস্ত্রগুলো রাশিয়ায় সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। এখনো ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমানবিক রিঅ্যাক্টর ও বিদ্যুতকেন্দ্র ইউক্রেনে আছে। ইউক্রেনের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক অনেকটা মায়ের পেটের ভাইয়ের মত। দু’টি রাষ্ট্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দাবিয়ে রাখতে এবং জ্বালানির স্বার্থ পশ্চিমাদের অনুকুলে রাখতে যেভাবে ইসরাইলকে ব্যবহার করা হচ্ছে, ঠিক একইভাবে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিরাপত্তা হুমকির মুখে রাখতে ইউক্রেনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যতিক্রমী সাজুয্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ইসরাইলের বাইরে ইউক্রেনই হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী ইহুদি ধর্মাবলম্বী। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের শুরুতে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর মস্কো-কিয়েভ দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। আরব-ইসরাইল ইস্যুর বাইরে কোনো ইসরাইলী নেতাকে এতটা তৎপর ও পেরেশান আগে কখনো দেখা গেছে কিনা আমার জানা নেই। অথচ ইউক্রেনে ইহুদি জনসংখ্যা শতকরা ১ ভাগেরও কম। এই একভাগেরও কম মানুষের হাতে বিপুল পরিমান সম্পদ ও কর্পোরেট-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই অবস্থা বিরাজমান। সেখানকার মিডিয়া, থিঙ্কট্যাঙ্ক, ব্যাংকিং সেক্টর ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও শক্তিশালী কর্পোরেট হাউজগুলোর নিয়ন্ত্রণ জুইশদের হাতে। ইসরাইলের কট্টর সমর্থক জুইশ লবিস্টরা মার্কিন রাজনীতি, পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউজের উপর প্রবল প্রভাব বজায় রেখে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে সিনেটে নেতানিয়াহুর বক্তৃতা দেয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বারাক ওবামার দূরদর্শী চিন্তার ফসল হিসেবে ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পরমানু সমঝোতা চুক্তি থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে বেরিয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে কনফ্লিক্টে জড়ানোর নীল নকশা করা হয়েছিল। আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনীর পরাজয় সে নীল নকশাকে ব্যর্থ করে দিলেও জায়নবাদী ইসরাইলীদের ষড়যন্ত্র কথানো থেমে থাকেনি। ইউক্রেন যুদ্ধে দুই পরাশক্তির প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে ইসরাইল কৌশলগত অবস্থান নিয়ে গোপনে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে ইরানও রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী ড্রোন সরবরাহ করছে। ইউক্রেনের ইহুদি প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি এই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে পরোক্ষভাবে ইসরাইলকে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের দাবি জানিয়েছে। জেলেনস্কি এবং জায়নবাদি ইসরাইলীরা একটি পারমানবিক যুদ্ধের উস্কানি দিয়ে চলেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যখন ১৫২-৫ ভোটে ইসরাইলের পারমানবিক সমরাস্ত্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরস্ত্রীকরণে সম্মত হয়েছে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর বিপক্ষে দাঁড়ালেও পক্ষান্তরে এ সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইরানের হাতে কোনো পারমানবিক অস্ত্র নেই এবং তারা তা অর্জনের চেষ্টাও করছেনা। এ তথ্য সামনে রেখে জো বাইডেন প্রশাসনের ইরান বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি রবার্ট মিল্লি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাহৃত জেসিপিওএ বা ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তিতে ফেরত যাওয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে ইসরাইলের পারমানবিক অস্ত্র সম্পর্কে বিশ্বসম্প্রদায়ের উদ্বেগ, নিন্দা ও ঐকমত্যের পরও মার্কিনীদের নিরবতা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। আগ্রাসি শত্রুর হাতে পারমানবিক অস্ত্র রেখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিরস্ত্র হাতে বসে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন